ক্রিকেট বিশ্বকাপে হারের পর উল্লাস
ভারত বিরোধিতা কি বাড়ছে বাংলাদেশে?
সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শেষ দিন। রাস্তাঘাটে সুনসান নীরবতা অধিকাংশের মধ্যে একটা প্রবল আক্রোশ ভারতের ওপর। তাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যাচ্ছে প্রত্যেকেরই প্রার্থনা ভারত যেন হেরে যায়। ফলাফলে ভারতের পরজয়ে বিজয় মিছিল ঢাকার সবচেয়ে চেতনার আঁতুড়ঘর টিএসসি থেকে বের হলো। টেলিভিশন, ইউটিউব চ্যানেলে অনেক দর্শকের মতামত নিতে দেখা যাচ্ছে। খেলাপ্রেমিদের মূল প্রসঙ্গ ছিল ভারত হেরেছে এবং ভারতের প্রতি একরাশ বিদ্বেষ উগড়ে দেওয়া।
খেলায় হারজিত যেমন থাকবে। দর্শকও দুটি পক্ষে বিভক্ত হবে। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এদিন মনে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার খেলার কৌশল নয় বরং ভারতের বিপক্ষে খেলেছে বলেই অস্ট্রেলিয়াকে সাপোর্ট করা। এর কারণ কি শুধুই খেলাপ্রেম, নাকি অন্য কোনো কূটকৌশল? হতে পারে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম মাত্র একটি ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে জিতেছে। আর বাকি সব ম্যাচে হেরে যাওয়ার কারণ। তাই প্রতিবেশী দেশ হিসেবে সব রাগ ভারতের ওপর উগড়ে দিয়েছে। যারা বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে ভারোবাসেন তারা কি জানেন, আজ আমরা বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল ভারত।
২০০০ সাল। বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসি’র সভাপতি তখন জগমোহন ডালমিয়া। ক্রিকেট দুনিয়ায় নিজেদের অবস্থান করে নিল বাংলাদেশ। বিশ্বজুড়ে ক্রিকেট উন্নাসিকরা তখন বলতেন, আইসিসিতে কেবল প্রভাব-বলয় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই, টেস্ট খেলুড়ে জাতি হিসেবে প্রস্তুতিহীন বাংলাদেশকে টেস্ট খেলার অধিকার দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আইসিসি’র সভাপতি ডালমিয়া তখন অভিযোগ খণ্ডন করেছিলেন বাংলাদেশের মাথায় প্রশ্রয়ের হাত রেখে। বলেছিলেন, ‘এই উপমহাদেশ থেকে তিনটি দেশ বিশ্বকাপ জিতেছে। চতুর্থ দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতবে বাংলাদেশও। দেশটিকে একটু সময় দিতে হবে।’
ডালমিয়া জানতেন ক্রিকেট বাংলাদেশে কতটা জনপ্রিয়। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের মাটিতেই সফলভাবে আয়োজিত হয়েছিল এশিয়া কাপ ক্রিকেটের তৃতীয় আসর। এরই ধারাবাহিকতায় ঝানু ব্যবসায়ী হিসেবে ডালমিয়া বুঝে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেটের স্টেডিয়াম পরিপূর্ণ থাকে। ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে নক-আউট পদ্ধতিতে আয়োজিত ‘মিনি বিশ্বকাপ ক্রিকেট’ আসরের আয়োজন করেন। মিনি বিশ্বকাপ বাংলাদেশকে আয়োজন করতে দিয়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। ক্রিকেট দুনিয়াকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর বাইরেও এত বড় প্রতিযোগিতা সাফল্য পেতে পারে। এরই মধ্যে ক্রিকেট দুনিয়ার কাছে পরিচিত করে তুললেন বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডকে।
২০০৫ সালে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার হয়ে পদত্যাগ করেন ডালমিয়া। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৩ সালে পুনরায় সভাপতি পদে ফেরেন তিনি। নতুন করে সভাপতি হওয়ার পরও ভোলেননি বাংলাদেশকে। সে বছর মার্চে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের পর বাংলাদেশের মানুষ যখন শ্রীনিবাসের ওর ক্ষুব্ধ, বিতর্কে দুই দেশের ক্রিকেটীয় সম্পর্ক, তখন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন ডালমিয়া। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর থেকে শুনে আসছি বাংলাদেশকে নিয়ে নেবে ভারত।
১৯৯৬ সালে প্রথম সরকার গঠন করার পর দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠন করে বর্তমান ক্ষমতায় টিকে আছেন ১৫ বছর। অথচ আজও ভারত বাংলাদেশ নেয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে ভারতের সরকার প্রধানরা চেয়েছেন বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে। যেমন দুর্বল বন্ধুকে সবল বন্ধুরা সহযোগিতা করে।
আসন্ন ১২তম সংসদ নির্বাচন ২০২৪ সাল কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন কোণঠাসা করতে ব্যস্ত। ঠিক সেই সময় বিশ্বের অন্যান্য ক্ষমতাসীন দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন ভারত সরকার। তাই জি২০ এর সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও সম্মেলনে একমাত্র অতিথি হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে কুশলবিনিময় হয়েছে, শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে ছোটখাটো আলোচনাও হয়েছে।
জো বাইডেন নিজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে সেলফি তোলেন। এ ছবিটিই বলে দিয়েছে সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে। এছাড়া আরব আমিরাত ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। অন্য রাষ্ট্র নায়কদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, সাইডলাইনে আলোচনাও হয়েছে।
১৯৯৪ সালের অক্টোবরে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। এই পদে নাম প্রস্তাবকারী ছিলেন তৎকালীন ভারতের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং। যমুনা ফিউচার পার্কে বিশাল জায়গা নিয়ে ভারতের ভিসা সেন্টার। প্রতিদিন সেখানে ৫০০০ ভিসা আবেদন জমা পড়ে। বিশাল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো অভিযোগের সুরে বলতে থাকবে, আমেরিকার ভিসা পেতেও এত কষ্ট করতে হয় না।
আমরা কি এটা জানি, আমেরিকার ভিসা নিতে প্রতিদিন কতজন যায় আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে! অথচ ভারতে যেতে মাত্র ২০ হাজার টাকার ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখালেই ভিসা আবেদন করা যায়। যেখানে আমেরিকার জন্য লাখ টাকার অধিক ব্যাংকে জমা থাকতে হয়। কোনো কারণে ভারতীয় ভিসা না পেলে গালাগালি করতে এক সেকেন্ড সময় নেই না। রাস্তাঘাটে অধিকাংশ জায়গায় শোনা যায় ভারত তো নিজের সুবিধার জন্য বাংলাদেশে এসে যুদ্ধ করেছে। কেউ ভারতের হয়ে কথা বললে তাকে আমরা ভারতের দালাল বলছি। আমরা কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানি? ডিসেম্বরজুড়ে এত এত মুক্তিযুদ্ধের ওপর কলাম লেখা হয়। কোথাও কি মুক্তিযুদ্ধের শেষের ১৩ দিনের সঠিক ইতিহাস লেখা হয়েছে? আমরা কতজন জানি বাংলাদেশে ভারতের সেনা কেন এসেছিল। কীভাবে পকিস্তানিদের পরাজিত করে আমরা বিজয় লাভ করেছি। আসুন জেনে নেই।
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। ভারতীয় বাহিনীর চারটি রেজিমেন্ট যাত্রা শুরু করেছে ঢাকার দিকে। এটা ভারতের ‘ফাইনাল মিশন’ এ খবর পেয়ে মিজর জেনারেল নিয়াজি ঘাবড়ে যান। তারমধ্যে অলইন্ডিয়া রেডিওতে শোন গেলো সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশর বিবৃতি দিয়েছেন, ‘আমি আগেই দুবার আপনাদের ওয়ার্নিং দিয়েছি। কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। আবারও বলছি সারেন্ডার করুন। আমার ফোর্স ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। আপনারা যদি এখনো আমাদের প্রতিরোধ করার জন্যই বদ্ধপরিকর থাকেন, তাহলে সবার আগে বিদেশি নাগরিক, সাধারণ ঢাকাবাসীকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দিন। যদি তার অন্যথায় হয় তাহলে আপনি অবশ্যই চাইবেন না, আমি আমার বাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দেই। এবার আপনার সিদ্ধান্ত।
১৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা। ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ দিল্লি থেকে হটলাইনে কথা বললেন জেনারেল জেকবের সঙ্গে। তিনি বললেন, সারেন্ডার করার জন্য পাকিস্তানকে আলটিমেটাম দিয়েছিলাম, তার কোনো রেসপন্স এসেছে? জেনারেল জেকবের কাছে না শব্দ শুনে মানেকশ বলেন, ঢাকায় যেখানে পাকিস্তানের ইস্টান কমানড হেডকোয়ার্টার্সে আব্দুল্লা বসে আছে, তার যতটা কাছে সম্ভব বোমা মারো, কিছু গুলি চালাও। ১০ মিনিট পরপর অ্যাটাক করবে, শুধু ভয় দেখানোর জন্য।
ঢাকায় গভর্নর হাউসে মিটিং করছিল এমএ মালিক, জন কেলি। ঠিক তখন চারটি মিগ টুয়েন্টি ওয়ান আকাশে উড়ে গেলো। পরিচালনা করছিলেন উইং কমান্ডার বিশনয়, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট চন্দ্রশেখর, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জি বালা এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হেমু সারদেশাই। মাথার ওপর রকেটের প্রচণ্ড বোম্বিংয়ের শব্দে চমকে গেল সবাই। সঙ্গে আগুন ধরে গেল গভর্নর হাউসে। ১২৮টি রকেট ছুড়ে অল ক্লিয়ার করে চলে গেল ভারতীয় এয়ার ফোর্স বাহিনী। রাজভবন থেকে পাকিস্তানের গভর্নর চলে এলেন ইস্টার্ন কমান্ড দপ্তরে। মেজর জেনারেল আবদুল্লা নিয়াজি গভর্নরকে বললেন, জানি ইন্ডিয়া অ্যাটাক করেছে। আমাদের আর কোনো চমক দেওয়ার নেই, খেল খতম। ইতোমধ্যে আমেরিকা পরমাণু অস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ বঙ্গোপসাগর থেকে ফিরে গেছে। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ম হুমকি দিয়েছে আমেরিকাকে, তারা সাবমেরিনসহ এক যুদ্ধজাহাজ বাহিনীর টাস্কফোর্স পাঠাবে।
১৫ ডিসেম্বর। অল ইন্ডিয়া রেডিওর ভাষণে জেনারেল স্যাম মানেকশ পাকিস্তানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনাদের সোজাসুজি সারেন্ডার করতে বলছি। সেজন্য সময় আজ বিকেল ৫টা থেকে আগামীকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত কোনো মিলিটারি অপারেশন করব না। কীভাবে সারেন্ডার করবেন জানান।’
১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। ঠিক ৯টা বাজার কিছুক্ষণ আগে ভারতের কাছে পাকিস্তান থেকে মেসেজ এল তারা, তারা আরও সময় চাইছে যুদ্ধবিরতির। আলোচনার জন্য ভারতীয় কোনো অফিসারকে যেন ঢাকায় পাঠানো হয়। মেসেজ পেয়ে মানেকশ কথা বললেন জেকবকে। তিনি বললেন, মিস্টার জেকস, প্রসিড টু ঢাকা। জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে সারেন্ডার টার্মস ফাইনাল করো। আজই সারেন্ডার। কোনো দেরি নয়। জেনারেল জেকব তখন অ্যাডভান্স এয়ার হেডকোয়ার্টার্সের এয়ার কমান্ডো পুরুষোত্তম এবং ইনটেলিজেন্স কর্পসের কর্নেল এম এস খেরাকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টারে উড়াল দিলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।
জেনারেল জেকব সারেন্ডার নথিপত্র দিলেন, নিয়াজি বললেন, ‘এটা কিন্তু যুদ্ধবিরতি হবে। সারেন্ডারে আমরা স্বাক্ষর করবো না।’ সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলেন জেনারেল জেকব। কঠোর কণ্ঠে বললেন, ‘লুক জেনারেল, তিনদিন ধরে ওয়ার্নিং করা হচ্ছে, সারেন্ডারই একমাত্র পথ। এখন কোনো যুদ্ধবিরতি নয়। অন্যথায় হলে দায় আপনার। ইতোমধ্যে মুক্তিবাহিনী ঢাকায় ঢুকে পড়েছে। আমাদেও ফোর্স শহরের বাইরে অপেক্ষা করছে। সুতরাং মাত্র ৩ মিনিট সময় দিলাম। ভাবুন।’
বিকেল সাড়ে ৪টা। ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি ইন সি জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা এসে পৌঁছালেন ঢাকা এয়ারপোর্টে। জেকব আর নিয়াজি গেলেন তাকে রিসিভ করতে। রেসকোর্স ময়দানে তখন জনসমুদ্র। জয় বাংলা..জয় ইন্ডিয়া..জয় মুজিব..জয় ইন্দিরা স্লোগানে মুখরিত। মঞ্চে স্বাক্ষরিত হওয়ার পর নিজের রিভলবার জেনারেল নিয়াজি তুলে দিলেন জগজিৎ সিং আরোরার হাতে। এভাবেই লজ্জাজনক পরাজয়ে ভারতের হাতে যুদ্ধবন্দি হলো পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সেনা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৩টি দলিলে স্বাক্ষর করেন পকিস্তানিরা। একটি ভারতের, একটি পাকিস্তানের একটি বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের ৬ দিন পরে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের কলকাতা থেকে সক্রিয়, মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত সরকার প্রধানরা বিমানযোগে ঢাকা আসেন। ২৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ সচিবালয়ে সরকারি কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৭ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক ভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৫ মার্চ ১৯৭২ সালে ভারত তাদের সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা পাখির মতো যখন মানুষ মারতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তখন প্রাণের ভয়ে সবাই ভারতে পালাতে শুরু করলো। নিজ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে ভারতের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই নেওয়া বাংলাদেশি শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ১ কোটিরও বেশি। এসব রাজ্য বা শহরে বিদ্যমান জনসংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শরণার্থী আসার কারণে সেখানকার বাজারঘাট থেকে শুরু করে সুপেয় পানি এবং যত্রতত্র মলমূত্রের চাপ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, খাদ্যাভাব সব মিলিয়ে এসব অঞ্চলে এক অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে ব্যাপক বিরূপ পরবর্তন হয়। ফলে এখানে সংক্রমক রোগব্যাধির দ্রুত বিস্তার ঘটে। শরণার্থী শিবিরে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে কলেরার জীবাণুর নতুন এক প্রজাতি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ সময় স্থানীয় হাটবাজার, দোকানপাট বন্ধ করে দেয়। ক্যাম্প থেকে মূল শহরের পথে যাতায়াতে কড়াকড়ি আরোপ করে। নতুন শরণার্থীদের ভারতের প্রবেশমুখে কলেরার টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মজুতে থাকা সব কলেরার টিকা এবং কলেরার স্যালাইন শরণার্থী শিবিরে সরবরাহ করে। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত সরকার বাংলাদেশি ১ কোটি শরণার্থীর থাকা, খাওয়া এবং চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৬টায় জার্মানি থেকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সানাউল হককে জানান, বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই। বেগম মুজিব ও রাসেল ছাড়া সবাইকে মনে হয় হত্যা করা হয়েছে। প্যারিসে শেখ হাসিনা ও রেহানার যাওয়ার দরকার নেই। জার্মানিতে তাদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। খবরটা শোনার সঙ্গে মুহূর্তেই বদলে গেলেন সানাউল হক এবং বললেন, আপনি আমাকে বিপদে ফেললেন কেন? বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের এই মুহূর্তে কোনো সাহায্য সহযোগিতা এমনকি একটি গাড়ি দিতেও অসম্মত হলেন। শেখ মুজিবের কন্যাদ্বয়কে নিয়ে বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়েন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। অনেক চেষ্টার পর হুমায়ুন রশীদ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সব ঘটনা শুনে তিনি তাৎক্ষণিক তাদের ভারতে পাঠিয়ে দিতে বললেন।
১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে শেখ হাসিনা ও তার পরিবার দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নেমেছিলেন। ভারতের মন্ত্রিপরিষদের একজন যুগ্মসচিব তাদের স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি দিল্লির ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি ‘সেফ হাউস’এ তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ডিফেন্স কলোনির একটি বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। ভারতের বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা ‘র’-এর একজন কর্মকর্তার সাথে ৪ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা ও তার পরিবার ১ নম্বর সফদারজং রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যান দেখা করতে। সেখানে শেখ হাসিনা ইন্দিরা গান্ধীকে সরাসরি প্রশ্ন করেন, ‘বাংলাদেশে আসলে কি ঘটেছে?’ উপস্থিত এক কর্মকর্তা জানান, তার পরিবারের অন্য কেউ বেঁচে নেই।
এ কথা শোনার পর শেখ হাসিনা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। ইন্দিরা গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রীর আসন ছেড়ে মাতৃস্নেহে শেখ হাসিনাকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন। সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার যা ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করা যাবে না। তোমার তো এক ছেলে আর এক মেয়ে আছে। আজ থেকে ছেলেকে বাবা আর মেয়েকে মা হিসেবে মনে করো।’ সাক্ষাতের পর শেখ হাসিনাকে ইন্ডিয়া গেটের কাছে পান্ডারা পার্কের ‘সি’ ব্লকে একটি ফ্ল্যাটে বসবাসের স্থান নির্ধারণ করা হয়। এখানে তিনটি বেডরুম আর কিছু আসবাবপত্র ছিল। বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে একটি টেলিভিশন দেওয়া হয়েছিল। নির্দেশনা অনুযায়ী কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে বসবাস করতেন। ঘরের বাইরে যাওয়া বা কারও সাথে দেখা সাক্ষাৎ করা নিষেধ ছিল। এমনকি আত্মপরিচয় গোপন করে তালুকদার পরিবার হিসেবে শুরু হয় দিল্লির জীবন যাপন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার পরিবার ভারতের আশ্রয়ে ছিলেন।
উপরিউক্ত ইতিহাস সঠিকভাবে বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার ১০ শতাংশ জানি কি না সন্দেহ। যদি জানতাম তাহলে কথায় কথায় ভারতের বিরুদ্ধে গলা বড় করে কথা বলতে পারতাম না। বাংলাদেশ স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র। কারও কাছে পরাধীনতা বা বশ্যতা শিকার করতে বলা হয়নি। কিন্তু যারা আমাদের জন্য পদে পদে এত কিছু করেছে, তাদের কাছে কতৃজ্ঞতা প্রকাশ তো করতে পারি? স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্য কোনো দেশ অস্ত্র নিয়ে জীবন দিয়ে সাহায্য করেনি। এতগুলো শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়নি কোনো রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর জার্মানি বা অন্য কোনো রাষ্ট্র শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়নি। আজ যে আমরা বিশ্বকাপে খেলতে পারছি সেটাও অন্য কেউ দিয়ে যায়নি। তাহলে তাদের আমরা কেন বন্ধু না ভেবে সব সময় শত্রু ভেবে যাচ্ছি!
এজন্য অনেকাংশে দায়ী বাংলদেশের মুক্তিযোদ্ধা, লেখক এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানানোর দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের। তারা সেই কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার ফলস্বরূপ বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ বেড়েছে এবং সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে।
লেখক: সাংবাদিক, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক।
এইচআর/ফারুক/এমএস