ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ভিসানীতির পরোয়া ও বিচলিত বচন

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:২৫ এএম, ২১ অক্টোবর ২০২৩

 

বেশ কয়েক বছর আগে থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বহু দেশে তাদের ভিসানীতিতে নিত্যনতুন শর্ত জুড়ে দিয়ে আসছে। এটা একদিকে তাদের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে এটাকে দেশে দেশে কর্তৃত্ব ফলানোর কৌশল অথবা চাপ হিসেবে মনে করা হয়। এছাড়া কোনো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, নিপীড়ন বা অপকর্ম হচ্ছে এমন যুক্তি দিয়ে তারা বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা ও ধমকের মাধ্যমে নতুন নির্দেশনা জারি করে। যতদূর জানা যায়, যেখানে তাদের স্ট্র্যাটেজিক দৃষ্টি পড়ে সেখানেই এই নীতি নতুন করে সাজানো ও আরোপের ব্যাপার ঘটে।

ব্যান ৩.০ অথবা ৪.০ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে উত্তর কোরিয়া, ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া, ইয়েমেন, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, মালি, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, কঙ্গো, জিম্বাবুয়ে, কিউবা, মেক্সিকো, চীন, বেলারুশ প্রভৃতি দেশে। ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত এই ২১টি দেশ ছাড়াও সম্প্রতি নাইজেরিয়া, উগান্ডা, সোমালিয়া ও বাংলাদেশ এবং আরও নাম না জানা অনেক দেশে তাদের নতুন ভিসানীতি বর্তানোর কথা শোনা যাচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি অঙ্গনের মতো এত চাপ ও তোলপাড় অন্য কোনো দেশে শোনা যায়নি।

বাংলাদেশের জন্য ২০২৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন ভিসানীতি আরোপ করার কথা প্রচার করা হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেটা প্রচারিত হলেও সরকারিভাবে এখনও কোনো ঘোষণা জানা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম করে তুলেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য হলো এ নীতি বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য বলবৎ করা হয়নি। কতিপয় মানুষ যারা দেশে সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান করবে শুধু তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ সবাই সবসময় মার্কিন ভিসা নিয়ে মাথা ঘামায় না। এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ভিসানীতির কথা জানে না, বোঝেও না। তাই তারা এ বিষয়ে মোটেই বিচলিত নয়।

অন্যদিকে মার্কিন ভিসানীতি বিষয়ে যারা ওয়াকিবহাল তারা এই নীতি আরোপের কথা জানার পর কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছেন। যারা ভেবেছিল এটা এমন আর নতুন কি তারা এর বলবৎ প্রক্রিয়া কার্যকরী হওয়ার পর অনেকটা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। অনেকে নতুন ভিসানীতিকে সেই ঈশপের গল্পের রাখাল বালকের গরুর পালে বাঘ এসেছে বলে মিছেমিছি চিৎকার করার ঘটনা মনে করে তোয়াক্কা না করার কথা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু সত্যি সত্যি বাঘ এসে পড়ায় তারা হতচকিত হয়ে উঠেছেন। এখন কি করবেন বুঝতে না পেরে চলনে বলনে, অঙ্গভঙ্গিতে নানা মন্তব্য ও উষ্মা প্রকাশ করে চলেছেন। কেউ নিজেকে বলছেন ভিসানীতি এসে গেছে, এখন মজাটা বুঝবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, ভিসানীতিকে পরোয়া করি না। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তাদের বক্তব্যের ভাষা ও দৈহিক আচরণে প্রকাশ করা হচ্ছে সেসব বেপরোয়া ভাবভঙ্গিমা। আমাদের নেতা-আমলা ছাড়াও গণমাধ্যমের একাংশও অনেকটা বিচলিত হয়ে পড়েছেন। ৩ অক্টোবর তারা প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছেন।

সর্বজনীন মোবাইল ক্যামেরার শক্তিশালী পিক্সেল ও আধুনিক ক্লিয়ার জুমের সুবাদে তাদের সেসব ভঙ্গিমা নানা অ্যাঙ্গেলে রেকর্ড হয়ে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বের মানুষের চোখের পর্দায়। সুতরাং সেসব ভাবভঙ্গিমার ব্যবচ্ছেদ করতে তারা কেন দেরি করবে? শুধু কি তাই? মানুষ মজা করার জন্য অথবা টিজ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা কেউ বলছেন, ‘আঙ্গুর ফল টক’- সেটা শিয়াল কখন বলে? ঈসপের গল্প পড়া একজন বাচ্চাও সেটা বোঝে। যারা এতদিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ পাচার করে গোঁফে তা দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন সেসব আমলা-নেতাদের বাইরে ফিটফাট ভেতরে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে বলে মনে হয়। কেউ আবার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গিয়েও ভিসানীতির কথা বলে বেপরোয়া ভাষায় পরোয়া করি না বলে মুখ খুলছেন। সেখানে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও শালীনতাটাও ভুলে বসেছেন তারা। অবৈধ অর্থপাচারকারীদের মুখ ও বুক দুটোই ফেটে যাচ্ছে। কারণটা হলো বিদেশে জমা করা অর্থ সম্পদ বেহাত হয়ে যাওয়ার অজানা ভয়।

তাইতো তারা ভিসানীতির কথা নিয়ে দেশ-বিদেশ সব অঙ্গন তোলপাড় করে তুলছেন। কারও কারও বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি ও আত্মম্ভরিতামূলক হুংকারের ভিডিও দেখার জন্য অনেকে নতুন করে টিভিতে খবর দেখা শুরু করেছেন! আবার অনেকে চোখ রাখছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। এতে ‘তুমি সুড়ং’ তৈরিকারীদের কিছুটা লাভ হয়েছে। তাদের লাইক-হিট বেড়ে আয়ের ব্যাপ্তি বেড়ে গেছে।

কিন্তু ভিসানীতি বলবৎ করার ফলে যে ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে তা খুবই ভয়ংকর বলে অর্থনীতিবিদ মতামত দিচ্ছেন। একটি পত্রিকা বলেছে, মার্কিন ভিসানীতি বলবৎ করার কারণে সবার আগে যে বড় আশঙ্কা সেটা হলো- ‘দেশের পোশাক শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীরা পথে বসে যাবে।’ এতে দেশের বৈদেশিক আয় কমে যাবে এবং শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতি ঘটে শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হবে। যেটা আমাদের দেশের মতো উঠতি অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ঝুঁকি।

পত্রিকাটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থের সম্পর্ক। এখানে বাংলাদেশের সম্পর্কটা স্বার্থের দিকে বড়। কিন্তু সেই সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। ‘সরকার অনেকগুলো ফাঁদ তৈরি করে ফেলেছে। এই ফাঁদ থেকে সহসাই বের হওয়ার উপায় নেই।’

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির মতে আরেকটি আশঙ্কার কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে একই ধরনের অবরোধের ঘোষণা আসতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে ভয়েস অব আমেরিকায় প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে আমাদের দেশের কর্ণধার সাহসী বক্তব্য দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে প্রচারণা শোনা গেছে। তা হলো- ‘আমাদের দেশের অভ্যন্তরে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি শুরু হয়েছে।’

কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অর্ডার ও রপ্তানি বন্ধ হলে বর্তমানে যে লাখ লাখ শ্রমিক কর্মরত রয়েছে তারা চাকরি হারাতে পারে এবং শ্রমিকরা বেকার হয়ে গেলে তাদের জন্য সমপরিমাণ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ আমাদের দেশে নেই বা সহসা গড়ে উঠবে না। সুতরাং তৈরি পোশাক শিল্পের অর্ডার ও রপ্তানি বন্ধ হলে সেটা দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর দুর্দিন ডেকে আনতে পারে।

এছাড়া নতুন ভিসানীতি ব্যান ৩.০ অথবা ৪.০ নিষেধাজ্ঞা শ্রমিকদের জন্য নতুন ভিসা বন্ধের সংকেত দিচ্ছে। পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে অথবা তাদের মিত্র এমন দেশে-বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের ভিসা নবায়ন না করে দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ জারি হতে পারে। সেটা শুরু হলে আরও ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আমাদের মনে আছে ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখলের সময় মাত্র ৩০ হাজার কুয়েত ফেরত শ্রমিককে সামলানো কতটা ভয়ংকর বিপদের ব্যাপার ছিল। তখন সেটা মানবিক বিষয় হওয়ায় তাদের বিশ্বের অন্যান্য দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ভিসা ব্যান আরোপ হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও আমাদের দরজা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ তখন অনেক দেশ নিজেরা ওদের ব্যান পাওয়ার ভয়ে আমাদের শ্রমিকদের গ্রহণ করতে চাইবে না। অন্যদিকে রাশিয়া, চীন, ভারত, ব্রাজিল ইত্যাদি দেশে আমাদের শ্রমিকদের নতুন করে কর্মসংস্থান লাভের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তাই নিজেরাই মার্কিন ও ইউরোপের বাজারে শ্রম বিক্রি করে।

বাংলাদেশের মানুষ অকুতোভয়। এদেশে জলে কুমির ও ডাঙ্গায় বাঘের সাথে মানুষের নিত্য বসতি। তাই কোনো কিছুকে ‘পরোয়া করি না’ বলে প্রত্যয় তৈরি করে মনের সাহস বাড়িয়ে সামনে চলার পথ খুঁজতে চেষ্টা করা আমাদের একটা অতীত ঐতিহ্য। কিন্তু সে যুগ পাল্টেছে।

এখন শুধু মুখের শক্ত কথায় কাজ উদ্ধার করা মুশকিল। এ যুগে কৌশলী না হলে রাস্তার বিপদ এড়ানো যায় না। মসৃণ রাস্তায় ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বেপরোয়া গতিতে চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় মারাত্মকভাবে। ড্রাইভারকে রাস্তার সব যানবাহন ও মানুষকে ‘পরোয়া বা কেয়ার’ করেই গাড়ি চালাতে হয়। নতুবা একটু বেপরোয়া বা বেসামাল হলেই ঘটে ক্ষতি।

একসঙ্গে মার্কিন ও ইউরোপের ‘ভিসা ব্যান’ পুরোপুরি আরোপ হলে আমাদের মতো বেপরোয়া গতির গাড়ির ভেতরে বসা সবার জন্য মহাবিপদের কারণ হতে পারে। ভিসা ব্যান ছাড়াও অর্থনীতিবিদরা ‘ট্রেড ব্যান’ আসতে পারে বলে ইতোমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পরোয়া ও দরকষাকষির বিষয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত করে এবং কপট রাখালদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। এভাবে পারস্পরিক আস্থার ফলে দেশীয় সমাজ হয় সুখময় ও বিশ্বসমাজ হয়ে ওঠে শান্তিপূর্ণ।

তাই ভিসানীতির বাঘ ঠেকাতে বেপরোয়া রাখালদের কৌশলী না হওয়াটা নিজের ও সবার জন্য বিপদ। বাংলাদেশ এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে মানুষের পেটে ভাত না থাকলেও ভোটের জন্য গুলি খেতে দ্বিধা করে না। তাই সামনের নির্বাচনের আগে সবার মন ও মত বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে ‘ট্রেড ব্যান’ ঠেকাতে নমনীয় না হলে দেশের শ্রমজীবী মানুষের বড় অকল্যাণ এড়ানো কঠিন হবে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস