ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রাজনীতিতে আসলেই শেষ কথা বলে কিছু নেই!

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৯:৩০ এএম, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩

বিএনপির যে কজন নেতা সরকারের ওপর মহাখাপ্পা ছিলেন, কড়া ভাষায় সরকারের সমালোচনা করতেন, সরকার পতনের আন্দোলনে কর্মীদের অনুপ্রাণিত করতেন; শাজাহান ওমর তাদের একজন। কদিন আগেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ‘ভগবান’, ‘অবতার’ বলে রীতিমতো ভাইরাল হয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি এই গোমরও ফাঁস করে দিয়েছিলেন, বিএনপি আসলে আন্দোলন করে নামকাওয়াস্তে, তাকিয়ে থাকে পিটার হাসের দিকে।

বেচারা পিটার হাস ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কায়। তা নিয়ে কত কাণ্ড হলো। পিটার হাস যে কদিন দেশে ছিলেন না, সে কদিন বিএনপি গর্তে লুকিয়ে ছিল। পিটার হাস ফেরার পরই বিএনপি নেতারা আবার প্রকাশ্যে আসা শুরু করেছেন। শাজাহান ওমরের ভাষায় পিটার হাস যেন সত্যিই বিএনপির জন্য ভগবান।

মেজর (অব.) ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর বীর উত্তম, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী, পাঁচবারের সাবেক সংসদ সদস্য। পরিচয় যেটুকু দিয়েছি, তাতে সবারই বোঝার কথা, তিনি কামেল লোক। প্রথম কথা হলো, তার প্রতি আমার চিরকালীন শ্রদ্ধা। এই শ্রদ্ধা শুধু শাজাহান ওমরের জন্য নয়, সব বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য। কারণ আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করি মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা জীবনের মায়া না করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলেই আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এই স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা অনেকে অনেক কিছু হতে পারবো। কিন্তু কেউ কখনো মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবো না। তাই একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য আমার হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসনটি চিরকালের জন্য। পরবর্তী কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচনা-সমালোচনা সেটা আলাদা।

সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর আইনজীবী হিসেবে নতুন ক্যারিয়ার শুরু করেন। বিরল উদাহরণ বটে। তারচেয়ে বড় কথা হলো প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। সেনাবাহিনীতে থাকার সময় জিয়াউর রহমান সরাসরি তার শিক্ষক ছিলেন। সেই সম্পর্কটা তারা টেনে এনেছেন রাজনীতিতে। প্রায় ৪৫ বছর তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। এখন ৭৭ বছর বয়সে এসে তার মনে হচ্ছে জিয়াউর রহমানের চেয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ভালো। বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়াকে তার প্রমোশন মনে হচ্ছে।

ব্যারিস্টার শাজাহান ওমরের কাছে যেটাকে প্রমোশন মনে হচ্ছে, সাধারণ মানুষ সেটাকে নিয়েছে ডিগবাজি হিসেবে। বাংলাদেশে জায়েদ খান নামে একজন চিত্রনায়ক আছেন, যিনি সিনেমায় অভিনয় করতে যতটা দক্ষ, তারচেয়ে বেশি দক্ষ ডিগবাজিতে। এটা আক্ষরিক অর্থেই। জায়েদ খান কোনো মঞ্চে পারফর্ম করতে গেলে ডিগবাজি দিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেন। যেটা আসলে নায়কের কাজ নয়, ভাড়ের কাজ।

সম্প্রতি মস্তফা সরয়ার ফারুকীর একটা সিনেমার প্রমোশনেও জায়েদ খান ডিগবাজি দিয়ে ভাইরাল হয়েছেন। তবে জায়েদ খান ডিগবাজিতে যত দক্ষই হোন, ব্যারিস্টার শাজাহান ওমরের সাথে পারবেন না। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের আওয়ামী লীগের মনোনয়নর পেয়ে যাওয়া বিস্ময়করই বটে। তবে রাজনীতিতে বিস্ময় বলে কিছু নেই। রাজনীতিবিদরা তাদের অনেক বিস্ময় ধামাচাপ দেন, অনেক অপকর্ম জায়েজ করেন- রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই, এই কথা বলে। আসলেই রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

গত ২৮ অক্টোবর সহিংসতায় পণ্ড হয়ে যায় বিএনপির মহাসমাবেশ। সেদিন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগসহ নানান সহিসংসতার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়। এসব মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ অনেককেই গ্রেফতার করা হয়। ৪ নভেম্বর আরও অনেকের সাথে গ্রেফতার হন ব্যারিস্টার শাজাহানর ওমরও। তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়।

এ ধরনের ডিগবাজি রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করে দেয়। মানুষ আর রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করে না। পাঁচবারের সংসদ সদস্য, একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রীও যখন ৭৭ বছর বয়সে এসে ৪৫ বছরের রাজনৈতিক দল ছেড়ে প্রতিপক্ষ দলে যোগ দেন, তখন বোঝা যায় রাজনীতিতে আসলে আদর্শ বলে কিছু নেই, সবই স্বার্থ। আবার টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগও যখন শাজাহান ওমরের মতো একজন লোককে দলে টানে, তখন বোঝা যায় দেউলিয়াত্মটা আমাদের রক্তে মিশে গেছে।

শাজাহান ওমরসহ বিএনপি নেতাদের জামিন আবেদন বারবার বাতিল করা হয়। কিন্তু সবাইকে কারাগারে রেখে ২৯ নভেম্বর যখন জামিনে বেরিয়ে এলেন ব্যারিস্টার সাহেব, তখনই বোঝা গেছে ডালমে কুছ কালা হ্যায়। ৩০ নভেম্বর শাজাহান ওমরের সংবাদ সম্মেলনের খবর শুনে ভেবেছি, ৭৭ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়তো রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেবেন। কিন্তু তিনি যে লাফ দিয়ে নৌকায় চড়ে বসবেন, এটা বুঝিনি। বলা হচ্ছে, তাকে চাপ দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে দলবদলে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু একজন পাঁচবারের সংসদ সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রীকে আর কী প্রলোভন দেখানো যায়। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে, একজন ব্যারিস্টারকে কী বলে ভয় দেখানো যায়। আমি ভেবে পাই না। হতে পারে ডিগবাজি না দিলে তিনি জামিন পেতেন না। তার মানে কারাগারে থাকতে হতো। কারাগারকেই যদি ভয় পাবেন, তাহলে আর রাজনীতি করার দরকার কী। অবসরে চলে যান।

ব্যারিস্টার শাজাহান ওমরকে ঝালকাঠি-১ আসন থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। গত ২৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন ২৯৮ আসনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন, তখন ঝালকাঠি-১ আসনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য বিএইচ হারুন।

পাঁচদিন পর তিনি জানান, তার আসন ছিনতাই হয়ে গেছে। ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর কিন্তু এখন দুই দলের কাছেই ভিলেন। ঝালকাঠি-১ আসনের বিএনপি সমর্থকদের কাছে তিনি বিশ্বাসঘাতক আর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কাছে অনুপ্রবেশকারী। একটা সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হলে শাজাহান ওমর দুই পক্ষের ভোটারদের কাছেই প্রত্যাখ্যাত হতেন।

দলবদলের পর এখন ঝালকাঠি-১ আসনের বিএনপি সমর্থকরা ব্যারিস্টার শাজাহান ওমরকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন, কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছেন। তার বিরুদ্ধে গাদা গাদা অভিযোগ করছেন। তাহলে এতদিন যখন তিনি বিএনপি করতেন, তখন তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগগুলো তোলা হলো না কেন।

আবার তিনি তো আওয়ামী লীগ সমর্থকদের পাকা ধানে মই দিয়েছেন। ২৯ নভেম্বর বিকাল পর্যন্ত ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর ছিলেন সহিংসতার মামলার আসামি। তিনি জামিন পেয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন বটে। কিন্তু মামলা তো আর ফুরিয়ে যায়নি। এখনও তিনি সহিংসতার মামলার আসামি। তো একজন সহিংসতার মামলার আসামি কীভাবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেন? সহিংসতার মামলার আসামি যদি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে পারেন, তাহলে বাকি আসামিরা কারাগারে থাকবেন কেন?

শাজাহান ওমরের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর, এসব রাজনৈতিক মামলার আইনি ভিত্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। আসলে এসব প্রশ্ন তোলাটাই অবান্তর। ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর বাংলাদেশে ডিগবাজি খাওয়া প্রথম রাজনীতিবিদ নন। জিয়া-এরশাদ আমলে আগের দিনের বিপ্লবী পরদিন সরাসরি শপথ নিতে গেছেন। কারাগার থেকে বঙ্গভবনে যাওয়ার উদাহরণও বিরলে নয়।

তবে এ ধরনের ডিগবাজি রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করে দেয়। মানুষ আর রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করে না। পাঁচবারের সংসদ সদস্য, একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রীও যখন ৭৭ বছর বয়সে এসে ৪৫ বছরের রাজনৈতিক দল ছেড়ে প্রতিপক্ষ দলে যোগ দেন, তখন বোঝা যায় রাজনীতিতে আসলে আদর্শ বলে কিছু নেই, সবই স্বার্থ। আবার টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগও যখন শাজাহান ওমরের মতো একজন লোককে দলে টানে, তখন বোঝা যায় দেউলিয়াত্মটা আমাদের রক্তে মিশে গেছে। আমাদের আর কোনো চক্ষুলজ্জা নেই।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম