ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আলাদিনের জিন কতজনের সেবাদাস?

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:২০ এএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আরব্য রজনী, ঠাকুমার ঝুলি, গরীব কাঠুরিয়ার কহিনী, খোশগল্প, কেচ্ছামশাই ইত্যাদি সবকিছুতেই সেবাদাস স্বরূপ জিন, ভূত-প্রেত দৈত্যরা চেরাগ-পিদিম নিয়ে মালিককে সম্পদশালী করে দেবার জন্য হুকুমের অপেক্ষায় গর-গর করতো। মালিক রাজা-বাদশা হলে সোনা, মণি-মুক্তা, রাজমহল তৈরি করে দেবার আদেশ করতো। আর আলাদিনের মতো সৎ মানুষেরা বেঁচে থাকার মতো দুমুঠো খাবার অথবা মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করে দেবার জন্য আদেশ করতো। এসব আদ্যিকালের গল্পগাথা। আজকাল ডিজিটাল যুগের জিনের বাদশাহর হাতে অত্যাধুনিক মোবাইল ডিভাইস। তাদের ধূর্ত সেবাদাসও অগণিত!

এযুগের সেবাদাসদের অন্তরের মধ্যে বাস করছে বিপথগামী জিন-দৈত্যরা। তাদেরকে কারো হুকুমের অপেক্ষা করতে হয় না। তারা নিজেরা জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে সম্পদশালী হবার জন্য নানা হীন কায়দায় প্রচেষ্টা চালায়।

সেদিন হীন কায়দায় একজনের সম্পদ অর্জন করা নিয়ে একটি খবরে আমার চোখ আটকিয়ে গেছে। তার কারণ, একটি দুটি নয় অনেকগুলো পত্রিকায় বড় হরফে এর শিরোনাম থাকা। কৌতূহল বশত: পড়তে গিয়ে নানা ঘটনার কথা মনে হতে লাগলো। আর ভাবতে লাগলাম আলাদিনের চেরাগ ঘঁষে বের হওয়া জিনের কথা। সো তো একটি জিন একজনের অনুগত ছিল। একজন মালিকের আদেশ মানতো। যার হাতে চেরাগ যেত সে জিনকে সামনে হাজির করে যা খুশি আদেশ করে আনাতে পারতো। আমাদের দেশে এত মানুষের হঠাৎ সম্পদশালী হবার প্রকাশিত কারণগুলো পড়তে গিয়ে মনে হলো সবার হাতে একটি করে চেরাগ ঘঁষে পাওয়া অনুগত জিন আছে নাকি?

চট্টগ্রামে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) পূর্বাঞ্চলের এক কর্তা নিজের নামে কিনেছেন কোটি টাকার ফ্ল্যাট, বাড়ি ও গাড়ি। তার পেশায় গৃহিণী কিনেছেন কোটি টাকার ফ্ল্যাট, বাড়ি। ‘তাঁদের দুজনের সোয়া চার কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তিনি ১৯৯০ সালে সাঁট মুদ্রাক্ষরিক-কাম টাইপিস্ট পদে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনে যোগ দেন। ২০০০ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পদে পদোন্নতি পান। পরবর্তীতে.... হন।’ এটা একটি সংবাদ হলেও কত জায়গায় আরো কত শত উদাহরণ আছে তা অজানা ।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ কমলেও ধনী-কোটিপতি আর ব্যবসায়ীদের প্রার্থীদের আগ্রহ বেড়েছে অনেক। গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়ী অংশ নিচ্ছে সাতই জানুয়ারির নির্বাচনে। দ্বাদশ নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীদের দেয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে আর্ন্তজাতিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলছে, নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীদের ২৭ ভাগই কোটিপতি। মোট ১৮৯৬ জনের মধ্যে কোটিপতির সংখ্যা ৪৮০ জন এবং ১০০ কোটি টাকা মূল্যের বেশী সম্পদ আছে ১৮ প্রার্থীর।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক বলেন, আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানে একজন মন্ত্রীর দেশের বাইরে একটি দেশে ১৬ কোটি ৬৪ লাখ পাউন্ড যা বাংলাদেশি টাকায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে বলে উঠে এসেছে। কিন্তু মন্ত্রী তার নির্বাচনী হলফনামায় সেই তথ্য দেননি। টিআইবি পরিচালক বলেন, ‘রিয়েল এস্টেট খাত, যে ক্ষেত্রে এই ইনভেস্টমেন্টগুলো, এটার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও কোনো অনুমোদন দেয়নি।’

অনেক সরকারী-বেসরকারী ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ী ও চাকুরীজীবিরা নিজের পেশার পাশাপাশি বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে গোপনে করছে মাদকের ব্যবসা। ‘যাদের বাড়ীতে ছিলনা কাঠের চেয়ার, তারা এখন সোফায় বসে টেলিভিশন দেখে আর পা নাড়ায়। নেপথ্যে মাদকের অবৈধ টাকার উৎস।’

সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির পেশার মানুষেরা সৎ উপার্জনের মাধ্যমে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতে যখন হিমশিম খাচ্ছে কিংবা কোন ভাবে জীবনযাপন করছে তখন তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য এসেছে অবৈধ মাদক। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে সমাজের এক শ্রেণির লোভী এবং ধান্দাবাজ চক্ররা। তারা নিজেদের পেশার অন্তরালে গোপনে করছে মাদক ব্যবসা।

বিরাট ধনী হয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক। তার শতকোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। উনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি পাজেরো গাড়িতে চড়তেন। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরো দুটি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। একটি পিকআপ গাড়ি তিনি নিজের গরুর খামারের দুধ বিক্রি এবং মেয়ের জামাই পরিচালিত ক্যান্টিনের মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার করতেন। আরেকটি গাড়ি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত তার পরিবারের অন্য সদস্যরা ব্যবহার করতেন। রাজধানীতে দুটি সাততলা বিলাসবহুল ভবন আছে তার, যাতে মোট ২৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে। আছে নির্মাণাধীন একটি ১০ তলা ভবন।

একজন মন্ত্রীর এপিএস মন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাধর। ষষ্ঠ গ্রেড অনুযায়ী একজন এপিএস সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬৭ হাজার ১০ টাকা বেতন গ্রহণ করতে পারেন। সর্বোচ্চ বেতন হিসাব করলে ১৩ বছরে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা বেতন উত্তোলন করেছেন। কিন্তু রাজধানীতে তার রয়েছে আটটি ফ্ল্যাট।

বাংলাদেশ ধনী তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। এই কারখানা থেকে নিয়মিত ধনী উৎপাদন হচ্ছে—‘এটা আমাদের জন্য অবশ্যই সুখবর। সাহেদ, মালেক, সম্রাট, সাবরিনা, পাপিয়া, পিকে হালদাররা হচ্ছেন এই কারখানার শ্রেষ্ঠ পণ্য। আগামী দিনে স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে এই সব সফল মানুষদের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।’ জীবনে কীভাবে নিচু থেকে ওপরে ওঠা যায়, সেটা আগামী দিনের নাগরিকদের অবশ্যই জানা দরকার! নীতি-আদর্শ তো এখন কেবলই মুখের বুলি।

আসলে সবাইকে টেক্কা দিয়ে অঢেল অর্থ-সম্পদ অর্জনের খেলায় এগিয়ে যাওয়াই তো স্পোর্টিং স্পিরিট! আর জীবনযুদ্ধ তো প্রতিযোগিতারই নামান্তর। তাহলে কেন বন্ধ হবে এই খেলা? শুধু দু-একজন ভুল শট খেলে অতিআগ্রাসী হয়ে অসময়ে আউট হয় আরকি! এটা সব খেলাতেই হয়!

আমাদের দেশে টেরর, মাদকসেবী, মাদকব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের লোকেরা সুবোধ তরুণদেরকে ডেকে নিয়ে দলে ভিড়ায়, মাদক গিলায়, এরপর মাদক ব্যবসায় নামিয়ে দেয়।এর সাথে রিটায়ারমেন্টের আগেই (ক্রিকেটার ইমরান খানের মতো নয়) খেলোয়ারদের রাজনীতি নামক ধনী হবার খেলায় ভিড়ে যাবার মধ্যে কোন পার্থ্যক্য আছে কি? এমন বিচরণ ও পেশাভ্রষ্টতা আমাদেরকে ‘কালো টাকা’ বানানোর সুযোগ দেয়।

ঢাকায় যাদের জমি ও ফ্ল্যাট আছে সবাই ‘কালোটাকার মালিক’ তাহলে এই বলার পিছনে যুক্তিটা কি? ঢাকার বাড়িগুলো কেন অবৈধ তার একটা আইনী ব্যাখ্যা দিতে না পারলেও ঢাকা শহরের জমির মৌজা হিসেবে আসল সরকারী মূল্য এবং ক্রয়—বিক্রয়ের চলমান অনুশীলনের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে এই বিষয়ের গভীরতা অনুধাবন করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরুপ: এলাকাভেদে প্রতিটি ওয়ার্ডে জমির সরকারী মৌজামূল্য নিধার্রিত রয়েছে। ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনতে গেলে এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুটের দাম পড়বে ৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দর আরও বেশি।

অবশ্য ফ্ল্যাট কেনাবেচার ওপর কর আদায়ের ক্ষেত্রে বর্গফুটপ্রতি সর্বনিম্ন দাম দেড় হাজার টাকা। ক্রেতারা সাধারণত এ দর দেখিয়েই ফ্ল্যাট নিবন্ধন নেন। কিন্তু বাস্তবে কেনাবেচা হয় তিন গুণ, চার গুণ অথবা ১০ গুণ দামে। ‘ফ্ল্যাট কেনাবেচায় যে পরিমাণ অর্থ দাম হিসেবে দেখানো হয়, প্রকৃত মূল্যের বাকিটা কিন্তু কালো হয়ে যায়।’

শুধু ফ্ল্যাট নয়, জমি কেনাবেচায় এমন ‘মৌজা রেট’ নির্ধারণ করা আছে। মৌজা রেট হলো জমি কেনাবেচায় কর আদায়ের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সর্বনিম্ন দর। রাজধানীর গুলশান এলাকায় জমির যে দাম দেখিয়ে নিবন্ধন করা হয়, জমির প্রকৃত দাম তার চেয়েও বেশি। কিন্তু বেশি দামে তো নিবন্ধন করানো যায় না, ‘প্রতিটি মৌজার জন্য দাম ঠিক করে দেওয়া আছে, এর বেশি দামে নিবন্ধন করা যাবে না। সুতরাং কালোটাকা তো সেখানেই সৃষ্টি হচ্ছে; কে কালো টাকার বাইরে আছে?’

জমির বিষয় ছেড়ে ব্যাংক হিসাবের কথা বলা যায়। বিত্তশালী ব্যাংকের লকারে গচ্ছিত মনি—মুক্তা, স্বর্ণ, হীরা জহরৎ, পান্না? একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি? সংসদ প্রার্থীদের গোপন সম্পদ অথবা হলফনামায় উল্লেখ নেই অথচ অঢেল সম্পদ থাকলে সেটা নিবার্চনের পর খতিয়ে দেখা হবে বলে দুদক জানিয়েছিল।

প্রশ্ন হলো— সম্পদ গোপন রেখে নিবার্চনে দাঁড়ানোটা যদি অনৈতিক বা বেআইনী হয় তাহলে প্রার্থী হবার বৈধতা পেল কীভাবে? আর প্রার্থীতা অবৈধ হলে নিবার্চন করে জয়লাভ করলে সেটার বৈধতা কীভাবে দেবে কমিশন? এধরনের নানা প্রশ্ন নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

ঢাকা মসজিদের শহর। পৃথিবীর এত ঘনবসতিপূর্ণ স্বল্প জায়গায় এত মসজিদ, মন্দির অন্যান্য উপাসনালয় ও ধর্মপ্রাণ মানুষও নেই। যাদের প্রায় পঁচানব্বই ভাগের আদর্শ সৎ জীবনযাপন করা। তাহলে কি দাঁড়ায়? ঢাকায় যাদের জমি ও ফ্ল্যাট আছে সবাই ‘কালোটাকার মালিক’ হন তারা সৎ-সাদা মনের অধিকারী হবেন কিভাবে? এই বৈপরীত্য আমাদেরকে কি শেখায়? দেশের দুর্নীতি, প্রতারণার শিকার মানসিক রোগের ব্যাপ্তি কি সাধেই দিন দিন বেড়ে চলেছে?

পাঁচ বছর আগে ও পরের সম্পদের স্ফীতির পরিমাণ হিসাব করলে শুধু আলাদিনের চেরাগ হাতে পাবার কথা মনে পড়ে। এর একটা ইতিবাচক বিহিত করতে দুদক নিজেই হিমশিম খাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে খেতে থাকবে। শিশু-কিশোর তরুণদেরকে সুস্থির সমাজ ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশের আওতায় প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কি হবে তা বলাই বাহুল্য।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/এমএস