ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

তামাশার মাঝে ঘোর তমাশায় নিভু জীবন

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:৫৫ এএম, ২৩ আগস্ট ২০২৩

ডেঙ্গু নিয়ে দিন যতই গড়াচ্ছে ততই নতুন তথ্য শোনা যাচ্ছে। দেশে এবছর ডেঙ্গুমৃত্যু শুরু হওয়ার পর থেকে সবাই মনে করেছিল এটা এমন আর কি? প্রতি বছরই তো এ ঘটনা ঘটে, আবার থেমে যায়। এবারও থেমে যাবে। কিন্তু এবারের ঘটনাটা উল্টো। এবছর ডেঙ্গুমৃত্যু শুরু হওয়ার আড়াই মাস গত হলো। রেকর্ড ভেঙে মৃত্যুসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সারাদেশে জনমনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলদের মধ্যে নানামুখী তৎপরতা। এসব তৎপরতা ইতিবাচক দিক নির্দেশনা ও যৌক্তিক কোনো সমাধান দিতে পারেনি। এতদিনে যা বোধগম্য ছিল না তা গত ১৯ আগস্টের এক সেমিনারে বিভিন্ন বক্তার বক্তব্য থেকে উৎকণ্ঠিত মানুষ জানতে পেরে বিস্মিত হচ্ছেন।

কিছুদিন আগে জানা গিয়েছিল দেশে ডেঙ্গু নিয়ে কাজ করছেন একজন মাত্র কীটতত্ত্ববিদ। সেমিনারে জানা গেলো দেশে অনেক কীটতত্ত্ববিদ রয়েছেন, যারা ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণা করেছেন। কিন্তু ভয়াবহ এডিস নিয়ন্ত্রণে কাজে তাদের তেমন কোনো সম্পৃক্ততা নেই। একটি সিটি করপোরেশনে কীটতত্ত্ববিদের কাজ করে চলেছেন চিকিৎসক। সেখানে কীটতত্ত্ববিদদের উপেক্ষা করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হয়।

গবেষণার বিষয়টি প্রাধান্য পায় না। আবার দেশে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিল্যাবে ডেঙ্গু নিয়ে তাড়াহুড়ো করে গবেষণা করে নানা অর্ধসত্য ও অসত্য তথ্য পরিবেশন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের কর্মকতার্রা এডিস নিয়ন্ত্রণে নর্দমার মধ্যে হাঁস, ব্যাঙ, তেলাপিয়া ও টাকিমাছ, ফড়িং ছেড়ে দিয়ে অর্থের অপচয় করছেন। এসব উদ্যোগকে জনগণের টাকায় শুধু তামাশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত কোনো বিজ্ঞানী বক্তা!

এসব বক্তব্য গত রাতের গণমাধ্যমে বেশ ফলাও করে প্রচার হয়েছে। দেশেই নয়, সারা বিশ্বের মানুষ জেনেছে আমাদের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও সেটা নিয়ন্ত্রণে গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে অসাড়তার বিভিন্ন কারণ। যেটা সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিকটু তা হলো— বেপরোয় এডিসের চেয়ে মশক নিয়ন্ত্রকরা দীর্ঘদিন ধরে বেশি বেপরোয়া হয়ে পরস্পরের মধ্যে অসহিষ্ণু ভাব পোষণ করে চলেছেন। যে সেক্টরে যেখানে যার ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করার কথা সেখানে তাদের কোনো স্থান নেই।

ক’দিন আগে দেখা গেছে মানুষ যখন ডেঙ্গুভয়ে ভীত তখন তাদের বাড়িতে ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে জরিমানা করা হচ্ছে। আবার দেখা গেলো, মশক নিয়ন্ত্রণের জন্য বিদেশ থেকে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই অকার্যকর বা ভেজাল ওষুধ আমদানি করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশা বহুল প্রচলিত অনেক ধরনের কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। তাই প্রচলিত ওষুধে ওদের মারা সহজ নয়।

আগ্রাসী এডিসের কামড় থেকে বাঁচার জন্য মোটিভেশন কর্মসূচি যৎসামান্য। ফলে সারাদেশ থেকে রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার মাঝে হাসপাতালগুলোতে বাজে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর পাশাপাশি ইতোমধ্যে চারজন চিকিৎসক ডেঙ্গুর শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। নিজের দোষ স্বীকার করতে অনভ্যস্ত জাতি আমরা। তাই এত ভয়াবহতার মাঝেও ডেঙ্গুকে মহামারি হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি নেই। কিন্তু আমরা জানি যে, কোনো সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় প্রথম ধাপ হলো— সেই সমস্যা সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। আমরা ক্রমাগত অস্বীকার করে ডেঙ্গুকে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছি।

এখন বলা হচ্ছে, আত্মরক্ষার দায়িত্ব সবার! তাই যদি হয় তাহলে এতদিন পর একথা বলা কি প্রবঞ্চনা ও সামাজিক অপরাধ নয়? কারণ এডিসের কামড় থেকে আত্মরক্ষাকল্পে যেসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জনগণ অতি সহজে নিজেরাই নিতে পারতো সেসব ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ-সুবিধা খোদ রাজধানীতেই অনেক মানুষের নেই। যারা ফুটপাতে মশারি ছাড়া ঘুমায় বা যারা ছেঁড়া মশারি টাকার অভাবে বদলাতে পারে না তাদের জন্য সারা বছর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়ার সময় ছিল।

বিত্তশালীদের ফুলের টবের পানি ফেলে দিতে বলা হয় কিন্তু শহরের নিচু ও বস্তি এলাকায় যাদের ঝুপড়ি ঘরে ঢুকতে সব সময় জমানো হাঁটু বা গিরা সমান পানি মাড়িয়ে চলতে হয় তাদের জন্য উপায় কি? তাদের বসতির পাশে সারা বছর পানি জমে থেকে এডিস, কিউলেক্স, অ্যানোফিলিস সবাই বংশ বিস্তার করার সুযোগ পায়। সব মশার পাখা আছে। তারা উড়ে চলে এদিক-সেদিক। মানুষের সাথে অরক্ষিত ট্রেনে, বাসে গাড়িতে চড়েও ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়ে যায়।

তবে যে কোনো পরিবেশের মধ্যে এডিসের অভিযোজন ক্ষমতা অতি বেশি বলে গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে। আমরা জানি অন্য প্রজাতির শুধু স্ত্রীজাতীয় মশারা তাদের ডিম্ব পরিস্ফুটনের জন্য অতিরিক্ত পুষ্টি পেতে মানুষের শরীরের রক্ত খায়। কিন্তু এডিস মশা শুধু ডিমের জন্যই নয়, বরং নিজেদের ক্ষুধা মেটাতে মানুষের শরীরের রক্ত খেতে বার বার কামড়াতে আসে। ফলে একটি ডেঙ্গু সংক্রমিত এডিসের মাধ্যমে বহু মানুষের দেহে ডেঙ্গু সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশিগুণ বেড়ে যায়।

ফলে যাদের বাসস্থান উন্মুক্ত, কাজের জায়গায় অন্ধকার ও ঘুপচিময়, দেহে পর্যাপ্ত কাপড় থাকে না বা উন্মুক্ত, তাদের এডিস বার বার কামড়ানোর সুযোগ পায়। এমন কেউ আক্রান্ত হলে তাদের মাধ্যমে গণসংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তাই এডিসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এ মশার প্রজাতিকে ভালো মশায় রূপান্তরিত করার জন্য জৈব পদ্ধতির ওপর জোর দিচ্ছেন গবেষকরা।

এজন্য দুটি জৈব পদ্ধতি হলো— উলবাকিয়া এবং এসআইটি। প্রথমটি হলো মশার পপুলেশন সাপ্রেশন করতে উলবাকিয়া ব্যবহার করা। উলবাকিয়া এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। কীটতত্ত্ববিদরা বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে উলবাকিয়া দুভাবে প্রয়োগ করা যায়। এক. শুধু পুরুষ মশা ছেড়ে। এতে উলবাকিয়াযুক্ত পুরুষ মশা প্রকৃতিতে স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলিত হলে যে ডিম উৎপাদিত হবে, সেগুলো থেকে লার্ভা হবে না। এতে প্রকৃতিতে এডিস ইজিপ্টাই মশার সংখ্যা কমে যাবে।’

দুই. পপুলেশন রিপ্লেসমেন্ট করা। বলা হয়েছে, ‘স্ত্রী ও পুরুষ উভয় ধরনের মশা, যেগুলোর মধ্যে উলবাকিয়া আছে, সেগুলো প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রকৃতিতে উলবাকিয়াযুক্ত স্ত্রী মশা যদি কোনো পুরুষ মশার সঙ্গে মিলিত হয়, তবে যে বাচ্চা হবে, সেগুলো হবে উলবাকিয়াযুক্ত। উলবাকিয়াযুক্ত পুরুষ ও স্ত্রী মশা যদি মিলিত হয়, তাহলেও সব বাচ্চা হবে উলবাকিয়াযুক্ত। ফলে কিছু সময় পর প্রকৃতির সব এডিস মশা উলবাকিয়া দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে; অর্থাৎ তাদের আর ডেঙ্গু ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বন্ধ হয়ে যাবে বা একদমই কমে যাবে।’

আর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির আরেকটি হলো স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক (এসআইটি) বা কীট বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতি। পৃথিবীর এডিস মশাবহুল বিভিন্ন দেশে ৩৪টি পাইলট এসআইটি ট্রায়াল চালু রয়েছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এডিস মশার এসআইটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।

গবেষণা করে এডিস নিয়ন্ত্রণ করার বিকল্প নেই। কারণ, শুধু ওষুধ প্রয়োগ মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতি হবে। কাড়ি কাড়ি টাকার অপচয় হবে। মশার বংশও ধ্বংস করা যাবে না।

অন্যদিকে মশার ডিম ও পূর্ণাঙ্গ মশা হলো মাছ, পাখি ও অন্যান্য উপকারী পতঙ্গের খাবার। তাই মশাকে বিলুপ্ত করলে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হতে পারে। সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না— এ নীতিতে এডিস দূর করে দেশ থেকে ডেঙ্গু নির্মূল করতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গু নিয়ে বিভিন্ন নটরাজদের তামাশার মাঝে ঘোর তমাশায় এডিসের মরণ কামড় ফিবছর জনগণের কাছে ভয়াবহ মৃত্যুদূত হিসেবে হাজির হয়ে চরম আস্ফালন করতেই থাকবে বৈ—কি!

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এএসএম

আরও পড়ুন