ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল: আপন আলোয় আলোকিত

তাপস হালদার | প্রকাশিত: ০২:১৩ পিএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩

সায়মা ওয়াজেদ, যিনি পুতুল নামে সমধিক পরিচিত। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্রী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার কন্যা ও বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর এম ওয়াজেদ আলীর কন্যা। আপন কর্মদক্ষতায় নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্বের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের মেধা, মনন, প্রতিভা বিকাশে কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বিকাশে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তার কল্যাণেই দেশের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা সমাজের মূলস্রোত ধারায় আসার সুযোগ পেয়েছে। তিনি প্রমাণ করেছেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা সুযোগ পেলে তারাও মেধা-মনন দক্ষতা দিয়ে সমাজে সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতিকে নিয়েই ভাবি।’ বঙ্গবন্ধুর মতোই তাঁর পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের মানুষের জন্য কাজ করা স্বভাবজাত ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে প্ল্যাটফরম কোনো মুখ্য নয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্য যে যেথায় আছেন, সেখানে বসে মানুষের জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সু্যোগ্য দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিস্টিক শিশুদের মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

একসময় সমাজে অটিস্টিক শিশুদের অবহেলার চোখে দেখা হতো। তাদের পিতা-মাতাকেও বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হতে হতো, অপয়া আখ্যা শুনতে হতো। বাবা-মায়েদের সমাজে মুখ দেখানোই দায় হয়ে পড়তো। সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সেই সমাজটাকেই বদলে দিয়েছেন। মায়ের মমতা নিয়ে তিনি অটিস্টিক শিশুদের পাশে দাঁড়িছেন। তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিশেষ গুণগুলো তুলে এনেছেন। অটিস্টিক শিশুরা এখন আর সমাজের বোঝা নয়, সম্পদে পরিণত হয়েছে।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক, ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে স্নাতকোত্তর এবং ২০০৪ সালে স্কুল সাইকোলজির ওপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি অর্জন করেন। ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের ওপর বিশেষ গবেষণা করেন। তার এই গবেষণা কর্ম ফ্লোরিডার একাডেমিক অব অটিয়ন্স কর্তৃক শ্রেষ্ঠ গবেষণা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বাংলাদেশে প্রথম অটিজম নিয়ে কাজ শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই কাজের প্রশংসা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। তারই উদ্যোগে ২০১১ সালের ২৫ জুলাই ঢাকায় প্রথমবারের মতো ‘Autism Spectrum disorders and developmental disabilities in Bangladesh and South Asian’ এর আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১ দেশের অংশগ্রহণে ‘ঢাকা ঘোষণা’ গৃহীত হয়। গঠিত হয় ‘South Asian Autism Network(SAAN)’। যার সদরদপ্তর বাংলাদেশে করা হয়। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতের অটিজম আন্দোলনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি, পাকিস্তান পার্লামেন্টের স্পিকার ফাহমিদা মির্জা, শ্রীলঙ্কার ফার্স্ট লেডি ইনিবোংবাং ও মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্টের স্ত্রী ইহাবসহ সদস্য দেশগুলোর উচ্চপদস্থ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অটিজম ও স্নায়ু বৈকল্য বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির চেয়ারম্যান। তার প্রচেষ্টায় সংসদে পাস হয় ‘নিউরোডেভলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি’ ট্রাস্ট অ্যাক্ট-২০১৩। বাংলাদেশে অটিজম সম্পর্কে কাজের অগ্রগতি অভাবনীয়। ১৪টি মন্ত্রণালয় নিয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় টাস্কফোর্স। সমাজ কল্যাণ, শিক্ষা মন্ত্রাণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ ৮ টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ২০১৩ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য সেবার বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যারেলে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১৪ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ‘হু অ্যাক্সিলেন্স’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটিজম স্পিকস এর পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করেন। অটিজম নিয়ে কাজ করার স্বীকৃতি স্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত ‘ফাইভ অন ফ্রাইডে’ নামক জরিপে বিশ্বের ১০০ জন সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের তালিকায় স্থান করে নেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করছেন। ২০১৬ সালে প্রতিবন্ধীদের ডিজিটাল ক্ষমতায়নের জন্য ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডের সভাপতিও নির্বাচিত হন। অটিজম বিষয়ক কাজের পরিধিকে আরো ব্যাপক করতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ নামে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।

অটিজম বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের পরামর্শে সরকার প্রতিবন্ধীদের উন্নতিকল্পে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দক্ষ-অভিজ্ঞ প্রশিক্ষিতদের তত্ত্বাবধানে বিশেষ কর্মসূচির ব্যবস্থা, খেলাধুলা, শরীর চর্চা, বইপড়া, প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষ চাহিদা পূরণ, শারীরিক বিকলাঙ্গ শিশুদের বিশেষ ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং তাদের শারিরীক মানসিক সুস্থতার জন্য সরকার বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুলে ভর্তির অবকাঠামোগত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, ভাতা ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা,অটিজম কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপিসহ অন্যান্য চিকিৎসা প্রদানের জন্য প্রতিটি জেলায় ন্যূনতম একটিসহ সারা দেশে ১০৩ প্রতিবন্ধী সেবাকেন্দ্র স্থাপন, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার চালু করা হয়েছে। দশটি মেডিকেল কলেজে শিশুদের অটিজমজনিত সমস্যা শনাক্তকরণে বিশেষ ইউনিট চালু করা হয়েছে। সরকার সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ কোটা ব্যবস্থা চালু করেছে।

জলবায়ুর প্রভাব জনিত কারণে বিশ্ব মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সেখানেও কাজ করছেন। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে থাকা ৫৫ টি দেশের জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম(সিডিএফ)।ফোরামের ৪ জন দূতের একজন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। অন্য তিনজন হলেন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদ কামাল,ফিলিপাইনের ডেপুটি স্পিকার লরেন লেগ্রেডা এবং কঙ্গোর জলবায়ু বিশেষজ্ঞ তোসি মাপ্পু। সিডিএফের পক্ষে এই চারজন দূত জলবায়ু-ঝুঁকি মোকাবেলায় সদস্য দেশগুলোর জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছেন।

অতিসম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে সদস্য রাষ্ট্র গুলোর গোপন ব্যালটে জয়ী হয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। আগামী পাঁচ বছর সংস্থাটির এই অঞ্চলের পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করবেন।দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১ টি (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, উত্তর কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও পূর্ব তিমুর) দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশী যিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিশ্বের এক পঞ্চমাংশ লোকের স্বাস্থ্যসেবা এখানে জড়িত।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সরাসরি তথাকথিত রাজনীতিতে জড়িত নয়। তবে রাজনীতির অর্থ যদি হয় মানব সেবা, তাহলে তিনি সেই রাজনীতিতে শতভাগ কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর রাজনীতির মূল লক্ষ্য সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের সেবা করা, তাদের জীবনমান উন্নত করা। তিনি নিরবে নিভৃতে সেই কাজটা করে যাচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রীর কন্যা হয়েও পারিবারিক সূত্রে তিনি কোনো সুবিধা গ্রহণ করেন নি। তিনি যা কিছু অর্জন করেছেন, তা সম্পূর্ণ নিজের মেধা যোগ্যতা দিয়ে। যত সব বড় কৃতিত্ব সবটুকুই নিজের অর্জন। তিনি আপন আলোয় আলোকিত হয়েছেন। এখানে মায়ের কোনো রাজনৈতিক সুবিধা তিনি নেননি। তবে তিনি একাধিক বার বলেছেন, তাঁর মা-ই আদর্শ ও অনুপ্রেরণা। ক্ষমতার এত কাছাকাছি থেকেও প্রচারের আলোতে না থাকা শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিবারে এমন ঘটনা বিরল।

নির্লোভ নিরহংকারী আপন আলোয় আলোকিত সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ৯ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। শুভ জন্মদিনে আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ কর্মময় জীবন প্রার্থনা করি।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
haldertapas80@gmail.

এইচআর/এমএস