ভারতের চন্দ্র বিজয়
বিজ্ঞান চেতনা এক সংস্কৃতি যে অযৌক্তিক ধারণাকে প্রশ্রয় দেয় না
ইতিহাস গড়েছে ভারত। চাঁদে সফলভাবে অবতরণ করেছে দেশটির মহাকাশযান যার নাম চন্দ্রযান-৩। এর মধ্যদিয়ে বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে চাঁদে মহাকাশযান পাঠালো ভারত। এর আগে শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এই কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছিল। তবে উপরের তিন দেশকে ছাপিয়ে নতুন একটি রেকর্ড গড়েছে ভারত। ভারতের চন্দ্রযান-৩ প্রথমবারের মতো চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করেছে।
এই খবর ভারত ও ভারতীয় জনগণকে নতুন এক মর্যাদায় নিয়ে গেছে বিশ্ববুকে। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের এমন সাফল্য একই সাথে দারিদ্র্য ও অজ্ঞতা থেকে কঠিন উত্তরণেরও দৃষ্টান্ত।
আনন্দ উচ্ছ্বাসের ঢেউ বাংলাদেশেও লেগেছে। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের এই সাফল্যে আনন্দিত, একই সাথে অনেকের মাঝে হতাশাও লক্ষ্যণীয়। সামাজিক মাধ্যম দেখলে বোঝা যায় হতাশা ব্যক্ত হচ্ছে বাংলাদেশে ক্রমাবনতিশীল আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ব্যাপারে।
এই চন্দ্রাভিযানের সাথে জড়িয়ে আছেন একদল নারী বিজ্ঞানী যাদের ছবি এখন ফেসবুকে ভাসছে। উচ্চশিক্ষিত ও প্রযুক্তিদক্ষ এই ভারতীয় নারীরা এখনকার বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মনন ও প্রতিভার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছেন। তাঁরা উঠে এসেছেন এমন এক দেশ থেকে, যেখানে এখনও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর টয়লেট সুবিধা নেই।
আজকে আমরা যারা প্রতিবেশির এমন সাফল্যে উচ্ছ্বসিত তারা জানি কেন আমরা পারিনা। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর প্রধান একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী। আমাদের স্পারসোর প্রধান প্রশাসন ক্যাডারের একজন অতিরিক্ত সচিব। সংস্থার অন্যান্য কর্মকর্তারাও যুগ্ম-সচিব। বোঝাই যায় আমাদের সংস্থাটি কেন কিছু করতে পারবে না, কারণ তা কর্মকর্তাদের সেই দক্ষতাই নেই।
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি বক্তব্য এখন সর্বত্র পাওয়া যায়। তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে হতাশ হয়ে বলেছেন, ‘কোন বিজ্ঞানী নেই, গবেষক নেই, দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন শুধুই প্রশাসক’। এটাই বাংলাদেশ এখন।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে সারা বিশ্বে যখন বিজ্ঞান বিকশিত, আমাদের দেশে তখন মধ্যযুগের অন্ধকার। এখানে ফতোয়া আসে মেয়েদের ক্লাস ফোরের বেশি পড়ালেখার প্রয়োজন নেই। এই ফতোয়া যারা দেয় তাদের কওমী সনদ আবার মার্স্টাসের সমান মর্যাদাও পায়। আমাদের শিক্ষিত সমাজের ভাবনাও হলে - নারী কীসে আটকায়।
আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এমন এক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছে যে দেশে এখন সবাই বিসিএস পাস সরকারি কর্মকর্তা হতে চায়। ভাল গবেষক, ভাল প্রকৌশলী, ভাল চিকিৎসক হওয়ার চাইতে এখন তরুণ তরুণীরা চায় কোনো রকমে মুখস্ত বিদ্যায় বিসিএস পাস করতে। কারণ তারা দেখছে প্রশাসক হতে পারলে সবকিছু দখলে চলে আসবে। তখন কেবল ক্ষমতা ক্ষমতা, অন্তহীন রাষ্ট্রীয় সুবিধা, এবং তাদের অধীনে পদদলিত সব জ্ঞানী, বিজ্ঞানী।
হয় বিসিএস দাও, নয়তো ক্ষমতা কাঠামোর রাজনীতি কর - এই দর্শনে পড়ালেখাও উচ্ছন্নে যাচ্ছে। যারা আবার পড়ালেখা করছে তারা দেশ ছাড়ছে। যেটি বেশি করে আছে তা হলো মৌলবাদী দর্শনের বাড়বাড়ন্ত। ফলে চাঁদ তারা খচিত পতাকা পাওয়ার যতটা উগ্র বাসনা আছে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর, ততটা থাকবে না চন্দ্র বিজয়ের।
দেশে বিজ্ঞানশিক্ষার্থীর সংখ্যা হতাশাজনকভাবে কমছে। আর কমছে বলেই করোনার সময় ফতোয়া আসে যে, মুসলমানের করোনা হয় না। রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোর ভিতর এমন একটা বড় গোষ্ঠী আছে যাদের হাতিয়ার ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, উগ্রতা। সকালে ঘুম ভাঙা থেকে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত জীবনযাত্রার নানা উপকরণে বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিকগুলোকে ব্যবহার করতেই হয়। অথচ মানুষকে বিজ্ঞান বিমুখ করছে উগ্রবাদ।
যারা বিজ্ঞানমনস্কতার মানে বোঝেন, যারা সত্যিই মানুষকে যুক্তিবাদী হয়ে উঠতে সাহায্য করতে চান, আমাদের দেশে তাদের জীবন হুমকির মুখে। এই কয়েক বছর আগেও মুক্তমনা লেককদের লাগাতার খুন করা হয়েছে। একজন যুক্তিবাদী অভিজিৎ রায় প্রকাশ্যে খুন হয়ে যান বইমেলায়। মানবিক আদর্শে বিশ্বাসী মানুষটি যুক্তিবাদ ছাড়াও ছাড়াও বিশ্বায়ন, এমনকি ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়েও কলম ধরেছিলেন। উদার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ পেতে ৩০ লক্ষ শহীদের বাংলাদেশে আজ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলার মূল্য দিতে হয় জীবন দিয়ে।
ধর্মকে রাজনৈতিক পরিসরে নিয়ে এসে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করা হয়ে যে, ধর্মবিশ্বাস আর ধর্মাচরণের ক্ষতিকর দিকগুলোকে আলাদা করা সম্ভব হচ্ছে না। ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার ব্যাপারটাই তো এই রকম, নিজের ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতাই নষ্ট করে দেয়। অথচ বিজ্ঞানচেতনার গোড়ার কথাই যে যুক্তিনিষ্ঠ হওয়া, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতন হওয়া।
আমাদের সংবিধান অনুসারে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নিজের বিশ্বাস ও ধর্মাচরণের স্বাধীনতা যেমন আমাদের মৌলিক অধিকার, তেমনই বিজ্ঞানচেতনা গড়ে তোলা, মানবিকতা ও জ্ঞানের চর্চাকে উৎসাহিত করা আর উগ্রতাকে প্রতিরোধ করাও প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক কর্তব্য। কিন্তু আমাদের রাজনীতি আপোস করে চলেছে সেই রাজনীতির সাথে যে রাজনীতি ১৯৭১-এ বাংলাদেশ চায়নি। তাই কুসংস্কার বিরোধিতাকে আমাদের সংস্কৃতি করে তুলতে পারিনি।
ধর্ম-উদাসীন যুক্তিবাদী মানুষরা যে দেশে ভাল থাকে না সে দেশে কোনো বড় স্বপ্ন তৈরি হয় না। সে দেশে নারীরা পিছিয়ে যায়, তারুণ্য হতাশ হয়। বিজ্ঞান অযৌক্তিক ধারণাকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিরোধী। বিজ্ঞানচেতনা শুধু কিছু তত্ত্ব, ছবি আর চিহ্নমাত্র নয়, আসলে একটা সংস্কৃতি। আমরা সেখান থেকে আনেক দূরে বলেই শুধু চাঁদকে মামা ডেকেই স্বান্ত্বনা পাই।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এএসএম