মোড়লের আনাগোনা ও বালিকার স্বপ্নে জাল বোনা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেন্দ্রিক দাবিতে সরগরম বঙ্গীয় সমতট। একদল ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কিছুতেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়। শুধু সেখানেই ক্ষান্ত হননি। হুমকি দিয়ে রেখেছেন তাদের দাবি না মানলে নির্বাচনও হতে দেবেন না। জনগণের মহান ভোটাধিকার রক্ষায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাকি কোনো বিকল্প নেই।
এদিকে অন্যপক্ষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তারা কোনো অসাংবিধানিক দাবির কাছে মাথা নোয়াবেন না। যেহেতু সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানসম্মত নয় বলে রায় দিয়েছেন, তাই সেই ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা সেটি করবেনও না। নির্বাচন হবে এবং সেটি বর্তমান সংবিধান মেনেই। অসাংবিধানিক দাবির সমর্থকদের প্রতিহত করা হবে যে কোনো মূল্যে।
মোটা দাগে পরিস্থিতি যখন এই, তখন যাত্রাপালার বিবেকের মতো স্বদেশি তৃতীয় পক্ষ কেউ সমাধানে এগিয়ে আসবেন সে আশাও সুদূর পরাহত। আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার অন্যতম ব্যর্থতা বোধকরি আমরা তৃতীয় সুরটি লালন করিনি। ‘সবকিছু আমার মতো’ এই ধারণা থেকে আমরা গলা টিপে মেরেছি তৃতীয় সুরটি, এমন অভিযোগও কম নয়। যদিও এটি মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে- অভিযোগটি একপেশে। লোভের চোরাবালিতে কেউ যখন স্বেচ্ছায় ডুবে মরতে চায়, তাকে গলা টিপে কেন মারতে হবে! সহজ কথায় সুশীল/নাগরিক সমাজ তার চরিত্র বিসর্জন দিয়েছে বহুদিন। আর মধ্যবিত্ত! মেরুদণ্ড হারানো মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব বলতে কেবল জলের ওপর ভাসিয়ে রাখা নাকটুকু। কোনোরকম টিকে থাকা।
তাই বলে কি তৃতীয় পক্ষ থাকবে না! আছে, আছে। নাম বলার আগে তাদের অতীত চরিত্রে একটু আলো ফেলা যাক। যুগে যুগে নিজ স্বার্থে স্বৈরাচারী সরকারকে সমর্থন দেওয়ায় তাদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সরকার ভাঙা-গড়ার খেলায়ও তারা সমান পারঙ্গম। ঔপনিবেশকালে মানবাধিকার লঙ্ঘন আর লুণ্ঠনের তাদের যে রেকর্ড-আয়নায় দেখলে কেয়ামত পর্যন্ত মানবাধিকার শব্দটিও উচ্চারণ করার কথা নয় তাদের।
শুধু আমাদের এখানে দুইশ বছর ধরে ব্রিটিশরা যে অন্যায়, নির্যাতন, জুলুম, লুণ্ঠন চালিয়েছে সেজন্য ক্ষমা না চেয়ে মানবাধিকার নিয়ে আমাদের উপদেশ দেওয়া কতটা মানায়। ক্রীতদাসনির্ভর গড়ে ওঠা সভ্যতায় যুক্তরাষ্ট্র তার একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চেয়ে আমাদের নিষেধাজ্ঞা দেয়! একাত্তরের পরাজিত শক্তির পালের গোদা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় আমাদের অনেক রাজনীতিক আবার উদ্বাহু নৃত্য করেন। শুধু কি তাই? সকাল-বিকাল দুহাত তুলে বিধাতার কাছে নিজেদের আখেরাতের কল্যাণ বাদ দিয়ে নতুন নিষেধাজ্ঞার ফরিয়াদ জানান।
বলছি না অন্ধকার অতীত সত্ত্বেও তারা শুভ কল্যাণকর কিছুতে সমর্থন দিতে পারবেন না। সেটি হতেই পারে। কিন্তু বর্তমান কী বলছে? লাখো ফিলিস্তিনির দশকের পর দশক দুর্ভোগ দেখেও তারা চোখ বন্ধ করে রাখেন। নিজেদের উৎপাদিত অস্ত্র ব্যবসার স্বার্থে তারা রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিরোধ জিইয়ে রাখেন। উদাহরণ তো ভূরি ভূরি। এখনো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে উচ্চারিত ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস আন্দোলনের অন্তর্নিহিত কারণের যৌক্তিকতা কিংবা ফ্রান্সে নিরপরাধ কিশোর হত্যাকাণ্ডে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ মানবতার ফেরিওয়ালারা চোখে দেখেন না। হোয়াইট সুপ্রিমেসির নামে ডোনাল্ড ট্রাম্পের তাণ্ডবে তারা মোটেও বিচলিত নন। রাসায়নিক অস্ত্র মজুতের মিথ্যা অভিযোগে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ইরাকে কার্পেট বোম্বিং করাতে তাদের মানবিক হৃদয় কাঁপেনি। ইরাকের নিরীহ জনগণের অপরাধ ছিল তাদের শাসক সাদ্দাম হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। মজার বিষয় সাদ্দাম হোসেন যদি দানব হয়েও ওঠেন, হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মদতেই। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ যাদের বিরুদ্ধে সেই আইএস আর তালেবান কাদের সৃষ্ট?
আমাদের মানবাধিকার আর নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগও কম নয়। যদিও একমেরু বিশ্বে জাতিসংঘ তার মহিমা হারিয়েছে অনেকটাই আর বাকি অস্তিত্বটুকু অনেকাংশেই নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র জোটের অর্থায়নের ওপর। কাজেই কর্তাদের চিঠি পেলে (পড়ুন কংগ্রেসম্যান) তাকে তো মুখ রক্ষার্থে কিছু একটা বলতে হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন আমাদের পুলিশের বলপ্রয়োগ নিয়ে একটা বিবৃতি দিয়েছেন। জানতে ইচ্ছে করে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ অভিযোগ তো আগেও ছিল। এখানেই কংগ্রেসম্যানদের চিঠির সঙ্গে বিবৃতির যোগসূত্রটি পরিষ্কার। হাজার হলেও কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।
দুষ্টু লোকেরা বলে, ‘সম্ভব হলে আর ক্ষমতা থাকলে জাতিসংঘ মহাসচিব মার্কিন প্রেসিডেন্টের যে কোনো ইচ্ছাকে সদস্যদের জন্য আইন বলে ঘোষণা দিতেন। পারছেন না কেবল ওই ভেটো ক্ষমতার জন্য।’ প্রশ্ন উঠতেই পারে, ইরাকের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যে মানবিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার রাশ টানতে অথবা সুষ্ঠু তদন্তে জাতিসংঘ কী ভূমিকা রেখেছে? এমন উদাহরণ তো অনেক।
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড অস্বীকার না করেও বলা যায় ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের সংঘাতে জাতিসংঘের ভূমিকা খর্ব হয়েছে অনেকটাই। অন্তত তার প্রতিষ্ঠার পটভূমি বিবেচনায় নিলে। এটি পরিষ্কার যে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যদি নিজেদের স্বার্থে জাতিসংঘকে প্রভাবিত করে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমাদের এখানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামগ্রিক স্বার্থ নিয়ে আলোচনার পরিসর এই লেখা নয়। কিন্তু সর্বজনীন মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালার যে লেবাস তারা ধারণ করে আছে, তার অন্তরালের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাপী চিন্তাশীল মানুষদের মনে প্রশ্ন আছে। এমনকি খোদ মার্কিন মুল্লুকেও। এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো দেশ দখল, হত্যা, ক্যুর দিনগুলো পেছনে ফেলে এখন গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের নামে আসলে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত। সেজন্য তাদের অস্ত্র আগের মতো গুপ্তহত্যা, ক্যু নয় বরং প্রকাশ্য নিষেধাজ্ঞা আর ভিসানীতি কিংবা অনুদান বন্ধের মতো বিষয়। বিশ্বাস করা কঠিন, তাদের সব উদ্বেগ কেবল বাংলাদেশের মানুষের জন্য। তাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথাই যেখানে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ। তারা তাদের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র বদলেছে, এ কথা বিশ্বাস করারও কোনো কারণ নেই। বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় কোন রাষ্ট্র একা টিকে থাকবে এটি সম্ভব নয়, সেটা বলছিও না। এখানে সবকিছু নির্ধারিত হয় পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায়। এই স্বার্থ সংরক্ষণে প্রতিনিয়ত যে দরকষাকষি সেখানে নিজের দুর্বলতা অন্যের পাতে তুলে দিলে সে অন্যায় সুযোগ নিতেই পারে। অন্তত আশঙ্কা অমূলক নয়।
তারপরও দেখছি, বর্তমানবিরোধী দলগুলো নির্বাচন সামনে রেখে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরছে মোড়লদের। আবার ক্ষমতাসীনরাও মোড়লদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে একধরনের সতর্ক অবস্থানে।
বিশ্বে চমক লাগানো উন্নয়ন আর অগ্রগতিতে নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়ানো বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে এ অবস্থা কি কাম্য। বিরোধী দলগুলো ঢালাওভাবে সরকারকে দায়ী করে খাল কেটে কুমির ডেকে আনার যে পথ তৈরি করেছে তা কতটা গ্রহণযোগ্য। আজ যে বিরোধীদলগুলো ভোটাধিকার হরণের কথা বলে সত্যিকারার্থে ২০১৪ কিংবা ২০১৮’র নির্বাচনে তাদের ভূমিকা কী ছিল। ২০১৪ তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে এবং সেখানে কারচুপির ঘটনা ঘটলে তাদের দাবির অনেক বেশি যৌক্তিকতা থাকতো। সেবার তারা স্বেচ্ছায় ট্রেন মিস করে স্টেশনে আগুন দিয়েছে। অর্থাৎ জ্বালাও পোড়াও করেছে। ২০১৮’র নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন, সমালোচনা আছে। তার যে সত্যতা নেই এমনও নয়। এমনকি সরকারের অন্দরমহলেও এমন ফল প্রত্যাশিত ছিল না বলে শোনা যায়। কিন্তু বিরোধী দলের ভূমিকাও তো প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম বিতর্কিত নাম ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে অন্তরালের খেলা নিয়েও কথা আছে। সে নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মনোয়নের শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। প্রশ্ন ছিল মাঠে না থাকা বা আগেই মাঠ থেকে উঠে যাওয়া নিয়ে। তারা অজুহাত দেখান হামলা, মামলা, নির্যাতনের। বিনয়ের সঙ্গে বলি, এদেশে পূর্বেও হামলা, মামলা, নির্যাতন সত্ত্বেও আন্দোলন হয়েছে এবং তা সফলও হয়েছে। এটা বললে কি ভুল হবে তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশের গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনীব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ করা। এক্ষেত্রে ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে তারা কিছুটা হলেও সফল অন্তত সে অজুহাতে মোড়লদের বর্তমান আনাগোনা সেটাই বলে। এটা সত্যি, গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো তাকে প্রশ্ন করা যায়। এর মানে এই নয় যে অপপরিকল্পনায় তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে।
বিএনপির সামনে এবার সুযোগ ছিল তত্ত্বাবধায়ক নামের এক দফার অচলাবস্থা সৃষ্টি না করে নতুন উদ্ভাবনী রাজনীতি মাঠে আনার। রাজনীতিতে যে কোনো ভালো পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিপক্ষের জন্য সম্মানজনক অবস্থানের পথ খোলা রাখা। এখানে প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা ও ভিত্তিও বিবেচনায় নিতে হয়। বিএনপি কি ভাবছে আওয়ামী লীগকে ‘রাজনৈতিক আত্মহত্যার’ মতো দাবি মেনে নেওয়ার শক্তি তারা অর্জন করেছে? যেখানে বর্তমান সংবিধান অন্তত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন করছে না। সংবিধান সংশোধন করতে হলেও আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কি সেটি এই মুহূর্তে সম্ভব?
যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন সারা পৃথিবীতে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আমাদের এখানে তা হতে বাধা কোথায়? যারা ক্ষমতায় আছেন আর যারা আগামীতে ক্ষমতায় যেতে চান তারা যদি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করতে না পারেন তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন কোন অধিকারে? নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের কথা না বলে পুরোনো তত্ত্বাবধায়ক ধারণা আঁকড়ে থেকে প্রতি পাঁচ বছর পর পর একটি অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠায় তারা যে আসলে নিজেদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করছেন এ লজ্জা কি তাদের স্পর্শ করে? বিরোধীরা কি ভাবছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানেই তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চয়তা আর তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারি দলকেই! অথবা মোড়ল ডেকে এনে সরকারকে বাধ্য করবেন তাদের দাবি মেনে নিতে। তারা স্বপ্নজাল বুনতেই পারেন।
কিন্তু যাদের জন্য রাজনীতি সেই জনগণ বিষয়টি কীভাবে দেখছে। সাধারণ মানুষ রাজনীতিকদের আমাদের ভোটের অধিকার নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রদূতদের বাসভবনে ছোটাছুটিরত দেখতে চায় না। জানি তাদের নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাসের দেওয়াল অনেক পুরু কিন্তু এমন তো নয় যে তা ভাঙা যাবে না। নিজেদের মধ্যে সংলাপে যা সম্ভব, সেজন্য গল্পের সেই অবুঝ বালিকার মতো ঘরের কথা নিয়ে মোড়লদের কাছে অভিযোগের পসরা সাজিয়ে কেন হাজির হতে হবে। যখন মোড়লদের অতীত চরিত্র এবং বর্তমান উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।
এইচআর/ফারুক/এএসএম