ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

তবুও প্রাণবন্ত সংসদের প্রত্যাশা

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৯:০০ এএম, ২৯ জানুয়ারি ২০২৪

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরই মধ্যে ৩০০ আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথও নিয়েছেন। তবে একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ ছিল ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষেই বসছে বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। একাদশ জাতীয় সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নিয়ে সাংবিধানিক বিতর্কও হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ মিলে একই সঙ্গে ৬৫০ জন শপথ নেওয়া সংসদ সদস্য ছিলেন দেশে। তবে আইনমন্ত্রী বারবার বলেছেন, এতে সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে সব বিতর্কের অবসান ঘটলো আজ।

বুধবার নতুন প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু হচ্ছে নতুন একটি সংসদের। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল প্রথম সংসদ। আর প্রথম সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল। আজকের যে সুরম্য সংসদ ভবন, তখন সেটি নির্মাণাধীন ছিল। প্রথম অধিবেশন বসেছিল তেজগাঁওয়ে, আজ যেখানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, তখন সেখানেই বসতো সংসদের অধিবেশন। অবশ্য প্রথম সংসদ গঠনের আগেই বাংলাদেশ পেয়েছিল একটি চমৎকার সংবিধান। অবশ্য সেটাও এসেছিল জনগণের রায়ের ভিত্তিতেই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বসেছিল গণপরিষদ। যার মূল কাজ ছিল সংবিধান প্রণয়ন।

প্রচলিত সরকার ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রই সবচেয়ে ভালো। এমনকি এটাও বলা হয়, সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্রও অন্য যে কোনো ব্যবস্থার চেয়ে ভালো। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো সংসদীয় ব্যবস্থা। সংসদীয় ব্যবস্থায় জনগণের কাছে সরকার সম্মিলিতভাবে দায়বদ্ধ থাকে।

ব্যক্তি নয়, সংসদীয় ব্যবস্থায় সমষ্টি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সংসদীয় গণতন্ত্র একটি দুই চাকার সাইকেলের মতো। সরকারি ও বিরোধী দল মিলেই সচল থাকে সংসদ। একটি চাকা অচল হলে সংসদীয় গণতন্ত্রও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। কখনো কখনো সংসদ অচল হয়ে যায়।

বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের হাত ধরেই। তবে নানাভাবে তা বিঘ্নিত হয়েছে। কখনো সামরিক শাসন, কখনো রাষ্ট্রপতি শাসনে চলেছে দেশ। তবে ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারের পতনের পর ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদে তখনকার সরকারি দল বিএনপি ও বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা শুরু হয়। তারপর থেকে চলছে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা। তবে ১/১১এর অভিনব সরকারে সংসদীয় গণতন্ত্র হোচট খেয়েছে। আমরা এখনও আদর্শ সংসদীয় ব্যবস্থায় পৌঁছাতে পারিনি। ভালো-মন্দ, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একদিন নিশ্চয়ই আমরা গণতান্ত্রিক উৎকর্ষে পৌঁছাতে পারবো।

আজ শেষ হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ। তবে এই ১১টি সংসদের সবগুলো মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। সবগুলো কার্যকরও ছিল না। কয়েকটি ছিল সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার রাবার স্ট্যাম্প। ১১টি সংসদের মধ্যে আপনি যদি সরকারি ও বিরোধী দলের ভারসাম্য বিবেচনায় নেন তাহলে ’৯১ সালের পঞ্চম, ’৯৬ সালের সপ্তম এবং ২০০১ সালে অষ্টম সংসদকেই সেরা মানতে হবে। অবশ্য তখনও বর্জন, পদত্যাগে বারবার সংসদের কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছে।

রাস্তার গণতন্ত্র আর সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে বিস্তর ফারাক। একজন নেতা পল্টন ময়দানে যে বক্তৃতা দেন, সংসদে তা দেন না। সংসদে কথা বলতে হয় যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে, পারস্পরিক শ্রদ্ধার বিষয়টি মাথায় রেখে। সংসদ আমাদের পরমত সহিষ্ণুতা শেখায়। সংসদীয় গণতন্ত্রের উৎকর্ষটা হলো, সেখানে আপনি ‘মিথ্যা’ শব্দটিও বলতে পারবেন না, বলতে হবে ‘অসত্য’।

এখানে শ্রদ্ধা, সম্মানের বিষয়টি চলে আসে। এই যে আমাদের সংবিধানে লেখা আছে, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। সেই মালিকানা দৃশ্যমান হয় সংসদের মাধ্যমে। সংসদ সদস্যরা দেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, জনগণের কল্যাণে আইন পাস করেন, তাদের কথা সংসদে তুলে ধরেন। সংসদে মন্ত্রীদের প্রশ্ন করা যায়, এমনকি প্রধানমন্ত্রীকেও প্রশ্ন করা যায়।

আপনি প্রধানমন্ত্রীকে যে প্রশ্নটি করতে চান, আপনার এলাকার সংসদ সদস্যকে বলুন, তিনি যেন সেই প্রশ্নটি সংসদে প্রধানমন্ত্রীকে করেন। শুধু অধিবেশনে নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের একটা বড় অঙ্গ সংসদীয় কমিটি। এক সময় মন্ত্রীরা ছিলেন সংসদীয় কমিটির প্রধান। এখন সাধারণ সদস্যরাই সংসদীয় কমিটির প্রধান হন। আর এই কমিটি ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

রাস্তার গণতন্ত্র আর সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে বিস্তর ফারাক। একজন নেতা পল্টন ময়দানে যে বক্তৃতা দেন, সংসদে তা দেন না। সংসদে কথা বলতে হয় যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে, পারস্পরিক শ্রদ্ধার বিষয়টি মাথায় রেখে। সংসদ আমাদের পরমত সহিষ্ণুতা শেখায়। সংসদীয় গণতন্ত্রের উৎকর্ষটা হলো, সেখানে আপনি ‘মিথ্যা’ শব্দটিও বলতে পারবেন না, বলতে হবে ‘অসত্য’।

১৯৯১ সালের সংসদীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রায় বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতি আওয়ামী লীগ-বিএনপি এই দ্বিদলীয় ধারায় আবর্তিত ছিল। তখন থেকেই এই দুই দলের মধ্যে দূরত্ব। বিভিন্ন কারণে সময়ের সাথে সাথে এ দূরত্ব আরও বেড়েছে। বিশেষ করে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার পর এই দূরত্ব অলঙ্ঘনীয় হয়ে যায়।

দূরত্ব থাকলেও সংসদীয় গণতন্ত্রের দুই চাকা ছিল আওয়ামী লীগ আর বিএনপিই। কিন্তু বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করায় এ ধারায় ছেদ ঘটে। বিরোধী দলের আসনে বসে জাতীয় পার্টি। তবে তারপর থেকে সংসদীয় ধারার একটি বড় ব্যত্যয় ঘটেছে। সংসদের দুই চাকাই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ফলে এখন সংসদকে ঠিক কার্যকর বলা যায় না। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে কারা বিরোধী দলের আসনে বসবে, তা নিয়ে কৌতূহল ছিল। কারণ একাদশ জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবার মাত্র ১১টি আসনে জয় পেয়েছে। তাদের চেয়ে অনেক বেশি, ৬২ আসনে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র সদস্যরা।

চাইলে স্বতন্ত্র সদস্যরা একত্রিত হয়ে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারতেন। কিন্তু তাতে তাদের আগ্রহ দেখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত ১১ আসন নিয়েই বিরোধী দল হচ্ছে জাতীয় পার্টি। তবে জাতীয় পার্টি গৃহপালিত বিরোধী দল। যে ১১ আসনে তারা জয় পেয়েছে, তাও আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে। একই সঙ্গে বিরোধী দল এবং সরকারে থাকার মতো নজিরবিহীন ঘটনাও ঘটিয়েছে জাতীয় পার্টি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে একটা অভিনব ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এ সংসদের সব সদস্যই কোনো না কোনোভাবে সরকারি দল আওয়ামী লীগের আশীর্বাদধন্য।

তারপরও ১১ আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি কীভাবে আচরণ করে, ৬২ জন স্বতন্ত্র সদস্যই বা সংসদে কী ভূমিকা পালন করেন; তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে গোটা জাতি। নির্বাচন যেভাবেই হোক, প্রত্যাশা হলো, বিরোধী দল এবং স্বতন্ত্র সদস্যরা সংসদে সরকারের ভুল ধরিয়ে দেবে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে, সরকারের স্বার্থেই সংসদ কার্যকর ও প্রাণবন্ত হওয়াটা জরুরি। একাদশ জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হলেও সাতজন সদস্য নিয়ে সংসদ মাতিয়ে রেখেছিল। বিশেষ করে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা ও হারুন অর রশিদ বারবার সরকারের ভুল ধরিয়ে দিয়ে সংসদে উত্তাপ সৃষ্টি করেছিলেন। যেমন প্রথম সংসদ একাই মাতিয়ে রেখেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

অন্যদের কথা জানি না, দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ব্যারিস্টার সুমনের ভূমিকা দেখার জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। সোশ্যাল মিডিয়ায় সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে জনগণের নায়ক হয়েছেন ব্যারিস্টার সুমন। এই জনপ্রিয়তা পুঁজি করে সাবেক প্রতিমন্ত্রীকে প্রায় এক লাখ ভোটে হারিয়ে সংসদে এসেছেন সুমন। সোশ্যাল মিডিয়ার বিপ্লব তিনি সংসদে টেনে আনতে পারেন কি না- সেটাই দেখার বিষয়। সংখ্যাটা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ নয়। কোয়ানটিটির চেয়ে কোয়ালিটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চাইলে ব্যারিস্টার সুমন একাই সংসদ মাতিয়ে রাখতে পারেন।

যত বিতর্কই থাকুক, তারপরও সংসদীয় ব্যবস্থার পথ ধরেই বিকশিত হতে পারে গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রের পথ ধরেই আসতে পারে টেকসই উন্নয়ন।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম