ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাজারে কৃত্রিম সংকট প্রতিরোধে ইসলামি শিক্ষা

মাহমুদ আহমদ | প্রকাশিত: ০৯:৪৪ এএম, ২২ ডিসেম্বর ২০২৩

ইসলামি আইনশাস্ত্রবিদদের মতে, ইসলামি পরিভাষায় মজুতদারি হচ্ছে, খাদ্যশস্য মজুত করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা। অতঃপর মূল্যবৃদ্ধি পেলে তা বিক্রি করে প্রচুর পরিমাণে লাভবান হওয়া। ইসলাম মানবতাকে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রদান করে যা সব বৈষম্য ও অসমতা দূরীভূত করে ইনসাফভিত্তিক এক অনন্য সমতার সমাজ কায়েমের পথ নির্দেশ করে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজের কোনো ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার ক্ষুণ্ণ করার এবং কারও স্বার্থ বিনষ্ট করার কোনো রূপ সুযোগ নেই।

এ অর্থনৈতিক মতাদর্শে পরিশ্রম করে সুখী সুন্দর জীবন গড়ার সুযোগ নিশ্চিত করে দেয়। ফলে মানবিক মূল্যবোধ সুদৃঢ় বুনিয়াদ লাভ করে। পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেনের মধ্যে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বজায় রাখার স্বার্থে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ইসলাম নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য।

ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্য উৎসাহিত করতে যেমন বিভিন্ন রকম জাগতিক ও পারলৌকিক প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে তদ্রুপ বিভিন্ন ধরনের নৈরাজ্যকর ও অবাঞ্ছনীয় পদক্ষেপ প্রতিরোধে জাগতিক এবং পারলৌকিক শাস্তিও ঘোষণা করেছে। পণ্যসামগ্রী জমা রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সমাজের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ও অতি মুনাফা অর্জন করাকে দণ্ডণীয় কাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করছি যে পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মানুষের ক্রয়সীমার ঊর্ধ্বে। অধিক মুনফালোভীরা তাদের গুদামে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু খাদ্যদ্রব্য অবৈধ, অনৈতিকভাবে মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। আগেও আমরা দেখেছি বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার পর গুদাম থেকে বস্তায় বস্তায় পচা পেঁয়াজ নদীতে ফেলার চিত্রও মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে। যদিও এদের সংখ্যা কম কিন্তু বাজার ব্যবস্থা এই কম সংখ্যক লোকই নিয়ন্ত্রণ করছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যতম সম্মানজনক কাজ এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যকে ইসলাম সব সময় উৎসাহিত করে। কিন্তু খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। দুনিয়া ও আখিরাতে মজুতদারির ভয়াবহ শাস্তির কথা কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সোনা রুপা (ধন-সম্পদ) জমা করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না তাদের জন্য আপনি যন্ত্রণাদায়ক আজাবের সংবাদ দিন। সেদিন এসব ধন-সম্পদ আগুনে গরম করা হবে। অতঃপর তা দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেওয়া হবে। (বলা হবে), তোমরা যা কিছু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে এগুলো তো সেসব ধন-সম্পদ। সুতরাং তোমরা যা কিছু জমা করে রেখেছিলে, এখন তার স্বাদ আস্বাদন করো’ (সুরা আত তাওবা: ৩৪-৩৫)।

অপর এক স্থানে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যাতে ধন-সম্পদ শুধু বিত্তবানদের মধ্যে পুঞ্জীভূত না হয়’ (সুরা আল হাশর: ৭)। ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখাকে অর্থনৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কেননা এতে ধন-সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণ ও বণ্টন হওয়ার পরিবর্তে শ্রেণি ও সম্প্রদায় বিশেষের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে আর সাধারণ মানুষ হয় নিঃস্ব ও দরিদ্র। লেনদেনেও স্থবিরতা দেখা দেয় এবং উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

অনুরূপভাবে পণ্যসামগ্রী আটকে রাখার ফলেও একই রকম সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং সম্পদ পুঞ্জীভূতকারী এবং পণ্য মজুদকারি সমান অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহতায়ালা তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে অস্বাভাবিক ও অধিক মূল্যে বিক্রি করার জন্য গুদামজাত করে রাখাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘ইহতিকার’ বা মজুতদারি বলা হয়। আল-হিদায়া প্রণেতার ভাষায় ‘ইহতিকার বা মজুতদারি হচ্ছে, খাদ্যসামগ্রী ক্রয় করে মূল্যবৃদ্ধির আশায় গুদামজাত করা।’ আল্লামা ইমাম ইবনে আবেদীন শামীর বলেন, ‘ইহতিকার হচ্ছে, খাদ্যসামগ্রী বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে উচ্চমূল্যের জন্য চল্লিশ দিন পর্যন্ত আটক রাখা’।

অর্থাৎ যেসব জিনিস আটকে রাখলে বা মজুত করলে সর্বসাধারণের সীমাহীন কষ্ট ও ক্ষতি হয়। মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘মজুতদার খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি; যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায় তাহলে চিন্তিত হয়ে পড়ে, আর যদি মূল্য বেড়ে যায় তাহলে আনন্দিত হয়’ (মিশকাত)। মহানবি (সা.) আরও ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাজারে পণ্যের অভাবের সময় পণ্য মজুত করে রাখে সে বড় পাপী’ (মুসলিম)। পণ্যসামগ্রী মজুত করে মূল্যবৃদ্ধি অথবা অধিক মুনাফা করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। হাদিস শরিফে মজুতদারকে নিকৃষ্ট, অভিশপ্ত বলে অভিহিত করা হয়েছে।

মজুতদার সেই ব্যক্তি যে মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করে এর মূল্যবৃদ্ধি করার লক্ষ্যে গোপনীয় স্থানে আটক করে রাখে। ব্যবসায় এটা অত্যন্ত জঘন্য পাপ ও এক প্রকার শোষণ হিসেবে চিহ্নিত। অত্যধিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে সাধারণত মজুতদারির মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। ইসলাম একে একটি অনৈতিক, ঘৃণ্য ও নিষিদ্ধ কাজ হিসেবে অভিহিত করে।

পণ্যসামগ্রী মজুত করার কারণে জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা ও কষ্ট-দুর্ভোগ বেড়ে যায়, অস্বাভাবিক হারে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি পায় এবং মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লাভের সুযোগ ঘটে। এজন্য মজুতদার ও অধিক মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে হাদিসে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে এদের পাপী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পণ্যদ্রব্য আটক করে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী অবশ্যই পাপী’ (মিশকাত)।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুতকরণ সম্পর্কে ঘোষণা করেছিলেন, “আমাদের বাজারে কেউ যেন পণ্য মজুত করে না রাখে। যাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ আছে তারা যেন বহিরাগত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সব খাদ্যশস্য কিনে তা মজুত করে না রাখে। যে ব্যক্তি শীত-গ্রীষ্মের কষ্ট সহ্য করে আমাদের দেশে খাদ্যশস্য নিয়ে আসে সে উমরের মেহমান। অতএব সে তার আমদানির খাদ্যশস্য যে পরিমাণে ইচ্ছা বিক্রি করতে পারবে, আর যে পরিমাণে ইচ্ছা রেখে দিতে পারবে” (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)।

ইমাম গাজ্জালির (রহ.) মতে, মজুতদারি হারাম। তিনি এর কারণ উল্লেখ করে বলেন, এতে আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট ও অনিষ্ট সাধিত হয়। কোনো ব্যক্তি সব শস্য ক্রয়পূর্বক আটক করে রাখলে অবশিষ্ট সবাই এ থেকে বঞ্চিত থাকবে। এ উদ্দেশ্যে খাদ্যশস্য খরিদ ও মজুত করে রাখা পাপ।

মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয়, আর মজুতদার হয় অভিশপ্ত।’ আরও বলা হয়েছে, ‘বিভ্রান্ত লোকই শুধু মজুতদারি করে’ (ইবনে মাজা)। নবি করিম (সা.) মজুতদারকে কঠোর শাস্তি প্রদানের কথা ঘোষণা করেছেন, ‘যে মুসলিম সম্প্রদায়ের খাদ্যদ্রব্য চল্লিশ দিন যাবত মজুত করে রাখবে আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দিয়ে শাস্তি দেবেন’ (ইবনে মাজা)। মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ী মজুতদারদের সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই। মহানবি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ রাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মজুত করবে তার সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’

নবিজি (সা.) আরো বলেছেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুত রাখে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট’ (মিশকাত)। তাই দ্রব্যমূল্য মজুত রেখে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেওয়া অত্যন্ত গোনাহের কাজ। এই পাপ কাজ করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।

আমি যদি ব্যবসায়ী হই তাহলে আমাকে খেয়াল রাখতে হবে আমার দ্বারা যেন কোনো ধরনের অবৈধ কাজ সংঘটিত না হয়। এছাড়া আমি যে কাজই করি না কেন আমার দ্বারা যেন কারও কোনো ক্ষতি না হয় সে খেয়ালও রাখতে হবে।

আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষানুসারে জীবন পরিচালার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস