ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আফগান তালেবানের দুই বছর

এবার যুদ্ধ নারীর বিরুদ্ধে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ১১:৩৫ এএম, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আফগানিস্তানে নতুন করে তালেবান শাসনের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে গত আগস্টে। মার্কিনীরা গেছে, কিন্তু তালেবানদের যুদ্ধ থামেনি। তালেবানদের নতুন যুদ্ধের প্রতিপক্ষ এখন নিজ দেশের নারীরা। এক প্রকার প্রত্যাশা ছিল যে, প্রথম বছর যা-ই হোক না কেন দ্বিতীয় বছরে এসে নারীদের জন্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হবে। কিন্তু সেটা তো হয়ই নি, উল্টো নারীদের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক তালেবানি ভাবনার চেয়েও কঠোর হয়েছে সরকার।

২০০১ সালের আগস্ট ক্ষমতা হাতে নিয়েই সবার আগে তালেবানরা ১২ বছরের মেয়েদের শিক্ষা বন্ধ করে দেয়। এর ফলে ১১ লাখ মেয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ বন্ধ করে দেয়ায় এক লক্ষ নারীর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম ঘোষণায় বলেছিল, শরিয়ত আইন মেনে মেয়েদের অধিকার দেওয়া হবে। কিন্তু নারীদের জন্য কোন অধিকারেরই স্বীকৃতি দিচ্ছে না এখন তালেবান সরকার। সরকারি-বেসরকারি কাজ হারিয়েছেন নারীরা। পুরুষ সঙ্গী ছাড়া তাদের বাড়ির বাইরে বেরুনো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি, শাস্তি হিসেবে মিলছে চাবুকের আঘাত।

মধ্যপ্রাচ্য, ইরানসহ অনেক মুসলিম দেশে নারীদের জন্য আইন কানুন অনেক কঠোর হলেও আফাগানিস্তান এখন একমাত্র দেশ যেখানে মেয়েদের পড়ালেখা একদম বন্ধ হয়ে গেছে। তালেবানরা ক্ষমতায় আসার আগে গত ২০ বছর আমেরিকা সহ পশ্চিমা ও অনেক ছোট ছোট দেশও আফগান মেয়েদের শিক্ষায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল। সব অগ্রগতি একসাথে থেমে গেল তালেবানরা ক্ষমতা নিতে না নিতেই। এখন লড়াইটা মূলত নারীদের বিরুদ্ধে।

উপায় না দেখে লাখ লাখ মেয়ে এখন মহিলা মাদ্রাসায় যাচ্ছে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে। কিন্তু সেখানেও তাদের প্রতি আচরণ খুব রূঢ়। এরপরও পরিবারগুলো মেয়েদের মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছে বাড়িতে বসিয়ে না রেখে। কিন্তু আমরা যদি ফিরে তাকাই তাহলে দেখবন ২০০১ সালের অগস্টে দ্বিতীয় বারের জন্য আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালিবানরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আগের মতো রক্ষণশীল নীতি নিয়ে এবার আর দেশ শাসন করবে না তারা।

বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার অধিকার সুরক্ষিত থাকবে নতুন সরকারের অধীনে। কিন্তু আমেরিকা-সহ গোটা বিশ্বকে দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি তালেবান। প্রথমে নানাবিধ পোশাকবিধি ও শর্ত চাপিয়ে মেয়েদের স্কুল-কলেজ চালু করেছিল তারা। এর পর মেয়েদের সব পঠনপাঠনই বন্ধ করে দেওয়া হয়।

দেশটির সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই এখন আতংকে আছেন কখন কোন অত্যাচার নেমে আসে সেই ভয়ে। মেয়েদের পড়ালেখা এবাবে বন্ধ করে দেয়ায় পুরো সমাজ ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশংকা করছেন দেশটির শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। একদিকে উচ্চশিক্ষা বন্ধ, অন্যদিকে বলা হচ্ছে নারীরা নারী চিকিৎসক ছাড়া কারও কাছে যেতে পারবে না। এমন হাস্যকার উদ্ভট বিধি নিষেধের কারণে ভবিষ্যতে আফগান মেয়েদের মৃত্যু হার অনেক বেড়ে যাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। আফগানিস্তানের নারীদের জন্য প্রতিটি দিন এখন রাতের চেয়েও অন্ধকার।

আফগানিস্তানে তালেবানি শাসনে মহিলাদের অবস্থা কী হবে- এই প্রশ্নটা কিন্তু ছিল শুরু থেকেই। তখন ধারণা করা হয়েছিল, ২০ বছর আগে যেমন নিয়ম ছিল, তেমন না-ও থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো তালেবানরা বদলায়নি। তারা যে আন্ধকারের জীব ছিল সেটাই রয়ে গেছে। এখন তালেবানি শাসনে নারী স্বাধীনতা তো দূরস্থান, নারী অধিকার রক্ষাও কঠিন হয়ে গেছে।

নীতি পুলিশি ব্যবস্থায় সব মানুষই এখন কার্যত নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে নিষেধের পরিধি আরও বড়। পাহারা আরও কড়া। এই নিষেধাজ্ঞার সূত্র ধরে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বা পরিবারের বাইরে কোনও কাজকর্মে অংশ নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে তালিবানি শাসনে। শহরাঞ্চলে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট প্রথাগত স্নানাগার বা হামামগুলো তালিবানি ফতোয়ার জেরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে বিউটি পার্লার যেগুলো ছিল শুধুই মেয়েদের জন্য।

এই ধরণের বিধিনিষেধে রাতারাতি অভ্যস্ত হয়ে উঠা আফগান মহিলাদের পক্ষে সহজ হচ্ছে না। তার পরিণামে তালেবান যুবকদের হাতে নানা ধরনের হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে তাদের এবং পুরুষ কর্তৃক এই নিপীড়ন রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদিত। নিয়মিত ঘটছে শারীরিক নিগ্রহের ঘটনা। দৈহিক আঘাত নারীদের মনে বড়সড় মানসিক ক্ষতের সৃষ্টি করছে বলে সেখানকার অনেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে নারীদের প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা হচ্ছে, পাথর ছুঁড়ে হত্যা করার ঘটনাও প্রকাশ্যে আসছে।

এই চরমপন্থী বিধিবিধান ও শাস্তিদান পদ্ধতি স্বাভাবিক ভাবেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এবং এটি বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জাতিসংঘসহ অনেক সংস্থা আরও সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার আবেদন জানাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আমেরিকা এই ব্যবস্থাকে মধ্যযুগীয় আখ্যা দিয়ে এখন পর্যন্ত তালেবান শাসনকে স্বীকৃতি দেয়নি। সব বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েও তালেবান নেতৃত্ব নির্বিকার ভাবে বলছে মেয়েদের প্রতি তারা নির্দয়ই থাকবে।

নারীদের প্রতি এই ধরনের পীড়নমূলক আচরণের আপাতত কোনো সমাধান দেখা যাচ্ছে না। এই প্রবণতা তালেবানদের পরিচালিত ইসলামি আদর্শের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সন্দেহ নেই তালেবান আমলে আইন ও প্রশাসনের নারী-বিরোধী চরিত্র চরমে পৌঁছেছে। গৃহবন্দি জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়তো করবে আফগান নারীরা। কিন্তু অন্দরে রক্তক্ষরণ চলতেই থাকবে। তৈরি হবে মানসিক বৈকল্যের পরিস্থিতি। একটা জাতি এই আধুনিক বিশ্বে একেবারে অন্ধকারের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে চলছে সবার সামনে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন