ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সারের ভর্তুকি কার পকেটে?

ড. মাহবুব হাসান | প্রকাশিত: ০৯:৪০ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

এটা কি আমরা জানি না বলতে পারি? আমরা তো আর মাঠের কৃষক নই। আমাদের জমিজিরেত সামান্য যা আছে সেগুলো তো বর্গা দেওয়া। বর্গার ফসল পেয়েছি কখনো এমনটা মনে নেই। কারণ বর্গাদার হচ্ছে আমাদেরই পরিবারের যারা পড়াশোনোয় পিছিয়ে পড়ে নিজেদের জমিজমা দেখভাল করে, তারাই। ফসলের কথা বললেই দাঁত কেলিয়ে হাসে কাক্কা, ওই ধান আপনাদের লাগবো? শুনেই লজ্জা পাই। আর কোনো কথা আসে না মুখে।

২.
রিপোর্ট পড়লাম কাগজে। সেই রিপোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আপনাদের পড়ার জন্য তুলে দিচ্ছি।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ইউরিয়া এবং নন-ইউরিয়া উভয় মিলিয়ে ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত ছয় অর্থবছরে সার খাতে মোট ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৫৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ হাজার ৪৭৩ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ হাজার ৭১৬ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ হাজার ৪২১ কোটি ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৯৪২ কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়া হয়। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ১৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। (বণিক বার্তা/ ০৯/০৯/২৩)

সরকার তৃণমূলের কৃষকের জন্য তেমন কিছু করে না, এরকম একটি রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ধারণা শিক্ষিত ও মধ্যবিত্তের মনের মধ্যে গেঁথে আছে। সেটা থাকারই কথা। কারণ তারা তো গ্রামের ওই সব উৎপাদকের পাশে বাস করে। তারা তো চাষাদের অর্থনৈতিক সংকট সরাসরি দেখতে পায়। এমনকি সারের জন্য যখন কৃষক হাহাকার করে, যখন টাকা থাকতেও সার পাওয়া যায় না, তখন সেই হাহাকার বাড়তে থাকে এবং মফস্বল এলাকার রাজনীতিকদের কানে পৌঁছায়। সেই রাজনীতিকরা যদি সরকারি দলের হয়, তাহলে তারা বলবেন, হাহাকার কোথায়? ওরা তো মিথ্যামিথ্যি ওটা করে। আর বিরোধীদের মনে সেই হাহাকার ড্রামের শব্দের মতো এসে কানে লাগে। তখন তারা কৃষকের কান্নার শব্দে নিজেদের রাজনীতির উপাদান পেয়ে সোচ্চার হন রাজনৈতিক ময়দানে। কেননা, তারও তো খাদ্যশস্য দরকার।

উদ্ধৃত অংশ পাঠ করলেই সত্য ও প্রকৃত চিত্র দেখা যায়।সরকার কৃষকের জন্য ভর্তুকি দিয়েছে ছয় বছরে ৫৭ কোটি টাকা। সারে, এই পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি হিসেবে দেওয়াটাকে সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই মনে হয়। কিন্তু ছোট এই দেশের বিশাল কৃষকদের কর্মক্ষেত্র যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে বলবো এই ভর্তুকি যৎসামান্য। কেননা, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষই কোনো না কোনোভাবে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সরাসরি যে সব কৃষক ধানের মধ্যে খাদ্যশস্য উৎপাদনে কায়িকশ্রম বিনিয়োগ করে তাদের পরিমাণ ৬০-৭০ শতাংশ।

আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি অর্থাৎ জিডিপির ৮০ শতাংশই কৃষকের অবদান। এরকম একটি জনশক্তির উৎপাদকের জন্য প্রতি বছর ভর্তুকি যা দিচ্ছে সরকার তার সিংহভাগই লুটে নিচ্ছে রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত লোকেরা। ধরুন, ২০১৭-১৮ সালে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। এই টাকাটা মাথাপিছু বন্টন করলে একজন কৃষক কত টাকা পাবেন? মানে তাদের মাথাপিছু বরাদ্দ কত টাকা হবে? সেই হিসাব কষলেই বেরিয়ে যাবে সরকারের সার প্রণোদনার মূল চিত্র।

আপনারাই হিসাব কষে দেখেন, সরকারের দেওয়া ভর্তুকি সত্যই কৃষক পায় কি না। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো ওই ভর্তুকির টাকা কোথায় কীভাবে দেওয়া হয়? রিপোর্ট বলছে, সার আমদানির জন্য ভর্তুকির সিংহভাগ টাকাটা দেওয়া হয় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনকে। তারা বিদেশ থেকে সার আমদানি করে। সেই সার তাদের গুদামে, বাফার গুদামে রাখা হয়। তারপর সেই সার কৃষকের দোরগোড়ার দোকানে সরবরাহ করে, যাতে কৃষক ন্যায্যমূল্যে সার কিনতে পারে। কিন্তু আমরা তো দেখে আসছি সরকারি গুদাম থেকে ন্যায্যমূল্যে কিছুই পাওয়া যায় না।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে সার খাতে মোট ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। এর বড় একটি অংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) মাধ্যমে আমদানির জন্য। কিন্তু পরে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) দপ্তরের নিরীক্ষায় ধরা পড়ে, ওই বছর শুধু সার পরিবহনকারী ঠিকাদারদের মাধ্যমেই বিসিআইসির প্রায় ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকার সার আমদানিতে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হয়েছে।

এর অর্থ হচ্ছে বিসিআইসির কিছু কর্মকর্তা আর পরিবহন ঠিকাদাররা মিলে ওই টাকার সার আত্মসাৎ করেছে। এবং সিএজির অডিটে ধরা পড়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম আইন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মাত্র কয়েকটি পরিবহন ঠিকাদার বিসিআইসির সার বাফার গুদামে নেওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত ও চুক্তির অধীন ঠিকাদাররা সার মেরে দেয়। বছরের পর বছর চলে গেলেও সেই দুষ্টচক্রই সার পরিবহনের দায়িত্ব পায়। কীভাবে এবং কেন পায়?

সরকারের এসব সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তাদের রক্ত যে দূষিত, সেটা জানার পরও তারা/ সরকার নির্বিকার হয়ে চলছে বছরের পর বছর ধরে। তার মানে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে পরিবহন ঠিকাদারদের একটি লুটেরা চেইন এ সার লুটে নেয়। কোটি কোটি টাকার সার সরিয়ে নিচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিসিআইসির দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকদের সরিয়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে ঠিকাদারদের যে সিন্ডিকেট, তাদের আইনের/বিচারের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে এ লুটেরাদের সংঘ ভেঙে দেওয়া যাবে। কিন্তু কাজটা অতো সহজ নয়। কারণ, এ লুটেরাদের সঙ্গে জড়িতরা রাজনীতি ও সরকারি দলের রাজনীতির যোগাযোগ রয়েছে। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

যদিও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা বলেছেন অতীতের বিষয়টি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার জন্য ঘটেছে। এখন বিষয়টি নজরদারি করার ব্যবস্থা হচ্ছে। অটোমেশনের মাধ্যমে সার উত্তোলন ও বাফার স্টকে পৌঁছানোর পর্যন্ত তা ট্র্যাক করা হচ্ছে। ফলে সার গায়েব করা যাবে না আর। এটা হলো তার ভাবনা। মাঝপথে পরিবহনের দায়িত্বে থাকা লোকেরা যদি বাফার গুদামে নেওয়ার আগেই পরিবহন শ্রমিকরা নিজেদের গুদামে রেখে যায় এবং সার পৌঁছে দেওয়ার রিসিট ওআইআরআর নম্বর নিয়ে আসে, তাহলে জাকিয়া সুলতানা তাদের ধরবেন কেমন করে?

অটোমেশনের মাধ্যমে ট্র্যাক করা গেলেও মাল ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে কি না তা বোঝার কোনো উপায় নেই। যিনি বাফার গুদামের ইনচার্জ, তিনি যদি রিসিভ করে দেখান, তাহলেও তাকে ধরবেন না কর্তৃপক্ষ। যদি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণাধীন সার কারখানা ও গুদামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা এবং পরিবহন সংস্থার লোকেরা তাহলে সার ঠিক মতো পৌঁছে যাবে বাফার গুদামে। তবে, বাফার গুদামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেও সততার সঙ্গে পালন করতে হবে সার রিসিভ করার বিষয়টি সার না পেয়েও যদি অতীতের মতো লিখে দেন যে সার পাওয়া গেছে, তাহলে যে লাউ সেই কদুই থেকে যাবে বিষয়টি।

এই যে সততা আর অসততার একটি পরিকল্পিত মিশ্র ধারা গড়ে তোলা হয়েছে সংঘবদ্ধ লুটেরাদের, তাদের সেই সংঘ ভেঙে দিতে হবে। কিন্তু কীভাবে দেবেন? এর একমাত্র উপায় মানসিক বিকাশ ও রাজনৈতিক সরকারের অনমনীয় চেতনার মাধ্যমে। সরকারের ক্ষমতাবানরা যদি মনে করেন যে ওই ঠিকাদাররা তাদের লোক এবং তারা টু পাইস কামাতে পারেই ওই ভাবে, তাতে ক্ষতি কি?

না, কোনো ক্ষতি নেই। কারণ টাকাটা তো জনগণের। সরকারের দায়িত্বশীলরা ব্যবস্থাপনার যে রীতিপদ্ধতি সৃজন করেছেন, তা চলছে মানসিকভাবে দূষিত রক্তে। ওই রক্তপ্রবাহের চেতনা শোধন জরুরি। সারের জন্য দেওয়া সরকারি ভর্তুকি তো কৃষকের জন্য। কিন্তু কৃষক তা পায না। কীভাবে প্রকৃত কৃষক ভর্তুকির অর্থ তারা সরাসরি পায় বা পেতে পারে, সেই পথ সৃষ্টি করতে হবে। আর সেটা করতে হলে বিসিআইসিসহ অন্যান্য যে সংস্থাকে ভর্তুকির অর্থ দেওয়া হয়, তা বন্ধ করতে হবে।

বিসিআইসি তাদের ফার্টিলাইজার সৃজন করে বাজারে পাঠাবে নির্ধারিত দামে। আর কৃষক সেই দামে তা কিনে নেবে। কথা হচ্ছে কৃষকের পকেটে তো ওই পরিমাণ টাকা নেই। সার মাগনা দেওয়ার রাজনৈতিক ঘোষণা আমরা শুনেছিলাম। সেই ঘোষণাই কেবল ইতিহাস হয়ে আছে। কৃষকের পকেটে টাকা ভরে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। যে টাকা ভর্তুকির নামে লুটেরা চোরদের হাতে দেওয়া হয়, সেই টাকাটা কৃষকের পকেটে গেলে ভালো হয়। কেমন করে টাকা কৃষকের পকেটে পাঠাবেন, সরকারকে তা নিয়ে ভাবতে হবে।

আমরা জানি, নাগরিকের রয়েছে ন্যাশনাল আইডি কার্ড মানে এনআইডি। ওই এনআইডি কার্ডের সূত্র ধরে তাদের ব্যাংক একাউন্টে টাকা পাঠানো যেতে পারে। তবে, তার জন্য প্রকৃত কৃষক/উৎপাদক কে কে বা কারা সেই সমীক্ষা করতে হবে। ঢাকায় বা বিভাগীয়/জেলা/থানা বা উপজেলা শহরে বাস করা জমির মালিককে সারের ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। আর যারা রাজনৈতিক পরিচয় দেবেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কৃষক/উৎপাদক এই একমাত্র পরিচয়ই এই সমস্যার সমাধানের জন্য যথেষ্ট।

এভাবে পরিকল্পনা করলে, আমার ধারণা সারের জন্য যে অরাজনৈতিক প্রণোদনা তা কৃষকের হাতে পৌঁছাবে। আর তারাই সার কিনে ভর্তুকির অর্থে উৎপাদনে বাম্পার ফলন দিতে পারবে।

মূল কথা মানসিকভাবে সরকারকে সৎ চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। রাজনৈতিকভাবে অসৎ ও অন্যায়কারী রাজনৈতিক নেতারা একাজ করতে পারবেন না। আর সেই সঙ্গে মানসিক সিস্টেমও পাল্টে ফেলতে হবে। মানসিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত জাতিকে নৈতিক বলে বলীয়ান করতে হলে নয়া প্রজন্মের হাতে ক্ষমতার সিংহাসন দিতে হবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস