কী চান ড্যাব নাকি স্বাচিপ!
রাজনীতিকরা কথা বলেন। এটা তাদের কাজেরই অংশ। সরকার পক্ষ তাদের কাজের সমর্থনে আর বিরোধীরা সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কথা বলবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খুব স্বাভাবিক বিষয়টি নিয়ে স্বাভাবিক পথে হাঁটতে হবে এমন দোহাই তো আমাদের রাজনীতিকদের কেউ দেয়নি! কাজেই তারা কথা বলেন, পরিণাম ভেবে বলেন, পরিণাম না ভেবেও বলেন। স্বেচ্ছায় বলেন, স্বদেশি গোষ্ঠী স্বার্থে বলেন, বিদেশি মোড়লের স্বার্থে বলেন (রাষ্ট্র/জনগণের স্বার্থ তখন গৌণ)।
কথা বলে যদি শান্তি পান, বলুন; আপত্তি নেই। কথা তো বাঙালি অহরহ বলছে। এনিয়ে তার খ্যাতিও আছে। চা’র দোকান থেকে সচিবালয়ের বারান্দা, কথার বিস্তারে কেউ পিছিয়ে নেই। সেগুলো না হয় কথার কথা। কিন্তু দায়িত্বশীল জায়গা থেকে যখন কোনো রাজনীতিক কথা বলেন তার ভবিষ্যৎ পরিণাম মাথায় রেখেই কথা বলা উচিত। এটাই কাম্য। প্রসঙ্গে আসি।
প্রথম আলো অনলাইনে (১৭.০৮.২০২৩) ‘খালেদা জিয়ার খাবারে সরকার কিছু মিশিয়ে ছিল কি না, সন্দেহ রিজভীর’ প্রকাশিত সংবাদের একাংশে দেখলাম, জনাব রুহুল কবির রিজভী বলছেন, ‘যে ব্যক্তিরা, যে ডাক্তাররা তার (সাঈদী) ফাঁসির জন্য স্লোগান দিয়েছে, তাদেরই নিয়োজিত রাখা হয়েছিল তার চিকিৎসার জন্য। এটা কি সন্দেহের উদ্রেক করবে না, রহস্যের উদ্রেক করবে না?’
জনাব রিজভীর উপস্থাপন কৌশলী কিন্তু ইঙ্গিত পরিষ্কার। সাঈদীর চিকিৎসকদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে জল ইতোমধ্যে অনেক ঘোলা হয়েছে। একজন চিকিৎসক হত্যার হুমকি পেয়ে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি পর্যন্ত করেছেন। একজন হুমকিদাতাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। চিকিৎসকের পক্ষ থেকে দেওয়া ব্যাখ্যাও আমরা গণমাধ্যমে শুনেছি। আমার আলোচনার বিষয় সেটি নয়। কোনোরকম তদন্ত ছাড়াই রুহুল কবির রিজভীর মতো একজন সিনিয়র নেতা যখন এ ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ অভিযোগ আনেন তখন আমাদের গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থাটাকেই কি বিতর্কিত করা হয় না। বিষয়টি যদি এভাবে বলি রুহুল কবির রিজভী কে যদি কোনো কারণে চিকিৎসা নিতে হয়, তার পক্ষে চিকিৎসক ড্যাব না স্বাচিপ এটা জেনে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
স্বাচিপপন্থি চিকিৎসকের কাছে তিনি সুচিকিৎসা পাবেন না এই ভেবে ড্যাবপন্থি চিকিৎসক বেছে নিতেই পারেন। তাতে আমার আপত্তি নেই, আমার প্রশ্ন অন্যখানে। গ্রামের একজন সাধারণ বিএনপিকর্মী সে কী করবে? সে কি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসককে আগে জিজ্ঞেস করবে, ডা. সাহেব আপনি ড্যাব না স্বাচিপ? অথবা জীবন সংকটাপন্ন এমন একজন বিএনপি কর্মী-নেতা হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে বলবেন, ‘যেহেতু আমার সঙ্গে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছবি আছে তাই আমি ওনার চিকিৎসা করবো না।’
অথবা একজন গুরুতর অসুস্থ আওয়ামী লীগ নেতা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এলে চিকিৎসক যদি বলেন, ‘আমার সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার ছবি আছে তাই আমি ওনার চিকিৎসা করতে ভয় পাচ্ছি’, তখন বিষয়টি কি দাঁড়াবে। ইউটিউব আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়ানো কথা আর একজন দায়িত্বশীল রাজনীতিক নেতার বক্তব্য কি সমান?
যুক্তি আরও অনেক দেখানো যায়। কিন্তু সব বাদ দিয়ে সহজ করেও যদি প্রশ্ন করি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কেবল সন্দেহের কারণে কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই চিকিৎসা পদ্ধতির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে দায়িত্বশীল জায়গা থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কতটা মানায়? আরেকটু এগিয়ে যদি জানতে চাই, চিকিৎসকদের রাজনৈতিক ছাতায় আনতে এই ড্যাব, স্বাচিপ কারা সৃষ্টি করেছিল? আজ আবার আপনারাই রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাটাকেই বিতর্কিত করতে চাইছেন? এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কি ভেবে দেখেছেন? আপনারা কি চান, একজন ডাক্তার তার ভিজিটিং কার্ডে-নেমপ্লেটে তার নামের পাশে ব্রাকেটে ড্যাব বা স্বাচিপ লিখে রাখবে। যাতে রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হয়ে রোগী চিকিৎসা গ্রহণে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
জনাব রিজভীর অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু এ ধরনের বিষয়ে বাজারে কথা ছড়ানোর আগে নিশ্চিত হওয়ার বিকল্প পথও তো ছিল। তিনি চাইলে বিএনপিপন্থি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে একটি দল গঠন করে চিকিৎসায় গৃহীত ব্যবস্থাগুলো পর্যালোচনার প্রস্তাব দিতে পারতেন। তারপর যথাযথ তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ আনলে না হয় বুঝতাম। কিন্তু তার আগে এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ শেষ পর্যন্ত পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে সেটি কি তিনি বোঝেন?
অবশ্য আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করতে রাজনীতিকদের উৎসাহের কমতি কখনোই ছিল না। ‘আমরা আর মামারা’ সূত্রে নিয়মনীতি বিশ বাঁও জলে ডুবিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছেন তারা, সে প্রশ্ন বাতাসে ভাসছে অনেকদিন। বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতায়, অর্বাচীন কথাবার্তায় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হলে পরিণাম কি হতে পারে সেটি বলার আগে একটি গল্প বলি:
এক গ্রামে দরিদ্র বাবা-মা খুব কষ্ট করে তার ছেলেকে পড়াচ্ছিলেন। সবাই বলতো, পড়ালেখা করিয়ে কি লাভ, পড়ালেখা করলেও ওর চাকরি হবে না। তারচেয়ে কাজে দাও দুটো পয়সা আসবে। পড়ালেখা শেষে ছেলের চাকরি হলো। এবার সবাই বললো, চাকরি হলে কি হবে বেতন পাবে না। ছেলে বেতনও পেলো। বিরোধী পক্ষ বলা শুরু করলো, বেতন হয়েছে তো কি হয়েছে, ছেলে তো আর আজীবন বাঁচবে না।
এখানে আজীবনের জায়গায় চিরদিন হলে সেটি ব্যাকারণগতভাবে শুদ্ধ হতো। মূর্খের এটুকু ভুল ক্ষমা তো করাই যায়। সেটুকু ক্ষমা করে গল্পের মাজেজাটা বলি, এখানে ছেলেটির জায়গায় প্রতীকী অর্থে দেশ ধরে নেই। এবার প্রিয় রাজনীতিকরা আপনাদের বলি, আমরা কেউই চিরদিন বাঁচব না। কিন্তু অনেক রক্তে পাওয়া বাংলাদেশ চিরদিন টিকে থাকবে এটা তো নিশ্চয়ই সবারই প্রত্যাশা। দয়া করে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতায় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করবেন না। প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হলে শেষ পর্যন্ত দেশের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
কথাগুলো সরকার এবং বিরোধীদল দুপক্ষের জন্যই প্রজোয্য। পোশাক পরিহিত ওসি সাহেব ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যের জন্য ভোট চাইলে সংসদ সদস্যের ভোট বাড়ে কি না জানি না। আর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতায় কার লাভ তাও জানি না। তবে এটা জানি উভয়ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।
এইচআর/ফারুক/এএসএম