তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রেই মানায়
পাকিস্তান সব সময় সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সংকটাপন্ন একটি দেশ। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সংকটে ভুগছে। ভঙ্গরতা কিংবা রাজনৈতিক ব্যর্থতা নিত্যসঙ্গী। তথাকথিত দ্বিজাতীতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হলেও এ রাষ্ট্রটি ঘিরে নাগরিকদের আশা ছিল অনেক। সে সময়ের ভারত বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারত দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় সাধারণ মানুষের মনে। কিন্তু দেখা গেলো ১৯৪৭ সালে বিভক্তির পর থেকেই পাকিস্তান একটি রাজনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
শুরু থেকেই সেখানে যে রাজনৈতিক সংকট বা ব্যর্থতা ছিল, তা এখনো বিদ্যমান। বস্তুত সেই ধারাই বয়ে চলেছে পাকিস্তান। তাই বলা যায়, পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নতুন কিছু নয়। দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতা, সহিংসতা তথা নানাবিধ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পাকিস্তানের ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। কারণ এ রাষ্ট্রই স্বাধীনতার পরপর তার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালিকে বহু সংগ্রাম আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। দিতে হয়েছে রক্ত। ফলে সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও তাদের চিন্তা এক অবাস্তব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হবে, এটাই যেন স্বাভাবিক।
ক্রমাগত একধরনের সহিংসতা এবং রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর যে সম্পর্ক, তা দেশটির রাজনীতির গতিপ্রকৃতির ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক বাহিনী বরাবরই দেশটির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করছে। সুদীর্ঘ সময় দেশটির রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে সামরিক শাসকদের দ্বারা। পাকিস্তানের সামনে যে বিষয়গুলো এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ তার একটি হচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তানের অবস্থা এখন খুবই নাজুক।
দেশটিতে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নেই, আগামী এক মাস বা পনেরো দিনের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো সম্পদ নেই। দেশটিকে উদ্ধার করার জন্য চীন ও পশ্চিমা দেশগুলো একসঙ্গে কাজ করছে; বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও কাজ করছে। এ অবস্থার মাঝে পাকিস্তানের রাজনীতি এমন এক ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা দেশটিকে খুবই বিপজ্জনক ও অত্যন্ত সংকটময় অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। বস্তুত রাজনৈতিক দিক থেকে পাকিস্তানের অবস্থা দোদুল্যমান। একদিকে সামনে যে নির্বাচন ওই নির্বাচনটি মুসলিম লীগ করতে চাচ্ছে না, কারণ পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন এ নির্বাচন হোক পাঁচ বছর মেয়াদ সম্পন্ন করার পর।
অন্যদিকে পার্লামেন্টের মেয়াদ অনুযায়ী পাকিস্তানের নির্বাচন অক্টোবরে হওয়ার কথা। ইমরান খান আর তার দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি চাচ্ছে নির্বাচনটি পার্লামেন্টের মেয়াদ অনুযায়ী অর্থাৎ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হোক। অর্থাৎ নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে বিরোধ। সবকিছু মিলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মতবিরোধ, মতপার্থক্য, সহিংসতা বিদ্যমান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাকিস্তানের মতো এমন ব্যর্থ রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা। বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাসহ সব ধরনের স্থিতিশীলতা বিদ্যমান সেই দেশের সরকার ব্যবস্থা কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা হতে পারে না।
অতীতে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো পক্ষপাতদুষ্ট, অযোগ্য, অগণতান্ত্রিক এবং অপ্রয়োজনীয় বলে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। একাধিকবার তারা সামরিক ও বিচার বিভাগের সম্মুখীন হয়েছে। তা সত্ত্বেও সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের ফলে পাকিস্তানে পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং জাতীয় পরিষদের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ নিয়ে ভেতর ভেতর তুমুল বাগবিতণ্ডার পর অবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সিনেটর আনোয়ারুল কাকারের নাম ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের কার্যালয়। সরকারের মেয়াদ শেষ ও নতুন সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত দেশটিতে গণতান্ত্রিক কাঠামোর সবচেয়ে আলোচিত এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্মও সেনাশাসকের ঘরেই।
একটা স্বাধীন দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তখনই নির্বাচন পরিচালনা করার কথা আসে যখন ওই দেশে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা- বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে। বাংলাদেশের মতো এমন একটি শান্তি-শৃঙ্খলাপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো অস্থায়ী সরকার ব্যবস্থা কাম্য হতে পারে না। কারণ আমাদের রয়েছে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে লিখিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশ সংবিধান। এই আইনের আলোকে গঠিত হয়েছে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, যা পাকিস্তানের মতো দেশে কখনো ছিল না।
বাংলাদেশে বর্তমানে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাসহ সব ধরনের স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কেননা এদেশে বিদ্যমান সব রাজনৈতিক দল স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করার এবং সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ পাচ্ছে। সবগুলো দল নির্বাচনে সমানভাবে অংশগ্রহণ ও নির্বাচন করে নির্বাচিত হয়ে জনগণের কল্যাণে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন ও দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার সর্বোচ্চ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কথা বলে দেশের শৃঙ্খলাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট করার কোনো ধরনের যুক্তিকতা নেই।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ এবং সুকৌশলী নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার পথে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাহলে কোন যুক্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো অস্থায়ী সরকারের অবান্তর দাবি তুলে দেশের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক করতে চাচ্ছেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যে বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা নয় বরং পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা তার আরেকটা কারণ এই যে ২০০৭ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অতীত অভিজ্ঞতা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সব নেতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটা অনির্বাচিত সরকার পরবর্তী দুই বছর ধরে যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল, তা সাধারণত কোনো জান্তা সরকারই করে। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়াশী লীগ ও অন্যান্য দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীদের বিভিন্ন হয়রানি করা ও জেল-জরিমানা দেওয়া হয়। সেদিনের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় প্রভাবক হয়ে থাকতে পারে।
সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজির (ইআইটি) সদস্য এবং ইইউ’র সাবেক কমিশনার ও ধর্ম বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়ান ফিজেল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এমন একটি ব্যবস্থা যা বিশ্বের আর কোথাও নেই। ২০১১ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকার বলেছে, আগের নির্বাচনগুলোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কারণ সে সময়ে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের কোনো আইনি ভিত্তি ছিল না।
তবে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি নতুন আইন পাস করা হয় এবং সে অনুযায়ী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন হয়েছে সংবিধান স্বীকৃত। সংবিধান স্বীকৃত এমন নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকার পরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করা নিতান্তই অবান্তর। সুতরাং বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশ। গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে এদেশের মানুষ শান্তিতে আছে এবং দেশ ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে।
বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে হৈ চৈ করে দেশের শান্তিকামী মানুষের জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করা। বরং তাদের উচিত জনসমর্থন আদায়ে মাঠে থেকে জনগণের সমর্থন আদায় করার মাধ্যমে জনগণের ভোটে নির্বাচনে জয়লাভ করার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা। কোনো রাজনৈতিক দলেরই উচিত হবে না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের নামে দেশের শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করা। তাদের মনে রাখা উচিত যে জনসমর্থনহীন কোনো দলেরই নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভব হবে না সে যার অধীনেই নির্বাচন হোক।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত জনসমর্থন ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস রেখে পথ চলেছে যার জন্য জনগণ আওয়ামী লীগকে কখনও বিএনপির মতো ছুড়ে ফেলে দেয়নি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বরাবরের মতো জনগণের ওপর বিশ্বাস ছিল এবং আছে এবং থাকবে।
অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো এমন অবান্তর দাবি করে গলা ফাটানো থেকে বিরত থাকা এবং দেশকে নিয়ে সব ধরনের ষড়যন্ত্র বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে দেশের জনকল্যাণে অংশগ্রহণ করার সুযোগ লাভে সচেষ্ট থাকা। আমাদের সবাইকে সবসময় অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেবলই পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা নয় এবং কখনো হতেও পারে না।
লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/ফারুক/এএসএম