জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ
ধর্ষণের বিচার না হওয়ার জন্য দায়ী ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনা আমাদের আবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো কতটা অসভ্য এক পরিবেশে আমরা বসবাস করছি। একবার, দু’বার নয় বারবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে সেরা বিদ্যাপীঠও মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়। আমরা কি বলতে পারবো আমাদের মেয়েরা কোথায় নিরাপদ- গৃহে, পথে, আত্মীয় গৃহে, অনুষ্ঠানে, রেল বা জাহাজে, যানবাহনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে? উত্তর হবে আদতে নারীর জন্য নিরাপদ কোনো স্থান নেই।
ক্যাম্পাসে দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে, তখন মনে হয় আমরা অমানুষ। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ছাত্রলীগ নেতা। এরা নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ধর্ষণ করছে, এটা ভাবতেই শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মনে হয় আমাদের সন্তানেরা এমনই একটি জায়গায় পড়াশোনা করছে, ছাত্র নিবাসে থাকছে, সারাদিন ঘোরাঘুরি করছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করছে ও বন্ধুদের সাথে গল্প করে, হেসে-গেয়ে সময় কাটাচ্ছে, অথচ তারা কেউ নিরাপদ নয়।
যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলেছেন ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের রাষ্ট্রীয় আইনে এবং বিশ্ববিদ্যালয় আইনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। ঘটনার পর মোস্তাফিজুর রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কারও করা হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এখানেই কি থেমে থাকবে, এই প্রশ্ন অনেকের মনে। কারণ এরকম নিপীড়ন যারা করে তারা একটা নির্দিষ্ট দলের মন্তব্য করে একজন শিক্ষক বলেন, 'পূর্বে তাদের নামে একাধিক অভিযোগ এলেও প্রশাসন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি।' তাই সবাই আশংকা করছে প্রশাসন হয়তো এবারও দায়সারা ভাবটি দেখাবে।
এইবারই যে প্রথম শিক্ষাঙ্গনে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে তা কিন্তু নয়। দু’বছর আগেও সিলেটের টিলাগড় এলাকার এমসি কলেজের গেটের সামনে থেকে একজন তরুণীকে তুলে নিয়ে গিয়ে ছাত্ররা ধর্ষণ করেছিল। ঐ তরুণী তার স্বামীর সাথে একটি গাড়িতে করে বেড়াতে গিয়েছিলেন। পরে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের একটি কক্ষের সামনে থেকে নিজের স্ত্রীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন স্বামী। ২০২৩ এর সেপ্টেম্বরে তিন বছর পূর্ণ হয়েছে আলোচিত মামলার কোনও কার্যক্রম দেখা যায়নি।
আলোচিত এই ধর্ষণ মামলার বিচার হোক সরকার তা চাইছে না বলে জানিয়েছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী। আদালত সূত্র জানিয়েছে, ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা ও মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার পরিদর্শক। অথচ সংঘবদ্ধভাবে এই ধর্ষণের ঘটনায় এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে বিচারকাজ শুরু হয়নি।
লক্ষ্য করলে দেখবেন, দেশে বছরজুড়ে অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে ৫৭৪ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এরমধ্যে ১৩৮ টি গণধর্ষণ। ধর্ষণের পর মারা গেছেন ৩৩ জন, আত্মহত্যা করেছেন ৫ জন। আর ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল আরো ১২৯ জনকে। ধর্ষণের কোনো ঘটনা নিয়ে তোলপাড় না হলে সেটির তদন্ত থেকে শুরু করে সবকিছুই ধীরে চলে। ধর্ষণের মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে। তবে তোলপাড় হলেই যে রায় পাওয়া যাবে বা বিচার কাজ শুরু হবে, তাও নয়।
দেশে যতো ধর্ষণের ঘটনা হচ্ছে এরমধ্যে হয়তো অর্ধেকের রিপোর্ট হচ্ছে, মামলা হচ্ছে আরো অর্ধেকের। ধর্ষণের মাত্র তিন ভাগের মতো মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পায়। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আইনের ফাঁক গলে ৯৭ ভাগ মামলাতেই আসামি খালাস পেয়ে যায়। ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে হইচই হচ্ছে ২/৩ টি ঘটনা নিয়ে। বর্তমানে যেমন হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি নিয়ে। এর আগে হয়েছিল সিলেটের এমসি কলেজে গৃহবধু ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে। কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। কিন্তু সেই তোলপাড় হওয়া পর্যন্তই। মামলার অগ্রগতি খুব ধীর বা নেই। নুসরাতকে হত্যার পর সেটা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়। কিন্তু যখন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন, তখন এর বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত হয়েছিল।
আমাদের দেশে বা সমাজে ধর্ষণ বস্তুত কোনো অপরাধ নয়। এই সমাজ প্রতিটি পদক্ষেপে অপরাধীকে রক্ষার ব্যবস্থা করে। তাই হয়তো ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে সহজেই ধর্ষণকারীর সাথে বিয়ে দেয়া হয়। সালিশে সামান্য টাকা জরিমানা করে এতবড় অপরাধ থেকে মুক্ত করে দেয়া হয় অপরাধীকে।
আমাদের দেশে যে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হন, সেই মেয়েটির জীবন যে কতটা বিপর্যস্ত ও কষ্টকর হতে পারে, তা বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। সমাজে ধর্ষণের শিকার নারী যতটা ঘৃণিত ও অবহেলিত হন, ধর্ষণ যে করে সে ততটা নয়। বরং ফাঁক গলে বেরিয়ে আসার অনেক নজির আছে। ধর্ষণের শিকার হওয়া তো অনেক বড় ঘটনা, কোনো মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হলেই এ সমাজে তার বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। যেমন, সমাজের মানুষের এই কটু কথার ভয়ে একজন অসহায় বাবা ধর্ষণের শিকার মেয়েকে নিয়ে গ্রামে ফিরতে চাইছেন না। চলন্ত ট্রেনে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কিশোরীটি কিছুদিন আগে।
অথচ অন্যদিকে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে জীবনভর এই ট্রমা বয়ে বেড়াতে হয়। সমাজের পুলিশিং চলতেই থাকে। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা মেয়েদের বিচার চাইতে নিরুৎসাহিত করে, মাঝেমধ্যে বিচার চাইতে বাধাও দেয়। এছাড়া ভিকটিম ব্লেইমিং চলতে থাকে, ভিকটিম ও তার পরিবারকে নাস্তানাবুদ করা হয়, ভয় দেখানো হয় নানাভাবে। যেমন সুবর্ণচরে গৃহবধুকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের দায়ে ১০ জনকে ফাঁসি ও ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে। এরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেছিল। অথচ ভিকটিমের স্বামী রায়ের পরপরই গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন তারা নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে কয়েকজন তাদের সামনে মহড়া দিচ্ছে।
ধর্ষণের মামলায় তদন্ত থেকে শুরু করে আইনি প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে ভিকটিমকেই সন্দেহ করা হয়। সবচেয়ে দুঃসহ ব্যাপার হলো ধর্ষণের শিকার নারীকেই সবকিছু প্রমাণ করার জন্য কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় এবং তিনি ক্রমশ একা হয়ে পড়েন। ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পক্ষে আর কখনোই শান্তিতে থাকা হয় না, বিচার পাওয়াও হয় না। এমনকি এই সমাজ তাকে ন্যূনতম সুরক্ষা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা দেয় না।
ফৌজদারি অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া এবং আইন নিয়ে কাজ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমীন। তিনি বলেছেন, পুরোনো সংজ্ঞা বিবেচনা করার কারণে মেডিকেল রিপোর্ট ঘটনা প্রমাণের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সেটা ক্ষতিগ্রস্তের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পুরোনো সংজ্ঞার কারণে ট্রাডিশনাল মাইন্ডসেট বা মেডিকেল রিপোর্টের ওপর অসম্ভব জোর দেয়া হয় ধর্ষণের শিকার নারীর ক্ষেত্রে। আর এই মেডিকেল রিপোর্টের মান তখনই বেড়ে যায়, যখন তাতে লেখা থাকে যে ভিকটিমের শরীরে ইনজুরির চিহ্ন আছে বা সে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে। যদি কোনো ইনজুরি চিহ্ন বা প্রতিরোধ করার চিহ্ন না থাকে, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই এটা ভিকটিমের জন্য নেগেটিভ হিসেবে কাজ করে। (সূত্র: বিবিসি বাংলা)
আমাদের দেশে যে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হন, সেই মেয়েটির জীবন যে কতটা বিপর্যস্ত ও কষ্টকর হতে পারে, তা বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। সমাজে ধর্ষণের শিকার নারী যতটা ঘৃণিত ও অবহেলিত হন, ধর্ষণ যে করে সে ততটা নয়। বরং ফাঁক গলে বেরিয়ে আসার অনেক নজির আছে। ধর্ষণের শিকার হওয়া তো অনেক বড় ঘটনা, কোনো মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হলেই এ সমাজে তার বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। যেমন, সমাজের মানুষের এই কটু কথার ভয়ে একজন অসহায় বাবা ধর্ষণের শিকার মেয়েকে নিয়ে গ্রামে ফিরতে চাইছেন না। চলন্ত ট্রেনে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কিশোরীটি কিছুদিন আগে।
এরকমই এক পরিস্থিতিতে বাস করে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ধর্ষণের শিকার আরেক নারী ও তাঁর বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের। ২০২২ সালে রাতে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল পরিবহনের চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। ওই নারী ডাকাতদলের দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। দেড় বছর আগের সেই ঘটনায় হওয়া মামলা এখনো সাক্ষ্য পর্যায়ে। এরমধ্যে সমাজের কটু কথা তাকে ও বাবা-মাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এদের কারণেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসে তিনি কাজ খুঁজছেন। গ্রামের লোকজন ওই ঘটনার জন্য আমাকেই দায়ী করেন। বলেন, তোর মেয়ে 'জরিমানা' (ধর্ষণের দুর্ভোগ) নিয়া ফিরছে। আমাকেও কথা শোনায়। যতই বলি, আমার কী দোষ? ওটা তো একটা দুর্ঘটনা। ওটায় কি আমার কোনো হাত আছে? কিন্তু কে শোনে কার কথা! ওদের কথা ওরা বলতেই থাকে। ওই নারীর ভাষায়, তাঁর 'কপালটাই পোড়া'। ধর্ষণের শিকার কিশোরীর বাবাও যেমনটা বলেছেন, "সবডাই আমরার মতো গরিবের দুর্ভাগ্য।"
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ ও ২০২২ সালে মামলার ৫২ শতাংশ ছিল ধর্ষণের, আগের চার বছরে এ হার ৪৮ শতাংশের নিচে ছিল। প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে ধর্ষণের 'বিচার' হচ্ছে সালিশে। সাজা হচ্ছে জরিমানা, চড়-থাপ্পড়। এরকম কয়েকটি ঘটনার কথা সংবাদে তুলে ধরা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে শিশু ধর্ষণ, কিশোরী ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল মনে করেন, ধর্ষণ হচ্ছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। এটা এতটাই গুরুতর অপরাধ যে রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা করতে পারে এবং শাস্তি হতে হবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। এ ধরনের অপরাধ মীমাংসা করা বা শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার সালিসকারীদের নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সালিশে ধর্ষণের বিচারের রায় নারীর বিপক্ষে যায়।
আমাদের সামাজিক অবস্থায় একজন ভিকটিম বা ভিকটিমের পরিবার খুব ট্যাবুর মধ্যে থাকেন ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনার পর। তারা ভাবতে বাধ্য হন মামলা করবেন কি না, সবার সামনে যাবেন কি না, বিচারের মুখোমুখি হবেন কি না, মামলার ব্যয়ভার বহন করতে পারবেন কি না, আসামিপক্ষ শক্তিশালী কি না ইত্যাদি। এইসব ভাবনা-চিন্তাতেই পার হয়ে যায় বেশ কিছুদিন। যে নারী-কিশোরী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হন, প্রথমেই তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে ট্রমায় চলে যান। ধর্ষণের পর বেশিরভাগ ভিকটিমের পরিবার এবং তার আত্মীয়স্বজন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়।
২০২১-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৫ বছরে আদালতে ধর্ষণ মামলা ৩০ হাজার ২৭২টি। কিন্তু কতজন অপরাধী ধর্ষণের দায়ে শাস্তি পেয়েছে? কতজনের বিরুদ্ধে সাক্ষী পাওয়া গেছে? কতজন প্রমাণের অভাবে বের হয়ে এসেছে? পরিবারগুলো কেন সালিশের দ্বারস্থ হয়, এ প্রসঙ্গে সুলতানা কামাল বলেন, ঘটনা ঘটার পর আইন সম্পর্কে সচেতনতা না থাকা এবং মেয়ের 'সম্ভ্রমহানির' ভয়ে অনেক পরিবার বুঝে উঠতে পারে না ধর্ষণ-পরবর্তী কী পদক্ষেপ নেবেন তারা। তাদের এ সময়ের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে গ্রামের মাতবর শ্রেণি ও স্বার্থান্বেষী মহল বোঝাতে থাকে, আইনের দ্বারস্থ হলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। তারা সালিশ করে একটা বিচার পাইয়ে দেবে।
তাহলে ধর্ষণ প্রতিরোধে কী করণীয় এবং ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির আইনি সুরক্ষা বিষয়টি কি অধরাই থেকে যাবে? শুধু একটি করে ‘আলোচিত ধর্ষণ’ এর ঘটনা ঘটবে, গণমাধ্যমসহ সব জায়গায় তুমুল আলোচনা হবে, তারপর একসময় সবকিছু থেমে যাবে। এ সময়ের মধ্যে তালিকায় আরও একটি ঘটনা যোগ হয়।
ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা যাতে ঘটতেই না পারে, সে জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন খুব জরুরি। সবচেয়ে আগে জরুরি এই সমাজের মগজ পরিষ্কার করা, যেন তারা বুঝতে পারেন ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি আঙুল তুলে দেখানো একটি বড় অপরাধ। এই আন্দোলনে নারী, পুরুষ একত্রিত হয়ে বলবেন ‘ধর্ষণ একটি ভয়াবহ অপরাধ। এই অপরাধের কোনো সালিশ হয় না। ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বিয়ে দেয়া আরো বড় অপরাধ। ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত বিচারের অধীনে নিতে হবে।’ মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। এইসব ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনাগুলোর সঙ্গে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালীরা জড়িত থাকায় তাদের বিচার হয় না। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও তারা আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। অধিকাংশক্ষেত্রে কারো কোনো শাস্তি হয় না।
আসামি রাজনৈতিক বা অন্য কোনোভাবে প্রভাবশালী কেউ হলে তাকে আর আইনের আওতায় আনা যায় না। তাই ধর্ষণের ঘটনা বন্ধ করতে হলে সবচেয়ে আগে দরকার রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। সমাজে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার নারীকে ঘৃণ্য করে তোলা যতোটা সহজ, অপরাধীকে ঘৃণা করা ততোটা সহজ নয় কারণ এরা যেকোনোভাবেই ক্ষমতাশালী। একদিকে সেই নারীর বিরুদ্ধে এমনভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়া হয় যেন সে এবং তার পরিবার বিচার না চেয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ভিকটিম পক্ষ এতোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হন যে নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন এবং বিচার প্রক্রিয়া আরো মুখ থুবড়ে পড়ে।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।
এইচআর/জেআইএম