ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে প্যাঁক প্যাঁক

মোস্তফা হোসেইন | প্রকাশিত: ০৮:৪৮ এএম, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩

‘বিধর্মীদের সংস্কৃতি, অশ্লীল নৃত্য শিক্ষা দেওয়া হয় যে প্রতিষ্ঠানে ওটা ছেড়ে প্রকৃত সুন্নাহভিত্তিক মাদরাসায় আপনার সন্তানকে ভর্তি করান।’ ফেসবুকে এ পোস্টের সঙ্গে ভিডিও যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, যা পরিকল্পিতভাব তৈরি করা হয়েছে তাও বোঝা যায়। এর মধ্যে আরও যুক্ত হয়েছে কঠোর ভাষায় সমালোচনা। যার প্রায় সবই মিথ্যাচারে ভর্তি।

এই হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে একশ্রেণির মানুষের মনোভাব। কেউ বলছে ‘ব্যাঙ লাফানো’ কেউ বলছে ‘অশ্লীল নাচ’। সমালোচকদের একজনকে দেখা গেলো অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত মিথ্যাচার প্রয়োগ করে পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক আবরণ দিতে। বলা জরুরি-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ মিথ্যাচারগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। সমালোচনার ডালপালা সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে ধর্মীয় আবরণ দেওয়ার পর।

শিক্ষক প্রশিক্ষণে নেই এমন বিষয় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভিডিওতে। শিক্ষক প্রশিক্ষণকালে কোনো সময় (নতুন কারিকুলাম এর নয়) কোনো বিনোদন অনুষ্ঠানের ভিডিওকে কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নতুন কারিকুলামের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে। ‘প্যাঁক প্যাঁক’ জাতীয় শব্দ উচ্চারণকারী ভিডিওগুলোর সঙ্গে নতুন কারিকুলামের কোনো সম্পর্কই নেই। অথচ সেগুলোকেও নতুন কারিকুলামের অংশ বলে ব্যাপকভাবে প্রচার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ কুসমালোচনাগুলোর জবাব দেওয়া হয়েছে, তাও দুর্বলভাবে, যা আবার গণমাধ্যমেও তেমন গুরুত্ব পায়নি প্রকাশকালে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপপ্রচারগুলো অধিকাংশের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়েছে। তারাও সমালোচনায় অংশ নিচ্ছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তোলা এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে শিক্ষামন্ত্রী যখন মুখ খুললেন ততদিনে মিথ্যাচারে বিশ্বাসীর সংখ্যা অগণন হয়ে গেছে।

সমালোচনাকারীদের একটি অংশ বলছে-হুট করে নতুন কারিকুলাম চালু হওয়াটা ঠিক হয়নি। এজন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন ছিল। একটি অংশ মন্তব্য করেছে-শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, মূল্যায়নের ব্যবস্থা না করে এমন নতুন উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হয়নি। বলা হচ্ছে-নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষাক্রম চালুর জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত না করে তা চালু করা হয়েছে।

এসব সমালোচনার ভিত্তি নেই বলেই জানা যায়। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য থেকে জানা যায়-সরকার এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের আগে সংশ্লিষ্ট অংশীজন, বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আট শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ তাদের মতামত নিয়ে তা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে গেছে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘সবাইকে কোনো না কোনোভাবে এর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওয়েবসাইটে রেখে জনগণের মতামত, পরামর্শ নেওয়া হয়েছে, সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। সবশেষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিছু পরামর্শসহ তিনি অনুমোদন দিয়েছেন। আমরা পাইলটিং করেছি। তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয়েছে। সব বইকে আমরা বলছি পরীক্ষামূলক সংস্করণ, আমরা মনে করিনি— আর পরিশীলন, পরিমার্জন দরকার নেই, একবারে চূড়ান্ত। আমরা মনে করি— এ বইগুলো আরও পরিশীলন, পরিমার্জনের সুযোগ রয়েছে। সেজন্য সবার পরামর্শ গ্রহণ করছি।’ ( বাংলা ট্রিবিউন, ৩ ডিসেম্বর ২০২৩)

বছরের শুরুতে যখন নতুন কারিকুলাম নিয়ে হইচই হচ্ছিল তখন ছিল একটা পরিবেশ। তখন কারিকুলাম প্রয়োগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন যা হচ্ছে তাকে স্বাভাবিক সমালোচনা বলা যায় না। আসলে নির্বাচন সামনে রেখে সরকারি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতার মাধ্যমে জনমত ভিন্নখাতে প্রবাহের কুরাজনৈতিক চেষ্টা হিসেবেও যদি এটাকে মূল্যায়ন করা হয়, মনে করি ভুল হবে না।---মোস্তফা হোসেইন

মূল্যায়ন পদ্ধতি বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি যারা বলছেন, তারা হয়তো ইউটিউবে মূল্যায়ন পদ্ধতি বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনাটি দেখেননি। মূল্যায়নের জন্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ইউটিউবেও ছাড়া হয়েছে যেন বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষক অভিভাবক শিক্ষার্থী এবং উৎসাহীজন যাতে সম্যক ধারণা গ্রহণ করতে পারে।

নতুন কারিকুলামে শিক্ষাক্রম সমালোচনার বাইরে এমন বলা যাবে না। বছরের শুরুতে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষকে ভুল স্বীকারও করতে হয়েছে। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অস্বাভাবিক নয়। ভুল যদি সংশোধনের ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তখন সেটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীও বলেছেন, সংশোধনীর সুযোগ রাখা হয়েছে, যা প্রয়োজনীয় নয় কিংবা যা ভ্রান্তিপূর্ণ এমন কিছু যদি অন্তর্ভুক্ত হয় সেগুলোও সংশোধনের সুযোগ আছে। আবার যিনি সমালোচনা করেন তার বিষয়েও কথা থাকে। তার সমালোচনাটি আদৌ বাস্তবনির্ভর কি না, তার সমালোচনার পেছনে কোনো রাজনৈতিক এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থ কাজ করে কি না তাও দেখতে হবে।

নতুন কারিকুলামের কিছু বিষয়ে নতুন করে ভাবা উচিত। বিশেষ করে শিক্ষা উপকরণের যে চাপ অভিভাবকের ওপর পড়ে তা কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করা যায় কি না। নতুন পদ্ধতিতে কোচিং ব্যবসায় আঘাত হানতে পারলেও শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের সংশ্লিষ্টতা বেড়ে গেছে। এতে নতুন কারিকুলাম নতুনই। শিক্ষকের জন্য, শিক্ষার্থীর জন্য সবার জন্যই।

স্বাভাবিকভাবে চিরায়ত পদ্ধতির বাইরে নতুন কিছু গ্রহণ করার ক্ষেত্রে প্রথম অবস্থায় কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিভাবকের কথা ভাবা দরকার। অভিভাবকদের বিরাট একটি অংশ সন্তানের লেখাপড়ার কোনো খোঁজ রাখেন না। কিংবা রাখার মতো সামর্থ্যও তার নেই। সেক্ষেত্রে ওই শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কতটা ভালো ফল আশা করা যাবে।

নতুন পদ্ধতিতে শিখনকালীন মূল্যায়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ শিক্ষার্থী কতটুকু শিখলো নিয়মিত ক্লাসেই তা যাচাই হবে। দুর্বলতাগুলো ক্লাসেই চিহ্নিত করে তা সমাধান করা হবে। ফলে শিক্ষক আগের মতো বছর শেষে পুরো বছরের মূল্যায়ন করার সুযোগ পাচ্ছেন না। এতে তার পরিশ্রম বাড়বে। ফলে শিক্ষকদের মধ্যেও কিছু আছে যারা নতুন পদ্ধতির বিপক্ষেই থাকবে। সমালোচকরা হয়তো বলতে পারতেন, শিক্ষকদের অনেক বেশি কর্তৃত্ব দেওয়া হয়ে গেছে। এতে শিক্ষকদের মধ্যে এমন কোনো মানসিকতা তৈরি হবে কি না, যাতে তাদের দায়িত্ব পালনে অনিয়মের আশ্রয় নিতে হয়।

সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে শিখনকালীন মূল্যায়নের কারণে নোট বই ব্যবসায়ীরা পড়বেন বিপাকে। কারণ তাৎক্ষণিক মূল্যায়নের কারণে গাইডবই পড়ে কোনো ফয়দা হবে না। তাই তারা আনুষ্ঠানিকভাবেও বিরোধিতা করতে পারে।

অভিভাবকদের মধ্যে আরেকটা পরিবর্তন আসবে-তা হচ্ছে, তারা যেভাবে জিপিএমুখী চিন্তায় অভ্যস্ত তাতেও বাধা আসবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী রাতভর ‘এবিসি একটা ত্রিভুজ, এবিসি একটা ত্রিভুজ’ জাতীয় মুখস্ত বিদ্যার আশ্রয় নিতে পারবে না। প্রতিটি অভিভাবকের মনেই কাজ করে পাশের বাড়ির ছেলে-মেয়ের চেয়ে তার ছেলে-মেয়ে কত নম্বর বেশি পেয়েছে, জিপিএ-৫ পেলো কি না। এই মানসিকতায়ও কিছু পরিবর্তন আসছে। ফলে নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ ও সুফলের পথে প্রতিবন্ধকতা থাকছেই।

শিক্ষার্থীদের শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে গিয়ে সরকারকে ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। আজও বলা হয় বেত ছাড়া শিক্ষালাভ পরিপূর্ণ হয় না। শিক্ষার্থীরা এতে করে বখে যেতে পারে। আসলে যে কোনো পরিবর্তনকে সহজে মেনে না নেওয়ার মানসিকতা অতি পুরোনো।

শিক্ষাটা আনন্দময় করার চেষ্টাকেও তাই ওই অংশ ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। তাদের চিন্তা-চেতনায়, শিক্ষার্থীকে ক্লাসে এক পায়ে বেঞ্চ-এর ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা কিংবা শাস্তি হিসেবে ক্লাসে দুই কান ধরে ধরিয়ে রাখাটাই স্থায়ী হয়ে আছে। এটাই আসলে হয়েছে নতুন কারিকুলাম গ্রহণ করা না করা বিষয়ে।

বছরের শুরুতে যখন নতুন কারিকুলাম নিয়ে হইচই হচ্ছিল তখন ছিল একটা পরিবেশ। তখন কারিকুলাম প্রয়োগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন যা হচ্ছে তাকে স্বাভাবিক সমালোচনা বলা যায় না। আসলে নির্বাচন সামনে রেখে সরকারি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতার মাধ্যমে জনমত ভিন্নখাতে প্রবাহের কুরাজনৈতিক চেষ্টা হিসেবেও যদি এটাকে মূল্যায়ন করা হয়, মনে করি ভুল হবে না।

অন্যদিকে বিষয়টি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীও তাদের স্বার্থ উদ্ধারে কাজে লাগিয়েছে। অশ্লীল ও রুচিহীন বলে যে দোষারোপ করা হচ্ছে নতুন কারিকুলামকে তা আদৌ নতুন কারিকুলাম সৃষ্ট নয় সেটা যাচাই করারও প্রয়োজন বোধ করেনি তারা।

সুতরাং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ দূর করতে হলে সরকারি প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো প্রয়োজন। যাতে বিভিন্ন মহলে যে ভুল ধারণাগুলো কাজ করছে সেগুলো সমাধান হয়।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম