ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নির্বাচনের চাইতে বড় এখন রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ০৯:২৪ এএম, ০২ ডিসেম্বর ২০২৩

রাজনীতিতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, নির্বাচন এলে আরও বেশি করে হয়। মানুষ দল বদল করে, মঞ্চ করে। তবে আসছে নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া দু’জন যা করেছেন যা করছেন তা রীতিমতো বিস্মময়কর। প্রথমে কল্যাণ পার্টির নেতা মেজর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল সৈয়দ মুহম্মদ ইব্রাহিম সরকার বিরোধী আন্দোলনের মাঠ থেকে নির্বাচনের মাঠে এসেছেন। তার চেয়েও বিস্ময় জাগানিয়া কাজ করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার মেজর (অব.) শাহজাহান ওমর। তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন আগুন সন্ত্রাসের অভিযোগে, অন্য কেন্দ্রীয় নেতারা যখন জেলে তখন তিনি হঠাৎ মুক্তি পেয়ে নৌকায় চড়ে বসেছেন। ঝালকাঠি-১ আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার জন্য বিএনপির সাথে তার ৪৫ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করলেন।

এই তালজ্ঞানহীন মাত্রাছাড়া ডিগবাজি নিয়ে সর্বত্র এখন আলোচনা। সন্ত্রাস অগ্নিসংযোগের মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন শাহজাহান ওমর। তাকে এক বিকেলে মামলা, আরেক বিকেলে জামিন এবং পরদিন বিকেলেই নৌকা প্রতীক দেয়ায় এখন প্রশ্ন উঠেছে নাশকতা এবং আগুন সন্ত্রাসের অভিযোগগুলো বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে তো?

শাহজাহান ওমর কয়দিন আগেও সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন, যা মন চায় তাই বলেছেন। এটা নতুন নয়। অতীতেও তিনি আওয়ামী লীগকে যাচ্ছেতাইভাবে গালাগাল দিয়েছেন। এখন তিনি আওয়ামী লীগের নৌকাতেই বসে পড়েছেন। এই যে নাটকীয় কাজটা করলেন, সে সম্পর্কে নিজে তার বয়সের কথা বলেছেন। বলেছেন. “এখন আমার বয়স ৭৭, আর কতকাল নির্বাচনের বাইরে থাকব”।

বিএনপি নেতৃত্ব শাহজাহান ওমরকে যতই বহিষ্কার বা গালি দিক, এই সত্যটা বোধ হয় অনুধাবন করা দরকার। বিএনপির অনেক নেতারই বয়স হয়ে গেছে। এবারও যেহেতু দল নির্বাচন করছে না, তাই পাঁচ বছর পর তাদের আর হয়তো শরীরে সেই সক্ষমতা থাকবে না নির্বাচন করার। অনেকে এ কারণে স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন। আবার অনেক তরুণ নেতা অর্থ বিত্ত থাকলেও মনোনয়ন নাও পেতে পারেন। সেই বিবেচনায় তারাও নির্বাচনে আসবেন।

আওয়ামী লীগ প্রথম যে ২৯৮ টি আসনে মনোনয়ন ঘোষণা করে সেখানে রাজাপুর-কাঁঠালিয়া নিয়ে গঠিত ঝালকাঠি-১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনের নাম ঘোষণা করা হয়। তাই হঠাৎ বিএনপির এক নেতার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার খবর বিস্ময় তৈরি করেছে নেতা–কর্মীদের মধ্যে। তারা কিছুটা বিভ্রান্ত এবং ক্ষুব্ধও। স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগ নেতা মনিরুজ্জামান মনির বলেন, শাহজাহান ওমরকে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা–কর্মীরা মেনে নেবেন না। তাকে রাজাপুর ও কাঁঠালিয়ার জনগণ প্রত্যাখ্যান করবেন।

তাহলে এটি এখন দলের ভেতরে দ্বন্দ্ব এবং ধন্দ দুটোই সৃষ্টি করেছে বলা যায়। এই ঘটনা অনেক স্থানেই ঘটবে। কারণ দল এই কাজটা করবে অনেক আসনেই। জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, ১৪ দল, ইসলামি জোট, যুক্তফ্রণ্ট এবং বিএনপি থেকে আসা স্বতন্ত্রদের জন্য এই সমঝোতা করতে হবে আওয়ামী লীগকে। তাই নির্বাচনটা আওয়ামী লীগের জন্য লড়াইয়ের চাইতে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার কৌশল হিসেবে এবং সেটা নিজ দলের ভিতরেই।

বিএনপি নির্বাচন করতে অনিচ্ছুক, রাজনীতির ময়দানে অপটু। তাই শাসক দল আওয়ামী লীগ- সুবিধাজনক মাঠে অবস্থান করছে। বিরোধিতার মাঠটি যখন ভিতর হতেই স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, তখন বহিরাগতরা এসেই যে সে শূন্য স্থান পূর্ণ করবে, সেটা তো পদার্থবিদ্যার পাঠ। তাই এখন আওয়ামী লীগ কর্মীরা যতই বলুন পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে, এ নিয়ে যতই ঘাম ঝরানো হোক না কেন, রাজনৈতিক কৌশল নামক অভিধার কাছে এসব সেন্টিমেন্ট মূল্যহীন।

আগেই বলেছি, রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের এই ভোল বদল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু তাকে ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার সাথে আনতে পারা এখন রাজনীতির কর্পোরেট সংস্কৃতি। ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে ডামি প্রাথীদেরও।

মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ দিনে দেখা গেল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩০০ আসনে আওয়ামী লীগের প্রায় সাড়ে চারশর মতো স্বতন্ত্র প্রার্থী। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা প্রায় দেড়শ বেশি। কী পরিমাণ উচ্চাশা তৈরি হয়েছে দলের নেতাদের মধ্যে সেটা বোঝা যায়। বোঝা যায় কতটা সম্পদ আর অর্থের মালিক হয়েছেন তারা। সাধারণত দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ প্রার্থী হলে সেটাকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ হিসেবে দেখা হতো। বলা হতো এরা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী। কিন্তু এবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েই দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এখন সামনে সেই ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন। দলের সিইও ও ম্যানেজাররা এখন ভাবছেন এই ব্যবস্থাপনার কথা। বলছেন, ঢালাওভাবে স্বতন্ত্র বা ডামি প্রার্থীর অনুমোদন দেয়া হবে না।

মানুষ সব দেখছে আর ভাবছে রাজনীতির এমন কৌশল, ব্যবস্থাপনা, ডিগবাজিতন্ত্র, পালাবদলে তার অবস্থান কোথায়? রাজনীতি যে, কতজনের জন্য কত সম্ভাবনা উৎপাদন করে, শুধু যাদের জন্য ভোট সেই নির্বাচকমণ্ডলি অর্থাৎ মানুষের জন্য কোথাও কিছু নেই।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/এমএস