পাহাড়ের পাদদেশে কেন পুনঃকান্না?
আমরা ছোটকাল থেকে জানি চট্টগ্রাম আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ফুসফুস। এর উঁচু-নিচু পাহাড়ঘেরা সুন্দর শহর ও পাশেই কক্সবাজার জেলার দীর্ঘতম সৈকত পৃথিবী বিখ্যাত। এজন্য চট্টগ্রাম আমাদের সবার অহংকার। চট্টগ্রামকে ঘিরে বন্যা ও জলাবদ্ধতার ভয়ংকর সংবাদ শিরোনাম দেশ-বিদেশের সবাইকে হতবাক করে তুলছে। চট্টগ্রামের রাজপথে বার বার ময়লা, ঘোলা পানিতে জীব ও যানবাহনের প্রাণপণ সাঁতার কাটে। মানুষও চরমভাবে নাজেহাল হচ্ছে। বিয়ে করতে গিয়ে বরকে মাথায় নিয়ে পানি পার হতে হচ্ছে। চলতি এইচএসসি পরীক্ষাও মাঝে মাঝে বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
কয়েক দিন আগে বুক ফাটা কান্নার মধ্যে স্বজনরা গলা সমান পানিতে দাঁড়িয়ে হাতের ওপর ভর করে বাসা থেকে বের করে আনা হয়েছে একজন মৃত ব্যক্তির লাশ। আশেপাশে দাফনের জন্য উঁচু জায়গা নেই। তাই তার মরদেহ কোনোরকম নিয়ে যাওয়া হয়েছে উঁচু কোনো কবরস্থানে দাফন করার উদ্দেশ্যে। টিভির পর্দায় দৃশ্য দেখে কষ্ট পাচ্ছেন দর্শকরা।
এই করুণ দৃশ্যের সাথে বুকফাটা কান্না ও আহাজারি সংবাদের শিরানাম হলে সারাদিন ভেসে এসেছে গণমাধ্যমে। বান্দরবানে বিদ্যুৎ ছিল না সাতদিন। মোবাইল ফোনে চার্জ হয়নি। সারাদেশের সাথে সব মাধ্যমেই নেটওয়ার্ক ছিল না, যোগাযোগ বন্ধ। বাড়িতে ডুবন্ত রান্নাঘরে চুলা বন্ধ। তাই খাওয়া বন্ধ ছিল। সেখানকার স্কুলে পাঁচদিন ধরে পানিবন্দি ৩৬ জন শিক্ষার্থীকে তাদের স্কুলের হোস্টেল থেকে উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনীর রেসকিউ টিম।
চট্টগ্রামে নগরের মেয়রের বাসায় পানি ছিল। তিনি রিকশায় চড়ে উঠানের হাঁটু পানি ভেঙে বাড়িতে ঢুকেছেন। গোটা চট্টগ্রাম শহরে পানি জমে গিয়েছিল। সেখানকার ৬৮ হাজার বসতবাড়ি পানির নিচে ছিল বলে সংবাদ হয়েছে। রাজপথ যেন থৈ থৈ নদী হয়ে দুঃখের স্রোতের তোড়ে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে উন্নত সভ্যতাকে উপহাস করেছে।
নগরের মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে বহু বছর ধরে। মেগা প্রকল্পের কাজ মেগা মেগা সংকট বয়ে এনেছে বলেও সংবাদ হয়েছে। চালুর আগেই নতুন রেললাইন ধসে গেছে। এ সংকটের কারণ ও ব্যাপ্তি এক পুনঃপুনঃ প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বন্যা, ভূমিধস, পাহাড়ে অশান্তি ও মারামারি, মাদকের ব্যবসা ও প্রসারে রুট হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার ঘটনা, পাহাড় কাটা, নদীখাল দখল, রাজনৈতিক কোন্দল ইত্যকার নানাবিধ খারাপ সংবাদ বর্তমানের চট্টগ্রামকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করার ইঙ্গিত শুরু করেছে।
দুই বছর আগে আরেক পাহাড়ি এলাকা সিলেটে ভয়াবহ বন্যার কথা দেশবাসী জানে। এবছর একই রূপ নিয়ে গোটা চট্টগ্রামকে আক্রান্ত করেছে ভয়াবহ বন্যা। সাগরের নোনা জলকে ছাড়িয়ে বৃষ্টি ও উজানের ঢলের ঘোলাজল মিলেমিশে একাকার হয়ে জনজীবনকে করে তুলছে ভীষণ দুর্বিষহ। আর এর পেছনে কারণ হিসেবে উঠে এসেছে নানা কদাকার চিত্র।
ঐতিহাসিক কাল থেকে উজানের ঢল ও অতিবৃষ্টির পানি দ্রুত সাগরে নির্গমণের পথ ছিল চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ছোট-বড় সব নদী ও খাল। এসব পাহাড়ি নদী একযুগ আগেও বেশ সচল ছিল। এরপর থেকে নানা ধরনের মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়ায় এসব পাহাড়ি নদী ও খাল ভরাট করা হয়েছে অথবা উন্নয়নকাজের অসাবধানতাবশত ক্রমাগতভাবে নরম মাটি গড়িয়ে এসে এসবের তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্য হারিয়ে ফেলেছে।
প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট ও পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলে ভবন, মার্কেট, রাস্তা, অফিস ভবন ইত্যাদি নির্মাণ হয়েছে পরিকল্পনা পাস করে। কিন্তু সেসব পরিকল্পনা পাসের আড়ালে অন্যায়ভাবে পরিবেশ বিনাশকারী উপাদানকে পাশকেটে যাওয়া হয়েছে। কিছু মানুষের সীমাহীন লোভ ও দুর্নীতির আড়ালে চাপা পড়েছে গণমানুষের উপকার সাধনকারী আইন-কানুন, পরিবেশ ভাবনা। নালা ভরাট ও সংকুচিত করে নির্মাণ করা হয়েছে গোটা চট্টগ্রাম এলাকা। ফলে প্রাকৃতিক জলাধার ধ্বংস হয়ে গেছে। মানুষের বর্জ্য বেড়েছে শতগুণ বেশি। এসব বর্জ্যের পরিমাণ এত বেশি তা নিয়মিত পরিষ্কার করার অভাবে নদী ও খালগুলোর তলদেশের উচ্চতা বেড়ে দ্রুত পানি ও পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা মরে গেছে বহুদিন আগেই।
ভয়ংকর জলাবদ্ধতায় কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে। এখন তারা এসব ভরাট নদী-খাল খননের কথা বলছেন। কথা হলো— এতদিন এসব মজে যাওয়া খাল খনন করার চিন্তাও আসেনি কেন? এসব কাজে দায়িত্বরতরা সারা বছর ঘুমিয়ে থাকেন। যখন মানুষ মহাবিপদের সম্মুখীন হয় তখন চারদিকে হৈ হৈ রব ওঠে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য আগাম গবেষণা করে প্রস্তুতি নেয় সারা পৃথিবীর সভ্য মানুষ। অথচ আমাদের দেশে আগাম চিন্তাভাবনার কথা জানা থাকলেও কাজের বেলা লাভের হিসাব মেলাতে গিয়ে সেধরনের আগাম প্রস্তুতির কথা ফাইলবন্দি করে রাখার প্রবণতা বেশ ভয়ংকর। কারণ সেখানে কর্মদাতা, অর্থদাতা, আমলা, নেতা, ঠিকাদার সবার পার্সেন্টেজদের বিষয়টা মুখ্য হিসেবে ভেসে এসে সুষ্ঠুভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নকে প্রবল বাধার সম্মুখীন করে তোলে।
আজকাল উন্নয়নকাজে মি. পার্সেন্টেজদের কারসাজি ও নেটওয়ার্ক এখন ওপেন সিক্রেট। এসব উন্নয়নকাজে বাগড়া দেওয়ার জন্য যিনি যত বেশি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারেন তার লাভের অনুপাত তত বেশি।
দেশের বর্তমান উন্নয়নকাজে মি. পার্সেন্টেজদের নেটওয়ার্ক দমন করতে না পারলে চট্টগ্রাম ডুবে থাকার মতো ঘটনা আরও অনেকবার ঘটতে থাকবে। সরকারি বিশাল বাজেট বার বার খরচ হয়ে হাওয়া হতে থাকবে কিন্তু মানুষের ভোগান্তি আরও বেশি চক্ষুস্মান হতে থাকবে।
এবারের বন্যার পানি দীর্ঘদিন জমার প্রধান কারণ হিসেবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার নতুন রেললাইন ও মহাসড়কের অপর্যাপ্ত ব্রিজ এবং কালভার্ট তৈরির কথা বলা হচ্ছে। উজানের মাত্রাতিরিক্ত পানির চাপ সহ্য করতে না পেরে রেললাইনের নুড়ি পাথর, মাটি ভেসে গিয়ে বাঁকা হয়ে গেছে। মহাসড়ক ও রেললাইনে ১২০ কি.মি পথে ২৪৫টি ব্রিজ-কালভার্ট তৈরির দাবি কর্তৃপক্ষের। কিন্তু ভুক্তভোগীরা বলছেন, সেগুলো অতি সংকীর্ণ ও বেশিরভাগ কালভার্ট বেজায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সাঙ্গু, টংকাবতী ও ডুলু নদীতে বালু উত্তোলন করে সেগুলো প্রবেশমুখ ভরাট করে রাখা হয়েছিল।
আরেকটি বড় বিষয় হলো— সীমান্তের ওপাড়ে হঠাৎ অতিবৃষ্টির তথ্য ও প্রবেশ করা পানিপ্রবাহ বাংলাদেশের কাছে সবসময় অজানা থাকে। এজন্য প্রতিবেশীদের সহযোগিতা কম ও হালনাগাদ তথ্যভিত্তিক কোনো গবেষণাও করা হয় না। উজানের অনিয়ন্ত্রিত অতিরিক্ত পানি তারা সামাল দিতে না পারলে হঠাৎ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এ ধরনের ফ্লাশফ্লাড উত্তরের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, আগের টিপাইমুখ, সাঙ্গু, কর্ণফুলী সব সীমান্ত নদীর ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
বৈশ্বিক পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে অসময়ে উজানের ঢল ও নেমে আসা বিপুল পরিমাণ বালুমাটি অপসারণের জন্য আমাদের প্রতি বছর নতুন করে গবেষণাভিত্তিক তথ্য নিয়ে ভাবতে হবে। বাংলাদেশি নদী গবেষকরা এ হুমকির কথা প্রায়শই বলে আসছেন। কিন্তু আমাদের দেশের নির্মাণ প্রকৌশলীরা এসব বিষয় ঠিকভাবে আমলে নিতে চান না।
ফলে ফিবছর সীমান্ত নদীভিত্তিক অতিরিক্ত পানি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বর্তমানে আমরা বড় বড় বন্যা ও বিপর্যয়ের মুখে নিজেদের ঠেলে দিচ্ছি। সড়কে এত পানি এতদিন ধরে জলবদ্ধতা তৈরি করে কেন? সামান্য বৃষ্টিতেই দেশের মহানগরীগুলোর মহাসড়ক কেন নদীর মতো হয়ে যায়? উন্নয়নের স্তুতিতে কানভারী হলেও বাস্তব চিত্র বেশ অপ্রিয়। কারণ অতিবৃষ্টি, বন্যা হতেই পারে। কিন্তু এগুলো মোকাবিলা করে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। সেসব কর্মসূচিতে এত অর্থ ব্যয় করার পরেও কোনো ‘বরকত’ নেই কেন— সেটাই চিন্তার বিষয়!
দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা বড় অসহ্য। বিপর্যয় মোকাবিলা করতে না পারলে সেসব উন্নয়ন কর্মসূচি প্রহসন মনে হয় জনগণের কাছে। কারণ, তারা এসবের পেছনের অদৃশ্য ও কদকার চিত্রগুলোর কথা জানে ও বুঝতে চেষ্টা করে।
আজকাল কোনো বিষয়কে ছোট ভেবে অবহেলা করার উপায় নেই। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ভেবে বাস্তবতার নিরীখে হালনাগাদ তথ্যভিত্তিক গবেষণা ব্যতিরেকে শুধু খামখেয়ালিভাবে হঠাৎ মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়। ফলে আমাদের আর্থিক, পারিবেশিক, সামাজিক ও মানসিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। এ বিষয় গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হতে না পারলে প্রতি বছর দেশের সব পাহাড়ের পাদদেশে পুনঃ পুনঃ কান্না থামানোর উপায় খুঁজে পেতে অহেতুক আরও বেশি হয়রান হতে হবে বৈকি?
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/এএসএম