ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে জাতিকেই ধ্বংস করতে চেয়েছিল পাকিস্তান

ফারাজী আজমল হোসেন | প্রকাশিত: ১০:৩৭ এএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। জাতির স্বর্ণ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করা ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। প্রতি বছরের মতো বাংলাদেশে এবারও স্মরণ করা হচ্ছে বাঙালি জাতির শহীদ কৃতী সন্তানদের।

সশস্ত্র যুদ্ধ শেষে আত্মসমর্পণের আগে, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রায় সব প্রথম শ্রেণির বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ছক আগেই তৈরি হয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইটে'র শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। তাদের মদত জোগায় দেশীয় রাজাকার, আলবদররা। পাকিস্তানিরা চেয়েছিল বাঙালি জাতির মেরুদণ্ডটাই ধ্বংস করে দিতে। বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল গণহত্যারই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর নির্দেশে সামরিক কর্মকর্তা রাও ফরমান আলীই রচনা করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের আসল ছক। পরে অস্বীকার করলেও তার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরিতে পাওয়া গেছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী এবং সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল আলবদর বাহিনী। তাদের সহযোগিতায় পুরো বাংলাদেশ হয়েছিল বদ্ধভূমি। রাজধানী ঢাকার বাইরেও পেশাজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়। আলবদর ও রাজাকাররা চিনিয়ে দেয় বাংলার কৃতী সন্তানদের।

অপারেশন সার্চলাইট শুরু পর থেকেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলেও নৃশংসতা চরম পর্যায়ে পৌঁছায় ১৪ ডিসেম্বর। সেদিন রাতে একযোগে বহু বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়।

বাংলাপিডিয়ার হিসাব বলছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এক হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ঢাকা মহানগরীর ১৪৯ জন বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছিলেন। বিবিসি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ওপর একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের প্রতিবেদনে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘পরিকল্পনা ঠিক কী করে করেছে, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী- সারাদেশের শহরে এবং গ্রামে তাদের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার বাসা থেকে আলবদর বাহিনীর চিফ এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান খান এবং অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের উপস্থিতিতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে।

এরপর দুপুর ১টার দিকে সেন্ট্রাল রোডের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে। সন্ধ্যায় কায়েতটুলির বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকে। এরপর একে একে বহু বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, ফজলে রাব্বী, আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের মতো শতাধিক বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি হিংস্রতার শিকার হন।

বিভিন্ন গবেষণার উঠে এসেছে, সেদিন প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে ধরে চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য স্থানে অবস্থিত নির্ঘাতন কেন্দ্রে নেওয়া হয়। সেখানে তাদের ওপর বীভৎস নির্যাতন চালানোর পর নৃশংসভাবে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়।

ঢাকার বাইরেও চলে কৃতী সন্তানদের হত্যা করার পালা। ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয় বুদ্ধিজীবীদের। পরাজয় নিশ্চিত জেনেই পাকিস্তানি সেনা বাঙালির মেরুদণ্ড সেদিন মাটিতে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাঙালি জাতি যাতে কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেই ষড়যন্ত্রে শামিল হয়েছিল আলবদর আর রাজাকাররাও।

অথচ ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় সেনা ও মহান মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য লড়াইয়ের কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছিল পাকিস্তান। খান সেনাদের বিরুদ্ধে জয় তখন ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা। সেদিনই ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে এক বার্তায় বলেছিলেন, ‘আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার ক্যান্টনমেন্টও এখন কামানের গোলার আওতায়। সুতরাং আপনারা আত্মসমর্পণ করুন। আত্মসমর্পণ না করলে নিশ্চিত মৃত্যু। যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে এবং তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।’

সেদিনই বিকেলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী যুদ্ধবিরতির জন্য প্রস্তাব অনুমোদন করেন। এরপর ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠায়। দিল্লিতে ভারতের জাতীয় সংসদে ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, পাকিস্তান আগেভাগে আক্রমণ করে যে ফায়দা লুটবে বলে, আমরা আশা করেছিলাম তা হয়নি। ওদের সব মতলব ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে বিজয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বিজয় এখন হাতের মুঠোয়। কাশ্মীরেও ভারতীয় বাহিনী বহু পাকিস্তানিদের ঘাঁটি দখল করেছে। পাকিস্তানি বাহিনী দুই রণাঙ্গনেই চরমভাবে মার খাচ্ছে তার বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে, ভারত আত্মসমর্পণের বিষয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিল।

১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রও নিশ্চিত করে, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মানতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করেছেন। ফলে আত্মসমর্পণের রাস্তা অনেকটাই প্রস্তুত ছিল। আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির মধ্যেই হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবীদের।

১৪ ডিসেম্বরের কালোরাতকে জয় করেই ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে লুণ্ঠিত হয় ৩ লাখ নারীর সম্ভ্রম। লঙ্ঘিত হয় মানবাধিকার। গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনা। অথচ আজও তারা সেই গণহত্যার জন্য অনুতপ্ত নয়।

দেশীয় রাজাকার ও আলবদররা সেদিন বাংলা মায়ের কৃতী সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি এখন প্রমাণিত সত্য। শত শহীদের রক্তে রাঙা বাংলাদেশের মাটিতে এখন ফের তারা বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। স্বাধীনতা লাভের ৫০ বছরেরও বেশি সময় পার হলেও বুদ্ধিজীবীদের বদ্ধভূমিতে তারা নতুন নতুন নামে, নতুন নতুন চেহারায় ফের স্বদেশের মাটিকে রক্তাক্ত করতে চাইছে। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে বিভিন্ন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও ঘাতকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বিএনপি। তাই তাদের পরাস্ত করার শপথ নেওয়াই হবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায়। সেইসঙ্গে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় ও পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়াটাও হবে প্রতিটি বাঙালির কর্তব্য।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস