অক্টোবর যে গেল!
একটা চাপা উত্তেজনা ছিল, বলতে গেলে এখনও আছে যে, এই অক্টোবর মাসই হবে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর জন্য তাদের দাবির চূড়ান্ত ফায়সালার মাস। রাশিয়ার সেই ঐতিহাসিক অক্টোবর বিপ্লবের মতো নাম দেয়া হয়েছিল অক্টোবর আন্দোলন। বিএনপির নেতারা জনসভাগুলোতে এমনটা বলেছিলেন। বিএনপির হয়ে যারা দেশের বাইরে থেকে আন্দোলনে গতি সঞ্চারের চেষ্টা করে সেই ফেসবুকার আর ইউটিউবাররাও বলেছিলেন অক্টোবরেই শেষ সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপ দেখতে দেখতে দুই একজন সম্পাদক ও বিশ্লেষকও বলেছিলেন অক্টোবরেই আসছে মার্কিনী ঝড়।
অক্টোবরের মাঝামাঝি এখন। গত এক বছর ধরে চূড়ান্ত পর্বের আন্দোলন করছে বিএনপি। অক্টোবরেই সেই আন্দোলনের ইতিবাচক ফলাফল তারা পাবেন বলে বলেছিলেন। এখন পর্যন্ত সেই লক্ষণ স্পষ্ট নয়, যদিও মাসের অর্ধেক এখনও বাকি আছে এবং এই সময়ে আন্দোলন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা বলা কঠিন।
বিএনপি মাঠে যতটা না আন্দোলন কার্যকর করতে পেরেছে তার চেয়ে বেশি পেরেছে সামাজিক মাধ্যমে। এবং তার এই আন্দোলনের মাঝেই আসে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি। এই ভিসানীতির দ্বারা উদ্বেলিত বিএনপি মনে করছে মার্কিন চাপেই সরকার নতি স্বীকার করে বাধ্য হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকরের অধীনে নির্বাচন দিতে।
একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, ভিসানীতি বা মার্কিন অবরোধের শঙ্কা আগামী দ্বাদশ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে পারবে কিনা তা নিশ্চিত না হলেও সরকারের আচরণে পরিবর্তন এনেছে। বিরোধী দল আগে মাঠে নামতে পারতো না। এখন তারা নির্বিঘ্নে সভাসমাবেশ, রোডমার্চ করতে পারছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বারবার বলছেন বিএনপি নির্বিঘ্নে আন্দোলন করতে পারবে, তবে সহিংসতা যেন না করে।
গত ৭ অক্টোবর ঢাকায় শিক্ষক সমাবেশের মধ্য দিয়ে বিএনপির অক্টোবর আন্দোলন কর্মসূচি শুরু হয়। খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে ঢাকাসহ সারা দেশে জেলা-মহানগরে সমাবেশ ও মিছিল, সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ঢাকায় ছাত্র কনভেনশন যুব সমাবেশ শেষে আগামী ১৮ অক্টোবর ঢাকায় জনসমাবেশ করকে দলটি।
আপাতত এটুকুই। কারণ হলো হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা সমাগত। এ কারণে ২০ অক্টোবর থেকে ২৪ অক্টোবর পাঁচদিন ঢাকাসহ সারাদেশে বিএনপির কোনো কর্মসূচি থাকবে না। দুর্গাপূজায় কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে বিএনপির ওপর দায় যেন না আসে সে বিষয়ে সতর্কতা হিসেবে পূজার পাঁচদিন কর্মসূচি দেয়নি দল।
তাহলে বলা যায় অক্টোবর আসলে এভাবেই পার হতে চলেছে। কিন্তু দলের নেতারা বারবারই বলেছিলেন অক্টোবর মাসেই তারা সরকারের পতন ঘটাতে চান। কারণ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে আন্দোলন জমানো কঠিন হয়ে পড়বে। সবাই, বিশেষ ডাকার বাইরের জনগণ, তখন নির্বাচনমুখী হয়ে পড়বে।
তবে বিএনপির সাথে যারা যুগপৎ আন্দোলন করছে সেসব দলের নেতারা অনেক বেশি আশবাদী আন্দোলন নিয়ে। তাদের অনেকের কথা হলো সরকারের পতন ঘটানোর জন্য সাত-আট দিনের আন্দোলনই যথেষ্ট। এটা পূজা শেষ হলে ২৪ তারিখের পর থেকে দেখতে পাওয়া যাবে। কর্মসূচির মধ্যে হরতাল, অবরোধ ঘেরাও সবই থাকবে।
তাহলে এটা পরিষ্কার যে, এখন নভেম্বরকে ঘিরেই আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি করছে বিএনপি। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর জায়গা থেকে দেখলে আর সময়ও নেই তাদের হাতে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচন প্রশ্নে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছুতে সরকারকে বাধ্য করতে সব করতে চায় তারা। সহজেই বোঝা যাচ্ছে জানুয়ারিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী নভেম্বর ডিসেম্বর এক সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হাঁটবে দেশ।
১৯৯৬ সালেন ১৫ ফেব্রুয়ারি এক তরফা নির্বাচন করেছিল বিএনপি। নির্বাচন বর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ। তবে মাঠে অসহযোগ আন্দোলন করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেছিল আওয়ামী লীগ এবং নির্বাচনে জয়ীও হয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি বিএনপি যদিও বাংলাদেশে সেই সময়টায় যে সহিংস আন্দোলন হয়েছিল এমনটা আর কোনো কালে অতীতে দেখা যায়নি। এক তরফা নির্বাচন করে, দেড়শরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের নিয়ে পুরো মেয়াদ শেষ করে আবার ২০১৮ সালে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ। বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৭ টি আসন পায় মাত্র।
বিএনপির এবারের কৌশল ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করার মতো কর্মসূচির কথা ভাবছে দলটি। ভাবনায় এটিও আছে মার্কিন ভিসানীতির কারণে মাঠে বেশি কঠোর হতে পারবে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন। দল হিসেবেও আওয়ামী লীগ মারমুখী হতে পারবে না।
এগুলো সবই ফর্মুলা। ঢাকা অচল করে দেওয়ার মতো কর্মসূচিকে কি সরকার এবং শাসক দল হালকাভাবে নিবে? করতে দিবে আন্দোলন? যদি না দেয় তাহলে কী হবে? অক্টোবর গেল, দৃষ্টি এখন নভেম্বরে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এএসএম