বিশ্ব খাদ্য দিবস
খাদ্য অপচয় বনাম ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার
ফেসবুকের সবকিছু বিশ্বাস করি না। কিন্তু বছরখানেক আগে বন্ধু সোহাগের শেয়ার করা একটা ছবি দেখে কষ্টে বুকটা টনটন করে উঠলো। নিদারুণ বাস্তবতার করুণ সত্য একটি দৃশ্য। তাগিদ বোধ করলাম, বিষয়টা নিয়ে কিছু লিখা উচিত। ছবিটা রেখে দিলাম টাইমলাইনে।
বলছিলাম বিশ্ববিখ্যাত ফটোগ্রাফার কেভিন কার্টারের পৃথিবী কাঁপানো ছবিটার কথা। এখানে শকুনটা অপেক্ষা করছে ছোট্ট শিশুটার মৃত্যুর জন্য। বাচ্চাটা মারা গেলে তার মাংস খাবে। ফটোগ্রাফার এ ছবিটি তুলেছিলেন ১৯৯৪ সালে সুদানে জাতিসংঘের খাদ্যগুদামের কাছে, যা আলোড়ন তুলেছিল সারা দুনিয়ায়। পরে এ ছবিটার জন্য কেভিন পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন।
ছবিটা তোলার পর থেকেই কার্টার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। আর এর তিন মাসের মাথায় আত্মহত্যা করেন। এর আগে কেভিন তার ডায়রিতে লিখে যান- ঈশ্বর যেন শিশুটিকে তার কষ্ট থেকে মুক্তি দেন। আর বিশ্ববাসীর কাছে মিনতি করেন, আমরা যেন কেউ খাবার নষ্ট না করি।
বিশ্বে প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। অথচ কিছু মানুষ খামখেয়ালি করে বিপুল পরিমাণ খাবার অপচয় করছে প্রতিনিয়ত। একদিকে ক্ষুধার্ত মানুষের কঙ্কালসার দেহ, আরেকদিকে প্লেটভর্তি নষ্ট করা খাবার। পৃথিবীর জন্য এ এক চরম বাস্তবতা।
আপনি কী জানেন, বিশ্বে প্রতিদিন কতো মানুষ খাবারের কষ্ট করে? আর কী পরিমাণ খাবার খামখেয়ালিপনায় নষ্ট হয়? জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-এফএও’র প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে প্রতি মাসে ১০ হাজার শিশু মারা যায় খাদ্যের অভাবে। আর প্রতি রাতে না খেয়ে ঘুমায় ৮২ হাজার মানুষ। অথচ বিশ্বে উৎপাদিত খাবারের ১৪০ কোটি টন মানুষ নষ্ট করে, যা মোট উৎপাদনের তিন ভাগের এক ভাগ। এ খাবার দিয়ে প্রতি বছর ২০০ কোটি মানুষকে পেট ভরে খাওয়ানো সম্ভব!
এ তো গেলো সারা বিশ্বের কথা। বাংলাদেশের দিকে নজর দিলে আরও হতাশ হতে হয়। কিছুদিন আগে একটি দাওয়াতে গিয়েছিলাম। ঘেরা, খোলা জায়গায় বিশাল আয়োজন। বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে সুস্বাদু খাবারে ঘ্রাণ। প্যান্ডেলের দিকে এগোচ্ছি। দেখি বাইরে একটা জটলা। পাড়ার জীর্ণ মধ্যবয়সী আজমত চাচাকে ভর্ৎসনা করা হচ্ছে। কারণ দাওয়াত ছাড়াই তিনি মেহমানদের সারিতে বসতে যাচ্ছিলেন।
আজ ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস। বিশ্বব্যাপী সচেতনতা এবং সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিতের সঙ্কল্প উদ্দেশ্য করে এই দিনটি পালিত হয়। শুধু সরকারি পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে না থেকে, বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রাক্কালে সবার অঙ্গীকার হোক- আমরা যে যার অবস্থান থেকে খাদ্য অপচয় বন্ধে সচেষ্ট ও তৎপর থাকবো।
লজ্জায় অবনত মুখে একটু দূরে গিয়ে বসলেন আজমত। কষ্ট লাগলো। জানি না পরে আজমত চাচা খেতে পেরেছিলেন কি না। কিন্তু খাওয়া শেষে মেহমানদের খাবার নষ্টের যে মহোৎসব দেখলাম, তাতে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো! আহারে বেচারা আজমত! যে পরিমাণ খাবার নষ্ট হচ্ছে, তাতে শত আজমতকে খাওয়ানো যেতো!
এ দৃশ্য শুধু এক পাড়া বা এক মহল্লার নয়, এ দৃশ্য গোটা দেশের। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠান বা দাওয়াত এবং অনেক বিত্তবানের বাড়িতে খাবার অপচয়ের বহর দেখলে মনে হয়। খাবার অপচয় করাই যেন এখন ‘স্মার্টনেস’। খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ঘরে তোলা এবং থালা পর্যন্ত নানাভাবে খাবারের অপচয় হয়।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে, বাংলাদেশে বছরে ১.৪৫ কোটি টন খাদ্য অপচয় হয়, যা দিয়ে ১৬ কোটি মানুষকে তিন মাস খাওয়ানো সম্ভব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যখন বিশ্বজুড়ে খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের শঙ্কা, তখন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভয়ঙ্কর এই তথ্য।
বর্তমানে দেশে খাদ্য সমস্যা নেই। তবে আগামী দিনে দেখা দিতে পারে সংকট। এই আশঙ্কা একাধিকবার করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বে খাদ্য সংকট এড়াতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা- এফএও’র সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। এর পঞ্চম দফায় খাদ্য অপচয় রোধে সবাইকে সচেতন হওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এই সুপারিশগুলো বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে।
বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা এখন মধ্যম আয়ে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু দেশে মাথাপিছু খাদ্য অপচয়ের যে হিসাব তা অনেক বেশি। এফএও’র গবেষণা মতে, বাংলাদেশের খাদ্য অপচয়ের অন্যতম প্রধান কারণগুলো হলো, কৃষিতে প্রযুক্তির কম ব্যবহার, সংরক্ষণের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকা। কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে থাকার আলোচনায় যাচ্ছি না। কিন্তু এখানকার খাদ্য সংরক্ষণ সক্ষমতার চিত্র দেখুন, দেশে পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ নেই।
খাদ্য দফতরের গুদামে ১৮ লাখ টন চাল ও গম সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু সেগুলোর বেশিরভাগেরই ভগ্নদশা। গোডাউনের ভেতরে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে অনেক খাবার পচে যাচ্ছে। অথচ আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করা হবে বা হচ্ছে মর্মে সংশ্লিষ্টদের গতানুগতিক ফাঁকা বুলি শুনলে হতাশ হতে হয়।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে দেশে খাদ্য সমস্যা সমাধানে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং খাদ্যের অপচয় রোধ এখন সময়ের দাবি। ব্যক্তিগত হোক বা সরকারিভাবেই হোক, সদিচ্ছা থাকলেই খাদ্য অপচয় রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। আর শুধু অপচয় বন্ধ করেই সম্ভব ক্ষুধার্ত মানুষের অন্নের সংকুলান করা।
আজ ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস। বিশ্বব্যাপী সচেতনতা এবং সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিতের সঙ্কল্প উদ্দেশ্য করে এই দিনটি পালিত হয়। তাই শুধু সরকারি পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে না থেকে, বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রাক্কালে সবার অঙ্গীকার হোক- আমরা যে যার অবস্থান থেকে খাদ্য অপচয় বন্ধে সচেষ্ট ও তৎপর থাকবো।
লেখক: সহযোগী বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম