ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নতুন বছর আসুক বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৯:১১ এএম, ০১ জানুয়ারি ২০২৪

 

কাল সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে যে বছরটি কালের গর্ভে হারিয়ে গেল বাংলাদেশের মানুষের জন্য সে বছরটি ভালো কাটেনি। খেলাধুলা, রাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি- কোনো ক্ষেত্রেই বছরটি ভালো কাটেনি। ক্রিকেটে বাংলাদেশ মোটামুটি নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পেরেছে। তবে গেল বছরে বাংলাদেশ যেন ক্রিকেট খেলতেই ভুলে গেল। ভারতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যেন ক্রিকেট খেলতেই ভুলে গেল। তবে ক্রিকেটের এই দুঃসময়ের কারণ যতটা মাঠের পারফরম্যান্স তারচেয়ে বেশি মাঠের বাইরের। বাংলাদেশের দুই তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়েছে মাঠে।

ক্রিকেট আমাদের হাসায়, কাঁদায়, ঐক্যবদ্ধ করে। তবে ক্রিকেটের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে রাজনীতি ও অর্থনীতি। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে অর্থনীতি। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় দেশের অর্থনীতি দারুণ মোমেন্টাম পেয়েছিল। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলি টানেল, সাবমেরিন, স্যাটেলাইট, পারমাণবিক বিদ্যুৎ- অনেক নতুনের সাথে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

শুধু অবকাঠামো নয়; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়নেও অভাবিত উন্নয়ন হয়েছে। রিজার্ভ, জিডিপি, মাথাপিছু আয়; সব সূচকেই বাংলাদেশের উন্নতি ছিল বিস্ময়কর। তবে গেল বছরে অর্থনীতির গতি ধাক্কা খায় মারাত্মকভাবে। ধাক্কার শুরুটা হয়েছিল কোভিড আমলে। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই ধাক্কা দিয়েছিল কোভিড। তবে নানান উদ্ভাবনী চেষ্টায় কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেই ঘুরে দাঁড়ানোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আসলে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই টালমাটাল করে তুলেছে।

জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। ডলারের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ফলে আমদানী পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ কমতে কমতে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। অর্থনীতি সামাল দিতে অনেক দিন পর আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

তারপরও পুরোটা সামাল দিতে পেরেছে এমনটা বলা যাবে না। এমনিতে অর্থনীতি, রিজার্ভ, জিডিপি এসব টার্মে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। কিন্তু ঘুরেফিরে অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাবটা সাধারণ মানুষের ঘাড়েই পড়ে। অর্থনীতির দুরবস্থায় মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটে পৌঁছেছে। ফলে জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে গেছে। সরকার নানাভাবে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে বটে, তবে দ্রব্যমূল্যের হাহাকার নিয়েই বিদায় নিয়েছে ২০২৩ সালটি।

আমাদের সবকিছু আসলে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। গেল বছরে রাজনীতিও ছিল টালমাটাল। বাংলাদেশের রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অনেকদিন ধরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। গত জুলাই থেকে তারা সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরু করে।

বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবেই ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। কিন্তু গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের দিনে বিএনপি আবার সহিংসতার রাজনীতিতে ফিরে যায়। পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, অ্যাম্বুলেন্স ভাংচুর, হাসপাতালে হামলা, সাংবাদিকদের নির্বিচারে মারধোরের ঘটনায় বদলে যায় বাংলাদেশের রাজনীতি।

সহিসংসতার ঘটনায় দায়ের করা নানা মামলায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির অধিকাংশ সক্রিয় নেতা এখন হয় কারাগারে নয় পলাতক। ২৮ অক্টোবরের পর থেকেই বন্ধ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। ফলে বিএনপি এখন কার্যত ভার্চুয়াল রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। ২৮ অক্টোবরের পর থেকেই বিএনপি হরতাল-অবরোধ দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে গোপন জায়গা থেকে ভিডিও কনফারেন্সে ডাকা এসব কর্মসূচিতে জনগণের কোনো সাড়া নেই।

গাড়িতে আগুন দিয়ে, মানুষ পুড়িয়ে, ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ মেরে তারা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাইছে। হরতাল-অবরোধ-সহিংসতায় কাজ না হওয়ায় বিএনপি এখন সর্বাত্মক অহযোগের ডাক দিয়েছে। কিন্তু হরতাল-অবরোধের মত অসহযোগেও কোনো সাড়া মেলেনি। সর্বাত্মক অসহযোগ হিসেবে বিএনপি সরকারের নির্দেশ না মানার জন্য সরকারি কর্মচারিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, নির্বাচনী দায়িত্ব পালন না করতে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের আহ্বান জানিয়েছে।

ভোটকেন্দ্রে না যেতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের আহবান যেন কেউ খাজনা-ট্যাক্স, ইউটিলিটি বিল না দেয়, ব্যাকে লেনদেন না করে, টাকা না রাখে, মামলায় হাজিরা দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এখন পর্যন্ত অসহযোগের ডাকে কোনো সাড়া মেলেনি। এমনকি বিএনপির নেতাকর্মীরাও তাদের দলের ডাকা অসহযোগের ডাকে সাড়া দেয়নি। আসলে এই ডাকে সাড়া দেয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ ইউটিলিটি বিল না দিলে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির লাইন কেটে দেয়া হবে। তখন এর দায়িত্ব কে নেবে?

বিএনপি যখন নামকাওয়াস্তে একদফা আন্দোলন আর অসহযোগ চালিয়ে যাচ্ছে, তখন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনের দিকে। বিএনপি না এলেও নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৭টি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। ৩০০ আসনে ১ হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। বিএনপি না আসায় নির্বাচন নিয়ে উৎসাহে ভাটা পড়েছে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ বজায় রাখতে আওয়ামী লীগ নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ফলে অনেক আসনেই নির্বাচন জমে উঠেছে। পরপর দুটি নির্বাচন নাকে তেল দিয়ে জিতে যাওয়া আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের এখন ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

বিদায়ী বছরটি যেমনই হোক, আমাদের প্রত্যাশা নতুন বছরটি আমাদের সবার জন্য ভালো যাবে। শুরুতে যেমন ক্রিকেটের কথা বলছিলাম। বিশ্বকাপ খারাপ কাটলেও নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশের দারুণ পারফরম্যান্স আমাদের আশাবাদী করেছে। প্রথমবারের মত নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ওয়ানডে এবং টি-২০ ম্যাচ জয়ের পর সবাই আশায় বুক বাঁধছেন। এই পারফরম্যান্সটা আরো বেশি আশা জাগানিয়া, কারণ এক মুশফিক ছাড়া পঞ্চপাণ্ডবের কেউ নেই দলে। তরুণ শান্তর নেতৃত্বে আমরা নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি।

অর্থনীতির দুঃসময় শিগগিরই কেটে যাবে, এমন কোনো আশাবাদ নেই। তবে বছরের শেষ দিকে এসে যেন টানেলের শেষ প্রান্তে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। অল্প হলেও রিজার্ভ বাড়ছে। আওয়ামী লীগ ঘোষিত ইশতেহারে ১১টি অগ্রাধিকারের প্রথমটিই হলা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। সরকার যদি সর্বোচ্চ আন্তরিকতা এবং চেষ্টা দিয়ে এই একটি কাজ করতে পারে, তাহলে মানুষ স্বস্তি পাবে।

সবকিছু যেভাবে চলছে, তাতে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। তবে নির্বাচনের পর কী হবে, তা নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত। শঙ্কাটা বিএনপি নিয়ে নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে। বিদায়ী বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ভিসা নীতি দিয়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সরকার সব চাপ উপেক্ষা করে তাদের মতই এগিয়েছে।

তবে বছরের শেষ দিকে মার্কিন তৎপরতা কমে গেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপও দৃশ্যমান নয়। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণূ না হলে নতুন করে মার্কিন চাপ বাড়তে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ভোটারদের কেন্দ্রে আনা এখন আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ উৎড়াতে পারলে আওয়ামী লীগের জন্য সব সমস্যা সামাল দেয়া সহজ হবে।

৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসছে এটা অবধারিত। নতুন সরকারের কাছে চাওয়া তারা যেন অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নেয়। নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতি কমানো, সুশাসন নিশ্চিত করা, অর্থপাচার বন্ধ করা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা। সবার আগে দ্রুব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। পেটে খেলে পিঠে সয়। রাজনীতি নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম। সবাই চায় ঠিকঠাকমত খাওয়া আর নিরাপদ-নিশ্চিন্ত জীবন।

আজ সকালের সূর্য নতুন যে বছরের বারতা নিয়ে এলো, আশা করি বছরটি সবার ভালো কাটবে।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/এমএস