আসন্ন দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচন ও মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে আসার পথে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উন্নয়ন প্রকল্প দেখেছে, যা মেগা প্রকল্প হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’ হিসেবে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে টেকসই ভবিষ্যতের জন্য কার্যকরভাবে বীজ রোপণ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু রেল সংযোগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন। এটি ৮০ মিলিয়ন মানুষকে সরাসরি উপকৃত করবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এটা স্পষ্ট যে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের বিদ্যুৎ, পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি স্মারক নির্মাণ প্রকল্প শুরু করে। এর মধ্যে অনেকগুলো ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকিগুলোর কাজ চলছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এমন কয়েকটি মেগা প্রকল্প, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি উদ্বোধন করেছেন। বিদ্যমান ভৌত অবকাঠামোর আধুনিকীকরণ এবং একটি আদর্শ ব্যবসায়িক পরিবেশ বিকাশের মাধ্যমে, উদ্যোগগুলো অর্থনৈতিক মার্জিন এবং নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশকে বিশেষভাবে লাভজনক করার লক্ষ্য রাখে।
বিশ্বের দ্বিতীয় দ্রুতবর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশ আইএমএফের পরবর্তী ১১টি উদীয়মান বাজার অর্থনীতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং এটি একটি সীমান্ত বাজার হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিশ্বে ৩৪তম অবস্থানে থাকলেও ২০৩৬ সালের মধ্যে এটি ২৪তম স্থানে উন্নীত হবে এবং ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা দেশে পরিণত হবে।
বাংলাদেশের জিডিপি ২০৪০ সালের মধ্যে বর্তমান ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ তার ‘ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্পগুলো’ নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। দেশটি তার মেগা প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগের সুবিধাগুলো প্রদর্শনের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার আশা করে, যার মধ্যে লজিস্টিক সহায়তা এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের কলামিস্ট বেঞ্জামিন পার্কিন সম্প্রতি বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে সাফল্যের গল্পে রূপান্তরিত করার জন্য বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বের ‘অগ্রগতির যাত্রার’ প্রশংসা করেছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়লেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি বলে দাবি করেন তিনি। চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প লাখ লাখ মানুষকে গ্রামীণ দারিদ্র্য থেকে উচ্চ বেতনের শহুরে পেশায় আকৃষ্ট করেছে।
বিগত ১৫ বছরে দারিদ্র্য অর্ধেকে নেমে এসেছে, প্রায় ২০ শতাংশে। বিশ্লেষক বেঞ্জামিন পার্কিনের দেখানো একটি গ্রাফ দেখিয়েছে যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কীভাবে শ্রীলঙ্কা ও ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে তিনি বাংলাদেশকে তার অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন, যা মূলত পোশাক রফতানির (প্রায় ৮৫%) ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারের ট্রাম্প কার্ড হবে দেশের মেগা প্রকল্পগুলো। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতির জন্য প্রথম উপহার পদ্মা সেতু ছিল ক্ষমতাসীন দলের জন্য একটি বড় নির্বাচনী কার্ড, কারণ এটি রাজধানীকে দক্ষিণের ২১টি জেলার সাথে সংযুক্ত করেছিল, শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের স্থিতিশীল এবং কম খরচে সরবরাহ নিশ্চিত করেছিল।
সম্প্রসারিত সংযোগ শুধু ব্যক্তিদের জন্য ভ্রমণের সময় হ্রাস করে না বরং বিস্তৃত বাণিজ্য সম্ভাবনা এবং অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের জন্য আরও সুযোগ উৎসাহিত করে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের আগস্টের জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ উত্তরদাতা গত বছর চালু হওয়া ৩.৬ বিলিয়ন ডলারের পদ্মা সেতুকে ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
‘সবার জন্য বিদ্যুৎ’ বর্তমান প্রশাসনের একটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প এবং মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প এই স্লোগান বাস্তবায়িত করার পথে রয়েছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের কাজ ডিসেম্বরে শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি দ্রুত বন্দর সেবা ও সমন্বিত সংযোগ প্রদানের মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য বৃদ্ধি করবে।
গত মাসে প্রধানমন্ত্রী রাজধানী ও এর আশেপাশের যানজট নিরসনে ১১ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেন। ২৮ অক্টোবর তিনি চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল উদ্বোধন করবেন, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম টানেল এবং বাংলাদেশকে টানেল যুগে নিয়ে যাবে। তার সরকার ঢাকা থেকে কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ চালু করতে যাচ্ছে। ফলে পর্যটকসহ নিয়মিত যাত্রীদের জন্য ট্রানজিট ব্যবস্থা এগিয়ে যাবে।
আগামী নির্বাচনের আগে এসব উদ্যোগ দৃশ্যমান হলে তরুণ ভোটাররা আকৃষ্ট হবে; একইভাবে এই সাফল্যগুলো নির্বাচনী রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশিষ্ট লেখক বেঞ্জামিন পার্কিনও মনে করেন, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি নারী নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেকর্ড পঞ্চম মেয়াদে তার নির্বাচনী প্রচারণা জোরদার করায় বড় বড় প্রকল্পের সমাপ্তির একটি নির্বাচনী মাত্রা রয়েছে।
পার্কিনের মতে, দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে এবং জনগণের কল্যাণের উন্নতির জন্য সম্প্রতি বড় আকারের প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হওয়ার ফলে ভোটারদের মন দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করবে। তিনি বলেন, জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে শেখ হাসিনা ভোটারদের কাছে যে বার্তা দিচ্ছেন তার মূল অংশ হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন।
এই সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণটি অদূর ভবিষ্যতে দেশের প্রবৃদ্ধি কেমন হবে তার একটি পূর্বরূপ সরবরাহ করে। এই পর্যায়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো যে কোনো মূল্যে নির্বাচন সম্পর্কিত যে কোনো উল্লেখযোগ্য অস্থিরতা রোধ নিশ্চিত করা। এই ‘উচ্চমানসম্পন্ন প্রকল্পগুলো’ প্রত্যাখ্যান করার কোনো উপায় নেই, যা বর্তমান ‘উন্নয়ন অর্থনীতির’ ধারণা ব্যবহার করে দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করছে। যে প্রকল্পগুলো চালু করা হয়েছিল তা ইতিমধ্যে লাখ লাখ মানুষকে উপকৃত করেছে। এটি আসন্ন নির্বাচনে বর্তমান সরকারকে উপকৃত করতে পারে। কারণ এর ফলে আসন্ন নির্বাচনে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণ এই সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এএসএম