ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সাড়া মিলবে কি অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে?

মোস্তফা হোসেইন | প্রকাশিত: ০৯:৩৩ এএম, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩

সরকার বিরোধী আন্দোলনে হরতাল-অবরোধের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে অসহযোগ। আহ্বান জানানো হয়েছে, প্রশাসন যেন সরকারের নির্দেশ পালন না করে, সাধারণ মানুষ যেন খাজনা- ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়। গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিলও যেন না দেয়। এমনকি যারা নির্বাচন পরিচালনা কাজে নিয়োজিত তারাও যেন কাজ বন্ধ করে দেয়।

অসহযোগ আন্দোলনে এসব কথাই থাকে। প্রশ্ন আসে রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি কি অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে? আমরা এই প্রসঙ্গে অতীতের উদাহরণকে সামনে আনতে পারি।

মহাশক্তিধর ইংরেজ সরকারের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিলো মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন। ১৯১৮ সালে মহাত্মা গান্ধী দেখিয়ে দিয়েছিলেন ভারতবর্ষের গরিব কৃষকরাও কীভাবে ব্রিটিশ শাসকদেরও নতি স্বীকার করতে বাধ্য করাতে পারে। বিহারের চম্পারণ ও গুজরাটের খেদায় মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ সরকারকে অসহযোগিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

মহাত্মা গান্ধীর সেই অসহযোগ আন্দোলন, সত্যাগ্রহ কিংবা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ জীবিত আছে বলে জানা নেই। কিন্তু ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনের সেরাকর্মী,অংশগ্রহণকারী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই জীবিত আছেন। রাজনীতির চূড়ান্ত আন্দোলন এই অসহযোগ যে কেমন ভূমিকা রাখে আর কেমন নেতা হলে সেই ডাক দিতে পারেন, তা বোধ করি একাত্তরের সেই দিনগুলোর প্রতিটি অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী ভালো করে জানেন।

মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনকালে ভারতবর্ষ দারিদ্র্যনিপীড়িত অঞ্চল ছিলো। অধিকাংশই ছিলো গরিব কৃষক শ্রেণির। সরকারের অর্থনৈতিক ভরসাস্থলও অধিকাংশই কৃষক সমাজই ছিলো। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের অর্থনৈতিক সঞ্চালনার মূলসূত্র ছিলো এই গরিব মানুষগুলো। কিন্তু প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করায় গত শতাব্দীর দুই এর দশকের দ্বারপ্রান্তে সাধারণ মানুষ খাদ্য উৎপাদনকে তাদের কৃষি ব্যবস্থায় প্রধান হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার চাইলো তারা নীল চাষ করবে, তামাক ও তুলা চাষ করবে। কৃষকদের তখন চোখেমুখে সর্ষে ফুল দেখার মতো অবস্থা।

ওই গরিব কৃষকদের দুর্যোগকালে অনেকটা ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন মহাত্মা গান্ধী। ওই গরিব মানুষগুলোকে নিয়ে তিনি ডাক দিলেন ব্রিটিশ সরকারের আইন অমান্য করতে হবে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানালো মহাত্মা গান্ধীকে। ঈর্ষণীয় ক্ষমতার মালিক ব্রিটিশ সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলো। চুক্তি করতে বাধ্য হলো, যাতে কৃষকরা নিজেদের ইচ্ছা মতো ফসল উৎপাদন করতে পারবে। দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকায় কর মওকুফ করা হলো। যেসব জমি সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিলো সেগুলোও ফেরৎ দেওয়া হলো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এত বড় পরাজয় বোধ করি এর পর আর হয়নি।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনের প্রসঙ্গ যদি আসে, তাহলে স্পষ্ট হয়ে যাবে, আসলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির অস্তিত্বই সন্দেহের দোলায় দুলতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বললেন, খাজনা বন্ধ করে দিতে হবে,পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোনো টাকা পয়সা বাইরে যাবে না। বললেন, রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে। প্রশাসন চললো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, রেডিও টেলিভিশন গণমাধ্যম সব চলে গেলো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীনে। বঙ্গবন্ধু কার্যত হয়ে গেলেন জাতির প্রতীক হিসেবে।

ফল সম্পর্কে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন আছে কি? মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারকে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য করেছিলো। এবং বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন একটি স্বাধীন দেশের জন্মকে নিশ্চিত করেছিলো।

দুটো আন্দোলনের মিল হচ্ছে-দুটোই ছিলো দেশের নাগরিকদের স্বার্থ এবং অধিকার রক্ষায় এবং জনমানুষই ছিলো আন্দোলনের প্রধান শক্তি। ইতিহাসে দুই মহানায়কই নিজ নিজ দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হলেন। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালি জাতির জনকই হলেন না, তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিও। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি হচ্ছে নেতৃত্ব। দক্ষ এবং সৎ নেতৃত্ব জনসম্পৃক্ততা তৈরি করে,জনস্বার্থ থাকলে আন্দোলন ধাপে ধাপে অসহযোগ আন্দোলনের মতো চূড়ান্ত পরিবেশ তৈরি করতেও সক্ষম হয়।

এবার দেখা যাক ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অসহযোগ আন্দোলনের ডাক এর অবস্থানগত দিক। বিএনপির বিলাত নিবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন এই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য। রাজনীতিবিদ হিসেবে ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু সেই পথ যদি হয় অসম্ভব কোনো মাধ্যমে তাহলে ফলাফল নিয়ে কথা বলার সুযোগ থেকে যায়।

বিএনপির অসহযোগ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে প্রশ্ন আসে তাদের এই আন্দোলনের পেছনে উদ্দেশ্য কি? তারা ক্ষমতা বদলের কথা বলছে,বর্তমান সরকারকে পদত্যাগের কথা বলছে। গত ১৫ বছর ধরে তাদের মূল দাবিই ছিলো দুটো। যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন আসে এই দাবির সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা কতটুকু। বিএনপি কি জনগণকে বোঝাতে পেরেছে যে, আওয়ামী লীগের চেয়ে তারা বেশি উপযুক্ত?

তারা কি জনগণকে বোঝাতে পেরেছে যে, আওয়ামী লীগে তাদের চেয়ে দুর্নীতিবাজ বেশি কিংবা তারা দুর্নীতিমুক্ত ছিলো আওয়ামী লীগ আগাগোড়া দুর্নীতিবাজ? কিংবা এটা কি বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, তারা আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি উন্নয়ন ও জনস্বার্থ বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলো? কিংবা জনগণ কি তাদের কথা আস্বস্ত হয়েছে-বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের চেয়ে অধিক উন্নয়ন করতে সক্ষম হবে? সন্ত্রাস থাকবে না একবারেই।

দীর্ঘ ১৫ বছরের আন্দোলনের ফলই এসব প্রশ্নের জবাব দিতে যথেষ্ট। তারপরও চলমান আন্দোলনও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এবার নির্বাচনী আন্দোলনের শুরুটা মূলত ২৮ অক্টোবর থেকে। সেদিনই তারা হত্যা করলো একজন পুলিশকে। রাষ্ট্রের ভরসাস্থল বিচার ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানা হলো প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা চালিয়ে। এর পরিণতিটা কী হলো? ২৮ অক্টোবরের আগে পর্যন্ত বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের যে আস্থাটুকু ছিলো তাও ক্রমহ্রাস হতে থাকলো।

এরপর হরতাল অবরোধ নামে তারা আন্দোলনকে চালানোর চেষ্টা করলো। জনগণ সাড়া দিলো না। অবরোধ হরতাল নামে যে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হচ্ছে তার কোনোটাতেই জনগণ সাড়া দেয়নি। কড়া হরতালের সময়ও ঢাকা মহানগরীতে যানজটে আটকে থাকে মানুষ। হুটহাট দুয়েকটা বাসে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে আন্দোলনের জানান দেয় তারা। ফলে আন্দোলনের কথা জানতে গেলে মানুষকে এখন পুরনো ভিডিওর সাহায্য নিতে হয়।

সবশেষে চরম নাশকতা দেখা দিয়েছে দেশে। রাতের অন্ধকারে রেলে আগুন দেওয়া, ফিসপ্লেট খুলে ফেলা এমনকি বিভি্ন্ন স্থানে রেললাইন কেটে দিয়ে মানুষকে হত্যার মুখে ঠেলে দেওয়ার কাজটি চলতে শুরু করেছে। ১৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও-এ ট্রেনের আগুনে ৩ বছরের শিশু ইয়াসিন ও তার মা নাদিয়ার দগ্ধ হওয়ার সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে নাশকতার প্রতি জনধীক্কার তীব্রতর হয়েছে। বিএনপি যতই অস্বীকার করুক না কেন, মানুষ বিশ্বাস করছে এসব নাশকতা আন্দোলনকারীদেরই কাজ। একই ঘটনায় ৪ যাত্রীর মৃত্যুর পর কি আন্দোলনের প্রতি মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি করেনি? গাজীপুরে রেললাইন কেটে ফেলার পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে,তারা এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। যেমন বিএনপি সমর্থকরা অন্যসব নাশকতার জন্য সরকারকেই দায়ি করে।

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতা বিলাত প্রবাসী তারেক রহমান ডাক দিলেন অসহযোগ আান্দোলনের। ঢাকায় অবস্থানকারী নেতা রুহুল কবীর রিজভী সাংবাদিকদের মাধ্যমে কর্মসূচির কথা জানালেন। মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের আজ থেকে আদালতে হাজিরা দেওয়া থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে ভোট গ্রহণে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান ।

এ ছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারকে সব ধরনের কর, খাজনা, পানি, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল দেওয়া বন্ধ করে দিতে অনুরোধ জানানো হয়।’

প্রথম আসা যাক, তাদের নেতা-কর্মীরা এই নির্দেশ কতটা মান্য করবেন। মামলা মোকাবিলা করার জন্য তাদের আদালতে হাজিরা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এই নির্দেশনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সামিল। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বিচার ব্যবস্থাকে অস্বীকার করার এখতিয়ার কারো নেই। সেক্ষেত্রে নগণ্যসংখ্যক নেতা-কর্মী এই নির্দেশ মানতেও পারে। আত্মগোপনে থেকে ঝক্কিঝামেলা থেকে বাঁচতে কেউ কেউ চেষ্টা করতে পারে। অধিকাংশই এই নির্দেশ মানবে না।

তারা আহ্বান জানিয়েছেন, নির্বাচনের কাজে দায়িত্বপ্রাপ্তরা যাতে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকেন। প্রশাসন যেন সরকারের নির্দেশ পালন না করে। স্পষ্ট দেখা যায়-তাদের আন্দোলনে এমন কোনো ভিত তৈরি করতে পারেনি যাতে করে প্রশাসন সরকারের নির্দেশ অমান্য করে বিলাতপ্রবাসী নেতার নির্দেশ বাস্তবায়ন করবে। মহাত্মা গান্ধী কিংবা বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন নয় ১৯৯৬ সালে যে জনতারমঞ্চ হয়েছিলো, সেই অবস্থার কাছাকাছি যাওয়ার মতো অবস্থানও কি আছে বিএনপির? সুতরাং প্রশাসনকে অসহযোগিতা করার যে আহ্বান জানানো হয়েছে তা যে অবাস্তব হিসেবে চিহ্নিত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তারেক রহমান আহ্বান জানিয়েছেন, কেউ যেন গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, ইত্যাদি পরিশোধ না করে। এই নির্দেশনাটুকু সাধারণ মানুষই শুধু নয় তাদের দলীয় কর্মীরাও পালন করবে না। তাদের সামনে নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের গ্যাসলাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। প্রায় ২ লাখ টাকা গ্যাস বিল বাকি থাকায় তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ তার বাড়িতে গ্যাস সঞ্চালন বন্ধ করে দিয়েছিলো। বিএনপি কর্মীরা বোধ হয় ভুলে যায়নি,গয়েশ্বর বাবুর রান্নাঘরে চূলা বন্ধ হওয়ার কথাটি।

অসহযোগ আন্দোলন হয় মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। যেমনটা হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং ব্রিটিশ ভারতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে। সেখানে নিয়ামক শক্তি থাকে জনগণ। এই মুহূর্তে বিএনপির ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে সেই অবস্থা কি আছে? এই প্রশ্নের জবাবের ওপরই নির্ভর করবে অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস