বর্তমান শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা
বিজ্ঞানমনস্ক ও জ্ঞাননির্ভর সমাজ গড়তে হবে
নকশা ছাড়া যেমন কোনো স্থাপনা দাঁড় করানো সম্ভব নয় ঠিক তেমনি সমসাময়িক শিক্ষাক্রম ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড় করানো যায় না। শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষা কার্যক্রমের নীলনকশা। এর প্রণয়ন ও পরিমার্জন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ক্রমবিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। এ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে চাহিদা নিরূপণ। বর্তমান জাতীয় শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের অোগেও বেশ কয়েকটি গবেষণা পরিচালনা করা হয় এবং এর ফলাফল ও রাষ্ট্রীয় আদর্শ, জাতীয় লক্ষ্য, সমকালীন জীবনের চাহিদা এবং চলমান বিশ্বে জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতির আলোকে বিস্তারিত শিক্ষাক্রম, শিখন-শেখানো সামগ্রী ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, বর্তমান শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আগে একটি যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এর উপযোগিতা ও কার্যকারিতা যাচাই করা হয়েছে। যাচাইয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য এবং যে সব বিষয় নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল তাও পরিমার্জন ও সংশোধন করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্রম উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু ধরে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী নাগরিক তৈরি এবং কর্ম উপযোগী মানবসম্পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বর্তমান শিক্ষাক্রমে। এ শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে স্বাধীনভাবে শেখার সুযোগ, অনুসন্ধিৎসু হওয়ার সুযোগ, মুক্তচিন্তা করার সুযোগ এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার এক অপূর্ব যোগসূত্র তৈরি করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্রম উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু ধরে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী নাগরিক তৈরি এবং কর্ম উপযোগী মানবসম্পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বর্তমান শিক্ষাক্রমে। এ শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে স্বাধীনভাবে শেখার সুযোগ, অনুসন্ধিৎসু হওয়ার সুযোগ, মুক্তচিন্তা করার সুযোগ এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার এক অপূর্ব যোগসূত্র তৈরি করা হয়েছে।
যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই কোনো সমস্যা সমাধানের উপায় বের করবে এবং নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেবে। তরুণ প্রজন্মকে আরও জ্ঞানী ও দক্ষ করে তোলা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলার জন্য এ অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাকে অধিক কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখবো তারা বিজ্ঞানমনস্ক ও জ্ঞাননির্ভর সমাজ গড়ে তুলতে অনেক আগে থেকেই সে দেশের শিক্ষাক্রমকে সাজিয়েছে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, অভিজ্ঞতাভিত্তিক, সৃজনশীল চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম পাঠ্যক্রম দিয়ে। কাজেই বাংলাদেশের নব প্রবর্তিত শিক্ষাক্রম সবদিক বিবেচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয়, একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সমন্বিতভাবে অর্জিত হলে তার যোগ্যতা গড়ে ওঠে। কাজেই পাঠ্যবইসমূহ সাজানো হয়েছে বাস্তবভিত্তিক উদাহরণ এর মাধ্যমে যাতে নিজে নিজেই প্রতিটি সমস্যার সমাধান করতে পারে।
ধরা যাক সপ্তম শ্রেণির গণিত বইয়ের কথা, এই বইটির সব অভিজ্ঞতা অনুশীলননির্ভর। গণিতের বাস্তব প্রয়োগকে বিবেচনায় রেখে ব্যাখ্যামূলকভাবে একে সাজানো হয়েছে। অভিজ্ঞতা চলাকালে বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে গণিতের তত্ত্ব ও সূত্র প্রয়োগ করে প্রয়োজনে শিক্ষকের সহায়তায় বিভিন্ন ধরনের গাণিতিক সমস্যা সমাধান করবে।
যা শিক্ষার্থীদের গণিত ভীতি কমাতে সাহায্য করবে এবং না বুঝে গণিত মুখস্থ করার প্রবণতা হ্রাস পাবে। এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হলো পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের আন্তরিকতা।
অনেকেই মনে করে এ শিক্ষাব্যবস্থার সবটাই নতুন। ২০১২ সালে রচিত শিক্ষাক্রমেও বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন চালু ছিল। যেমন—পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইংরেজি ও গণিতের জ্যামিতি অংশ।
অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন ব্যবস্থায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধা বিকশিত করার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। শ্রেণির কাজে মেধাবী শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতা চর্চার সুযোগ পাবে।
পক্ষান্তরে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী শিক্ষার্থীরা মেধাবী শিক্ষার্থীর সংস্পর্শে এসে নিজেদের দুর্বলতা আবিষ্কার করবে এবং নিজ থেকেই সমাধানে সচেষ্ট হবে। কাজেই বর্তমান শিক্ষাক্রমে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সুযোগ থাকছে সৃজনশীলতা চর্চা ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরিতে অবদান রাখার।
সর্বোপরি অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনকে ফলপ্রসূ করতে হলে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, শিখন চাহিদা ও যোগ্যতা বিবেচনায় নিয়ে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। শ্রেণিকক্ষের শিখন পরিবেশ হবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, গণতান্ত্রিক ও সহযোগিতামূলক।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়তামূলক, একীভূত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিখন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখনের উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একটি উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমাদের সবার উচিত অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করা।
আমরা আশাবাদী যে, এ শিক্ষাক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন ত্বরান্বিত হবে।
লেখক: চেয়ারম্যান, শিক্ষা বিভাগ এবং ডিন, শিক্ষা বিজ্ঞান অনুষদ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/ফারুক/এএসএম