ইঁদুর-বিড়াল খেলায় হারছে স্বল্প আয়ের মানুষ
নভেম্বরের সকালে মিষ্টি রোদের ঝলকানিতে ঢাকার রাজপথের মোড়ে মোড়ে বিশাল এলাকায় ডেকারেশনের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে একদল মানুষ আয়েশ করে চা খাচ্ছে। খুশি মনে খোশগল্প করছেন আর আগামী নির্বাচনে তার এলাকায় কে কে নমিনেশন পেতে লবিং ড্যাশিং শুরু করে দিয়েছেন তার হিসাব করছেন। তারা সবাই এ সময়ের বিত্তশালী, দামি ব্যবসায়ী ও রাজনীতি করা মানুষ। তাদের একটু পাশেই দাঁড়িয়ে আরেক দল মানুষ তাদের সতর্কতার সাথে চকচকে উর্দি পরে সরকারি অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছেন।
আরেক দল মানুষ গত রাত থেকে সারাদেশের রাস্তায় সুযোগ পেলে যানবাহনে ঢিল ছুড়ছেন। বাসে অগ্নিসংযোগ করছেন। তাদের ঠেকাতে আরেক দল বা কতিপয় নানা রঙের উর্দি পরা মানুষ তৎপরতার সাথে দামি গাড়িতে চড়ে সাইরেন বাজিয়ে চকচকে টিয়ারগ্যাসের সেল ছুড়ছেন, গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে চারদিক অন্ধকার করে নিস্তব্ধ করে দিচ্ছেন। ফলে ভালো-মন্দ সবকিছুই স্থবির হয়ে গিয়ে চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ। মানুষ ঘরের বাইরে বের হতে গিয়ে জীবনের ভয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। শুধু কিছু চাকরিজীবী উর্দি যারা জীবন বাঁচানোর তাগিদে চাকরি রক্ষার জন্য কেউ অতি ভোরে হেঁটে, কেউ রিকশা-ভ্যানে চড়ে অফিসে হাজিরা দিচ্ছেন।
ডিজিটাল যুগের ছোঁয়ায় এখন আর জরুরি প্রয়োজনে বাজার যেতে হয় না, ব্যাংকে টাকা তুলতে যেতে হয় না। অনলাইন সেবা নিয়ে তারা অনেকেই ঘরে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। বাচ্চাদের নিরাপত্তার ভয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া থেকে বিরত রেখেছেন অভিভাবকরা। শিক্ষকরা অনলাইনে বসে তাদের জরুরি পাঠদান করছেন। ব্যস্ত গৃহিণীদের কাছে মনে হচ্ছে- তাদের করোনাকালীন সময়ে নিয়ে গেছে এ হরতাল, অবরোধ।
কিন্তু সমস্যা বেড়ে গেছে অন্য জায়গায়। সকাল ৮টার দিকে হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাস পেরিয়ে বড় রাস্তায় চলে গেলাম। রাস্তা পেরিয়ে একটি অস্থায়ী কাঁচাবাজারে ঢুঁ মারলাম। সঙ্গী আমার এক প্রতিবেশী কলিগ। তার সাথে প্রায়শই একসঙ্গে বের হয়ে থাকি। তরতাজা শাক-সব্জি ও মাছ পেলে তিনি কিনে ফেলেন। আজও তার লক্ষ্য সেটাই। কিন্তু সেদিন বেলা ৯টা পেরিয়ে গেলেও দোকানে ক্রেতা নেই। পরিচিত কয়েকজন দোকানি জানাল গতকালও তেমন কোনো ক্রেতা ছিল না। তাই আজ কোনো কাঁচামালের অর্ডার দেওয়া হয়নি।
এর পাশে বড় রাস্তা ঘেঁষে অনেকগুলো হকারের দোকান। তারা বিভিন্ন ধরনের কাপড়, স্যান্ডেল-জুতা, ফল, তৈজসপত্র সাজিয়ে বিষণ্ণ মনে বসে আছেন। তাদের কথা, মানুষ ভয়ে রাস্তায় বের হচ্ছে না। তাই বেচা-বিক্রি একদম বন্ধ। আমাদের বেচা-বিক্রি বন্ধ হওয়া মানে পেটে লাথি মারা।
দোকান খুললেই পুলিশ এসে তাড়া দেয়, মালামাল তল্লাশি করে, মারপিট করে, দোকান বন্ধ করে চলে যেতে বলে। এখানে ঘন ঘন পুলিশের গাড়ি এসে টহল দেওয়ায় সাধারণ মানুষ ভয়ে এদিকে আসে না। কেউ এদিকে এলেও দাঁড়াতে চায় না। রাস্তায়, ফুটপাতে মানুষ না থাকায় ক্রেতার অভাবে কপাল পুড়েছে তাদের- বলে রাগ করে জানালো আরেকজন হকার। তাদের অন্য কোনো আয়ের পথ খোলা নেই। ফুটপাতে দোকান করে আয় করাটাই সম্বল। এভাবে বিক্রি বন্ধ থাকলে তাদের পরিবারসহ না খেয়ে মরতে হবে।
‘হারবে না বাংলাদেশ’ বলে চারদিকে স্লোগান টাঙানো হয়েছে। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে সাড়ম্বরে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। অনলাইন ভিডিওতে ‘বাংলাদেশ হারবে না’- বলে উদ্দাম নৃত্যের দৃশ্য ভেসে আসছে সব সময়। তাহলে সেসব বিজ্ঞাপন কাদের জন্য? যারা প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে গিয়ে পকেটে পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে নিজের কাছে হেরে যায় তাদের বিজ্ঞাপনটা কেমন হবে?
হেরে গেছে নিম্ন আয়ের মানুষ। অথচ যারা কোনোদিন কোনো কিছুতেই হারে না তারা হরতাল অবরোধেও হারছে না। তারা কোনো দিন হারবেও না। তাদের সব ধরনের নিরাপত্তা দেবে দেশের সব সেক্টরের নিরাপত্তাকর্মীরা। ওদের সাথে নিয়ে অবরোধের সময় রাজপথের মোড়ে মোড়ে বসে তারা চা-বিস্কুট অথবা দামি রেস্তোরাঁয় কফি-স্যুপ খেতেই থাকবে! আর হেরে যাবে খেটে খাওয়া দেশের সিংহভাগ মানুষ। তারা তৈরি পোশাক কারখানার সামনের রাস্তায় সামান্য মজরি বৃদ্ধির দাবিতে নিরাপত্তাবাহিনীর সাথে ক্রমাগত ইটপাটকেল ছুড়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতেই থাকবে। এটাই কি তাদের নিয়তি?
অন্যদিকে মন্ত্রী মহোদয়গণ সেমিনারে বসে আয়েসী ভঙ্গিতে বক্তব্য দেবেন দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। একজন মন্ত্রী সেদিন আবেগপূর্ণ বক্তব্য দিতে গিয়ে আসল গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের চার কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপের সমান। এই চার কোটি মানুষ দাম দিয়ে ভালো জিনিসপত্র কিনতে পারে। সম্প্রতি ১৮তম জাতীয় ফার্নিচার মেলা উদ্বোধনের সময় বাণিজ্যমন্ত্রী এমনটি দাবি করে বক্তব্য দিয়েছেন। আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু কামাই ২৮০০ ডলার। তবে এক হিসাব অনুযায়ী আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি। তন্মধ্যে চার কোটি মানুষ ভালোমানের ফার্নিচার ক্রয় করার জন্য ক্ষমতাবান হয়েছে জেনে বেশ ভালো লাগলেও বাকি চৌদ্দ কোটি মানুষ কীভাবে তাদের প্রয়োজনীয় ফার্নিচার ক্রয় করতে পারবে সে বিষয়ে কিছু বলেননি।
এখানে ঘন ঘন পুলিশের গাড়ি এসে টহল দেওয়ায় সাধারণ মানুষ ভয়ে এদিকে আসে না। কেউ এদিকে এলেও দাঁড়াতে চায় না। রাস্তায়, ফুটপাতে মানুষ না থাকায় ক্রেতার অভাবে কপাল পুড়েছে তাদের- বলে রাগ করে জানালো আরেকজন হকার। তাদের অন্য কোনো আয়ের পথ খোলা নেই। ফুটপাতে দোকান করে আয় করাটাই তাদের সম্বল। এভাবে বিক্রি বন্ধ থাকলে তাদের পরিবারসহ না খেয়ে মরতে হবে।
এমন সময় তিনি এ বক্তব্য দিয়েছেন যখন দেশের সাধারণ মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণের নিমিত্তে অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে বাজারে গিয়ে হতাশ হয়ে শূন্য হাতে বাড়িতে ফিরে আসছেন। প্রতিদিন এ ধরনের কষ্টকর সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে।
শুধু ঢাকার কয়েকটি কাঁচাবাজারে কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মী বাজারে গিয়ে লোক দেখানো খবরদারি করে ক্ষান্ত দিয়েছেন। পণ্যের দাম কমানোর কোনো লক্ষণ জানা যায়নি। ক্যামেরার আগমন ঘটলে কোনো কোনো বাজারে কিছুটা দাম কমানোর কথা প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারি লোকজন আড়ালে চলে গেলে আবারো বাজারের দ্রব্যমূল্য আগের মতো অথবা আগের চেয়ে আরও বেশি দাম চাওয়া হচ্ছে। এতে চার কোটি বিত্তবানের কোনোরূপ অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু নিম্নআয়ের বা দরিদ্র মানুষের করুণদশা শুরু হয়েছে। নিম্নআয়ের মানুষেরা নিত্যপণ্য ক্রয়ের ক্ষমতা হারিয়ে অল্প খেয়ে অথবা না খেয়ে নিজের সাথে প্রবঞ্চনা করে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন।
অথচ দেশের সব দামি খাদ্যপণ্যই যেন বিত্তবানদের ভোগের জন্য উধাও হয়ে বড় ছোট সবধরনের হিমঘরে ঢুকে পড়ে। বাজারের কৃত্রিম সংকট বিত্তশালীদের রসনা পূজার জন্য সৃষ্ট এক আজিব আজাব বা গজব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে! বিশ দিনের ইলিশ ধরা বিরতি শেষে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও দেশের বাজার ইলিশশূন্য। অথচ, ভাই ফোটার আগে কলকাতার বাজারে বাংলাদেশি তাজা ইলিশ বিক্রি হচ্ছে বলে সংবাদ বেরিয়েছে। বিদেশে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ থাকলেও এটা কি করে সম্ভব হচ্ছে?
দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাসের এ আজিব আজাবের শিকার দরিদ্র ও নিম্নআয়ের কোটি কোটি মানুষ! এর দায়ভার কে নেবে? এই পরিবেশে তাদের পক্ষে কথা বলারও কেউ নেই। অজানা কারণে প্রচারমাধ্যমে তাদের কথা তেমনভাবে ফুটে ওঠে না। তার ওপর কর্তৃপক্ষের মুখ থেকে এমন বক্তব্য শুধু হাস্যকর নয়- বড়ই নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক!
বর্তমান দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাসের বাজারে ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’ অথবা ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়’ এসব প্রবাদবাক্য বাংলাদেশের কপট রাজনীতির মারপ্যাঁচে এখন দারুণ সাঁচাকথা হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক সহমর্মিতা বিষয়গুলো স্বল্প আয়ধারী কায়ক্লেশে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মনে নিদারুণ প্রবঞ্চনা হিসেবে দেখা দিয়ে যে কষ্টকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে তা কি কালো কাচের ঘেরে চলাফেরা করা মানবিক নেতাদের নজর ভেদ করার সুযোগ পায়? নাকি কালো বিড়াল তাদেরও কব্জা করে রেখেছে তা মোটেও বোধগম্য নয়। কালো বিড়ালরা তাদের নিজ ঘরের ইঁদুর ধরতে চায় না। তারা দেশের বেড়া কেটে গচ্ছিত সম্পদ পাচার করে দিচ্ছে এবং দেশের দুর্নাম বাড়াচ্ছে।
ডিজিটাল যুগের ছোঁয়ায় ব্যাপক আয়বৈষম্য ও ক্রয়ক্ষমতার ব্যবধান সৃষ্টি হওয়ায় মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ কমে গেছে। দরিদ্র মানুষের মরণদশার কথা কেউ আমলে নিচ্ছে না। দেশের নির্বাচন নিয়ে বড় বড় দলগুলো ইঁদুর-বিড়াল খেলা আরও বেশিদিন চলতে থাকলে এবং এভাবে ক্রমাগত কেউ কারও মতামতকে শ্রদ্ধা না করে বাহাদুরি করতে থাকলে তাদের আদৌ কোনো কষ্ট হবে না। কিন্তু অবর্ণনীয় কষ্ট পেতে থাকবে ক্রয়ক্ষমতা হারানো দেশের ৭০-৭৫ শতাংশ মানুষ। এভাবে ক্রমাগত অন্যায়, সামাজিক অবিচার, অভাব, অপুষ্টির শিকার হয়ে তাহলে তারা কি ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ যাবে? তারাও কোনোভাবে হারতে চায় না।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। [email protected]
এইচআর/ফারুক/জেআইএম