নগর পরিকল্পনা স্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে
আজ বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবস। এবারের বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে “Learn Globally, Apply Locally”. ১৯৪৯ সালে বুয়েনস আইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক কার্লোস মারিয়া ডেলা পাওলো নগর পরিকল্পনার পেশাদার আগ্রহকে প্রচার করার লক্ষ্যে এ দিনটি চালু করেন। বসবাসযোগ্য পৃথিবী তৈরিতে পরিকল্পনার ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়া এবং প্রচার করার জন্য এটি একটি বিশেষ দিন।
নগর পরিকল্পনা একটি বাস্তবমুখী বিষয়। বৈশ্বিকভাবে নেয়া এসডিজি ২০৩০ অর্থাৎ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্বের ১৯১টি দেশ। এরমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এসডিজি এর ১১ নম্বর লক্ষ্যটি হল টেকসই নগর সম্পর্কিত। টেকসই নগর তৈরি করার জন্য নগর পরিকল্পনায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি শহর এলাকাই তার নিজস্ব বিশিষ্ট নিয়ে স্বতন্ত্র। এক এক শহরের জন্য চ্যালেঞ্জ এক এক রকম। যেমন ঢাকা শহরের জন্য নগর পরিকল্পনা হতে হবে এই শহরের মানুষদেরকে নিয়ে।
বাংলাদেশের আদমশুমারি ও গৃহগণনা, ২০২২ অনুসারে, বাংলাদেশের প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষ শহর এলাকায় বসবাস করে। এর পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষ শুধু মাত্র ঢাকা শহরেই বসবাস করে। বর্তমানে এত মানুষের জন্য বাসযোগ্য শহর গড়ে তলার জন্য নগর পরিকল্পনার বিকল্প নেই।
ঢাকা শহরের অন্যতম সমস্যা হল যানজট। এই সমস্যার মূলেও রয়েছে ঢাকা শহরের অতিরিক্ত মানুষ যারা জীবিকা অর্জনের জন্য প্রতিদিন যাতায়াত করে এই শহরের বুকে। গত ৪ নভেম্বর মতিঝিল-উত্তরা মেট্রোরেল এর উদ্বোধন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা শহরের যানজট মোকাবিলায় এ ধরনের প্রকল্প আশীর্বাদস্বরূপ, যার ফলাফল ঢাকা শহরের মানুষ অল্প কিছুদিনের মাঝেই পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মানুষের জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট একদিকে যেমন যানজট কমাতে সাহায্য করবে অন্যদিকে পরিবেশদূষণও রোধ করবে।
রাজধানী ঢাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথেই কমেছে খেলার মাঠ। গত ২২ বছরে ঢাকা শহরে উন্মুক্ত মাঠের সংখ্যা ১৫০ টি থেকে কমে ২৪ টিরও নিচে নেমে গেছে। যার ফলে শিশু কিশোররা খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খেলার মাঠ কমে যাওয়া সমাজের জন্য অশনী সংকেত কারণ , শিশু কিশোররা মাঠে খেলার সুযোগ না পেলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধিত হবে না অন্যদিকে এই শিশু কিশোররাই নানাবিধ অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়বে।
নগর পরিকল্পনা একটি বাস্তবমুখী বিষয়। বৈশ্বিকভাবে নেয়া এসডিজি ২০৩০ অর্থাৎ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্বের ১৯১টি দেশ। এরমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এসডিজি এর ১১ নম্বর লক্ষ্যটি হল টেকসই নগর সম্পর্কিত। টেকসই নগর তৈরি করার জন্য নগর পরিকল্পনায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি শহর এলাকাই তার নিজস্ব বিশিষ্ট নিয়ে স্বতন্ত্র। এক এক শহরের জন্য চ্যালেঞ্জ এক এক রকম। যেমন ঢাকা শহরের জন্য নগর পরিকল্পনা হতে হবে এই শহরের মানুষদেরকে নিয়ে।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন শহরের বিভিন্ন স্থানে খেলার মাঠ সংস্কার ও নির্মাণ করলেও তা প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত, যার ফলে উন্মুক্ত মাঠের অপর্যাপ্ততা থেকেই যাচ্ছে। এই সংকট মোকাবেলায় পরিকল্পিত খেলার মাঠের কোনো বিকল্প নাই। দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে যদি ন্যূনতম একটি করে খেলার মাঠ প্রস্তুত করা যায় তবে শিশু কিশোররা আবার মাঠে ফিরবে যার ফলে শিশু কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সাথে সাথে সুস্থ সমাজ পাওয়ার আশা করা যায়।
কোনো স্থানের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য ন্যূনতম ২৫ ভাগ সবুজ প্রয়োজন অর্থাৎ যেকোনো শহরে অন্তত ২৫ ভাগ গাছপালা থাকা জরুরি। কিন্তু আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, ঢাকা শহরে সবুজ রঙটাই অপ্রতুল। যে কয়েকটি স্থানে গাছ রয়েছে তা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের নামে দেদারছে আমরা গাছ কাটছি যার ফলশ্রুতিতে এই বছর অসহনীয় গরমের দেখা পেয়েছে নগরবাসীসহ সারা বাংলাদেশ।
স্থাপনাগত উন্নয়ন এর নামে যদি এভাবে গাছ ধ্বংস হয় তবে খুব অচিরেই ঢাকার বুকে মরুভূমি ও মরুভূমির তপ্ত গরমের সন্ধান মিলবে। স্থাপনাগত উন্নয়নের সাথে সাথে যদি পরিকল্পিত ভাবে বাড়ির ছাদে, রাস্তার দু’পাশে, লেকের ধারে, খোলা ময়দানে গাছ লাগানোর মাধ্যমে সবুজ বিপ্লব করা যায় তবে এই সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হবে।
ঢাকা শহরের পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০২২-৩৫ প্রণয়ন করা হয়েছে যেখানে ঢাকায় নগর পরিকল্পনার সকল দিক বিবেচনা করে নিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের জন্য জোর দেয়া হয়েছে। যেহেতু ঢাকা একটি দ্রুত উন্নয়নশীল এলাকা, এই দ্রুত উন্নয়ন যেন পরিকল্পিত উপায়ে হতে পারে তার জন্যই ড্যাপ এর বিধিমালা প্রণিত হয়েছে। এছাড়াও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮-কে সংশোধন ও পরিমার্জন করে সময়োপযোগী করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
নগর পরিকল্পনার বিভিন্ন অভিনব পদ্ধতি বাংলাদেশের মানুষের কাছে অপরিচিত বিধায় এখনো নগর পরিকল্পনার প্রকৃত সুফল বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়াও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন চাপের কারণে অনেক পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে আরবান রিএডজাসমেন্ট এর কথা। এটি এমন একটি উপায় যার মাধ্যমে একটি নগর এলাকায় পরিকল্পিতভাবে সকল সাধারণ সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে উন্নয়ন সম্ভব।
এই পদ্ধতিতে কিছু মালিকের জমি একসাথে করে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সকল সাধারণ সুবিধা দিয়ে তাদের জমির মালিকানা আবার ফেরত দিয়ে দেয়া হয়। এতে একদিকে যেমন জমির মালিকদের উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন সুবিধার জন্য যেতে হয় না অন্যদিকে একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা পাওয়া যায়। এটা বাস্তবায়নের জন্য দরকার হয় সুবিধা প্রদানকারী বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাঝে সমন্বয় এবং ঐ এলাকার মানুষদের সহযোগিতা। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সমন্বয় সাধন একদিকে যেমন সম্ভব হয় না অন্য দিকে জনগণের মাঝেও এক ধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করে যে জমির মালিকানা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে দেয়া নিয়ে।
এমন আরেকটি পদ্ধতি হল সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস স্কিম যা মূলত নিন্ম আয়ের মানুষদের সাশ্রয়ী আবাসন নিশ্চিতের জন্য নেয়া হয়। এই পদ্ধতিতে নিন্ম আয়ের মানুষদের জন্য জায়গা ঠিক করে সেখানে সকল সাধারণ সুবিধা, গ্যাস, বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে কিস্তিতে অথবা কম মূল্যে আবাসন দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে ঐ আবাসন এর বরাদ্দ প্রকৃত নিন্ম আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছায় না আবার অনেক ক্ষেত্রে তাদের কাছে বরাদ্দ গেলেও জীবিকার ব্যয়, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল দিয়ে সেই আবাসন এ থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। যার ফলে তারা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়।
এমন সকল বাধা অতিক্রম করে সঠিক নগর পরিকল্পনা যদি বাংলাদেশের স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া যায় তবেই নগর পরিকল্পনার প্রকৃত সুফল পাওয়া সম্ভব হবে।
লেখক: পরিকল্পনাবিদ, (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হতে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং পরিকল্পনা পরামর্শক কার্যক্রমসহ নির্মাণ ব্যবসার সাথে যুক্ত, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক)।
এইচআর/জেআইএম