ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

‘ভাসুধাইভা কুটুম্বাকাম’ ও ভারত নামে বদল

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ০৪ অক্টোবর ২০২৩

‘ভাসুধাইভা কুটুম্বাকাম’ বা ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ স্লোগান সামনে রেখে বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতির ১৯টি দেশ ও ইইউ সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরাম জি-২০ এ বছরের ৯-১০ সেপ্টেম্বর ভারতে তাদের বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করে। ১৯৯৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে গঠিত হওয়া এ অর্থনৈতিক জোটটি আন্তদেশীয় সহায়তা বৃদ্ধি ও সঠিক নীতি নির্ধারণে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, জলবায়ু ও সমসাময়িক অন্য বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

‘ভাসুধাইভা কুটুম্বাকাম’ সংস্কৃত শব্দ ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’র আরেক উচ্চারণ। এটি মূলত হিন্দু গ্রন্থ মহা উপনিষদ সূত্রে প্রাপ্ত ‘হিতোপদেশ’ গল্প সংকলনের কোনো একটি গল্পে ব্যবহৃত উক্তি। সংস্কৃত হলো একটি ঐতিহাসিক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা এবং হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের পবিত্র দেবভাষা। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রধান দুই বিভাগের একটি ‘শতম’ ভুক্ত ভাষা। বর্তমানে সংস্কৃত ভারতের ২২টি সরকারি ভাষার অন্যতম এবং উত্তরাখণ্ড রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা।

ধ্রুপদী-সংস্কৃত এই ভাষার প্রামাণ্য ভাষাপ্রকার। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বহুধাবিভক্ত ভারত ছোট ছোট রাজ্যে কেবলই কাড়াকাড়ি হানাহানি করেছে, সাধারণ শত্রু যখন দ্বারে এসেছে সবাই এক হয়ে বিদেশির আক্রমণ ঠেকাতে পারেনি। এই শোচনীয় আত্মবিচ্ছেদ ও বহির্বিপ্লবের সময়ে ভারতবর্ষে একটিমাত্র ঐক্যের মহাকর্ষশক্তি ছিল, সে তার সংস্কৃত ভাষা।’ ভারতীয় উপমহাদেশ, বিশেষত ভারত ও নেপালের অধিকাংশ আধুনিক ভাষাই এ ভাষার দ্বারা প্রভাবিত।

সংস্কৃত বিভিন্ন হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন ঐতিহ্যের পবিত্র ভাষা। এটি হিন্দু মন্দিরে পূজার সময় ব্যবহৃত হয়। নেওয়ার বৌদ্ধধর্মে, এটি সব মঠে ব্যবহৃত হয়, যখন মহাযান এবং তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ এবং সূত্রগুলো সংস্কৃতের পাশাপাশি স্থানীয় ভাষায় রয়েছে। ভারত ভৌগোলিক আয়তনের বিচারে এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্র। অন্যদিকে, জনসংখ্যার বিচারে এই দেশ বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল এবং পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

ভারত নামটির উৎপত্তি চন্দ্রবংশীয় পৌরাণিক রাজা ভরতের নামানুসারে হয়েছিল। কথিত আছে এই বর্ষ বা অঞ্চলটি রাজা ভরতকে দান করা হয়েছিল বলে এর নাম ভারতবর্ষ। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান (২০০৯) অনুসারে, ‘ইন্ডিয়া’ নামটি ধ্রুপদী ল্যাতিন শব্দ ইন্ডিয়া থেকে নেওয়া হয়েছে, প্রাচীন গ্রিকরা ভারতীয়দের ইন্দোই হিসেবে উল্লেখ করেছিল, যার বঙ্গানুবাদ হলো ‘সিন্ধু অঞ্চলের মানুষ’।

হিন্দুস্তান মোগল সাম্রাজ্যের সময় প্রবর্তিত ভারতের একটি মধ্য ফার্সি নাম এবং তখন থেকে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে গুপ্ত সম্রাটদের শাসনকাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পকলা, সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শন সমৃদ্ধি লাভ করে।

ষোড়শ শতক থেকে পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপীয় শক্তিগুলো ভারতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করতে শুরু করে। পরবর্তীকালে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোলযোগের সুযোগ নিয়ে তারা ভারতে ঔপনিবেশ স্থাপন করতেও সক্ষম হয়।

১৮৫৬ সালের মধ্যেই ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়েছিল। ভারতীয় সিপাহি ও দেশীয় রাজ্যগুলোর সম্মিলিত এক জাতীয় গণ-অভ্যুত্থান ঘটে ১৮৫৭ সালে। ইতিহাসে এ ঘটনা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বা সিপাহি বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তা দেশে কোম্পানির শাসনের দুর্বলতার দিকগুলো উন্মোচিত করে দেয়। ভারতকে আনা হয় ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত ব্রিটিশ শাসনজাল থেকে মুক্তিলাভ করে। একই সঙ্গে দেশের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের মুসলমান-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো বিভক্ত হয়ে গঠন করে পাকিস্তান রাষ্ট্র। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি নতুন সংবিধান প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে ভারতে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়।

১৯৯১ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংস্কারের ফল। বর্তমানে পৃথিবীর দ্রুত বর্ধনশীল এক অর্থব্যবস্থা হিসেবে ভারত সারা বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতেও সক্ষম হয়েছে। ২০০৮ সালে চাঁদের মাটিতে অবতীর্ণ হয় প্রথম ভারতীয় মহাকাশযান চন্দ্রযান-১। প্রকল্পটির জন্য মোট ৩৮৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়। ১৯৬৯ সালে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা ইসরোয় রূপান্তরিত হয়।

তখন থেকেই ইসরো চাঁদে অভিযানের মিশন (চন্দ্রযান-১,-২, ও-৩) এবং মঙ্গল অভিযানের মিশন (মঙ্গল কক্ষপথ মিশন) চালিয়ে আসছে। ২০২৩ সালে চন্দ্রযান-৩-দুটোই এই ধরনের অভিযানের মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যয়বহুল উদ্যোগ ছিল। এই ধরনের অভিযানে নাসা যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকে, ইসরো সেখানে তার মাত্র এক-দশমাংশ খরচ করেছে। চন্দ্রযান-৩ এর খরচ ইন্টারস্টেলার ছবির খরচের চেয়ে কম।

“২০১৪ সালে ভারত মঙ্গলগ্রহ অভিযানে ‘মঙ্গলযান’ নামের একটি মিশন পরিচালনা করেছিল। ভারত যখন মঙ্গলযানের সাফল্য উদযাপন করছিল, ঠিক সেই সময় নিউইয়র্ক টাইমস একটি কার্টুন ছাপিয়েছিল। সেই কার্টুনে দেখা যাচ্ছিল, কেতাদুরস্ত পশ্চিমা সাহেবরা ‘এলিট স্পেস ক্লাব’ নামের একটি লাউঞ্জে বসে আছেন; আর পাগড়ি পরা এক গেঁয়ো কৃষকরূপী ভারত একটি গরু নিয়ে সেই লাউঞ্জে ঢোকার জন্য দরজায় কড়া নাড়ছে।”

‘২০২৩ সালে ভারত চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান-৩ নামের একটি নভোযান পাঠিয়েছে। ভারতই প্রথম কোনো দেশ যে কি না চাঁদের এই অঞ্চলে সফলভাবে তার নভোযান অবতরণ করাতে সক্ষম হয়েছে। এই ঘটনায় নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সেই কার্টুনের পাল্টা জবাব হিসেবে ভারতীয়রা একটি কার্টুন ছেপেছে। এবারের কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, ‘মুন সাউথ পোল’ নামের একটি ঘরের ভেতরে সেই পাগড়িধারী কৃষকরূপী ভারত তাঁর গরুটি নিয়ে বসে আছে, আর বাইরে আমেরিকান, রাশিয়ান এবং অন্যান্য দেশের অভিযাত লোকেরা হাতে রকেট নিয়ে দরজায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং ভেতরে আসার জন্য তারা ভারতের অনুমতি চাইছে।’

ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ভারতের ১৫তম রাষ্ট্রপতি। তাঁর সম্মানে ৯ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ভবনে জি-২০ নেতাদের নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে চিরাচরিতভাবে ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’র পরিবর্তে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, আসন্ন বিশেষ অধিবেশনে কি এই সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করতে চলেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার? যে আমন্ত্রণপত্র ঘিরে তোলপাড় পড়ে গেছে জাতীয় রাজনীতির অন্দরে। জি-২০ নেতাদের আমন্ত্রণ জানানোর চিঠিতে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’ কথাটি লেখা হয়েছে। এর পরেই প্রশ্ন উঠেছে, আকস্মিকভাবে এমন বদলের কারণ কি?

অনেকের দাবি, ‘এক দেশ এক ভোট’ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিল আনা হতে পারে। অনেকেরই আবার দাবি, মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশ হতে পারে। এই প্রেক্ষিতেই জি-২০ নেতাদের নৈশভোজে আমন্ত্রণের চিঠিতে ভারতের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণপত্র ঘিরে নতুন জল্পনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে।

আনন্দবাজার পত্রিকা বলেছে- ‘ইন্ডিয়া’ নামটি নিয়ে একাধিকবার সরাসরি কটাক্ষ করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তাতে সুর মিলিয়েছেন বিজেপির অনেক নেতা। এবার কি সেই ‘ইন্ডিয়া’ নাম বদলে দেশের নাম শুধু ভারত করার লক্ষ্যে হাঁটতে শুরু করলো মোদী সরকার?

কয়েক দিন আগে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত বলেছিলেন, দেশে সব সরকারি কাজে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটির ব্যবহার বন্ধ হওয়া দরকার। তার বদলে ব্যবহার করা উচিত ‘ভারত’। তাঁকে সমর্থন জানিয়ে বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য হরনাথ সিং যাদব বলেছিলেন, ‘ইন্ডিয়া’ নাম বাদ দেওয়ার জন্য সংবিধান সংশোধন করা দরকার। ইন্ডিয়া শব্দটি ব্রিটিশদের আমদানি করা। ওটা এক ধরনের গালি। ‘ভারত’ শব্দের মধ্যে রয়েছে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিচ্ছুরণ।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আজকে তো ইন্ডিয়ার নাম চেঞ্জ করে দিচ্ছে বলে আমি শুনলাম। মাননীয় রাষ্ট্রপতির নামে যে কার্ড হয়েছে, জি-২০’র লাঞ্চে না ডিনারে, তাতে লেখা আছে ভারত বলে। আরে ভারত তো আমরা বলি। এতে নতুনত্ব কী আছে?’

তিনি আরও বলেন, ‘আজকে দেশের নামটাও চেঞ্জ হয়ে যাবে। কবে রবি ঠাকুরের নাম চেঞ্জ হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম চেঞ্জ করে দেওয়া হচ্ছে। বড় বড় ঐতিহাসিক সৌধের নাম বদল করে দেওয়া হচ্ছে। ইতিহাসকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে।’

ক্ষমতাসীন হয়ে রাজ্যে রাজ্যে ও কেন্দ্রে বিজেপি বহু নাম বদল করেছে। বিশেষ করে মোগল আমলের পরিচয় বহনকারী শহর, নগর, জেলা ও রাস্তার নাম বদলের মধ্য দিয়ে তারা হিন্দুত্বের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছে। এলাহাবাদ হয়েছে প্রয়াগরাজ, মোগলসরাই স্টেশনের নামকরণ হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে। রাষ্ট্রপতি ভবনের মোগল উদ্যানের নাম বদলে হয়েছে অমৃত উদ্যান। মুসলমান–ছোঁয়া ছাড়াও যে নাম বদল হয়নি তা নয়। রাজপথের নাম বদল করে দিয়ে মোদি কর্তব্যপথ রেখেছেন।

জি-২০ সম্মেলনের নানা অনুষ্ঠানেও ‘ইন্ডিয়া’-র পরিবর্তে ‘ভারত’ উচ্চারণ করার মাধ্যমে সম্মেলন শেষ হয়েছে। আগামী ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য সংসদের বিশেষ অধিবেশনে এ প্রস্তাব সংক্রান্ত বিল আনার দাবি জানাচ্ছেন বিজেপি নেতারা। তবে শোনা যাচ্ছে, ‘সরকার বিশেষ সংসদ অধিবেশন চলাকালীন সংবিধান থেকে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটা অপসারণের বিল পেশ করতে পারে। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশি জানিয়েছেন, অমৃতকালে সংসদে ফলপ্রসূ আলোচনা ও বিতর্ক চায় সরকার। পাঁচ দিনের এই বিশেষ অধিবেশনে, ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’, ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’, ‘মহিলা সংরক্ষণ’ সংক্রান্ত বিল পেশ করা হতে পারে।’এর সাথে জি-২০ সম্মেলনের শ্লোগান ‘ভাসুধাইভা কুটুম্বাকাম’র আড়ালে নেতাদের আমন্ত্রণপত্রে দেশের নাম বদল করে ভারত প্রজাতন্ত্র লিখে আগাম কোনো বার্তা দেয়া হয়েছে কি? নাকি আরও কোনো চমকের বিষয় রাখা হয়েছে চন্দ্রবংশীয় রাজা ভরতের পৌরাণিক ভাবনা নিয়ে-এখন তা দেখার অপেক্ষা শুধু।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এএসএম

আরও পড়ুন