একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা
ভয়ংকর এক শনিবার ও রাজনৈতিক হিংস্রতা
শ্রাবণের ক্রন্দন ধ্বনি জানিয়ে দেয় শরতের আগমনী বারতা, আসে মধ্য-আগস্টের পিঠে সওয়ার হয়ে। এই সেই আগস্ট যবে প্রকৃতির ক্রন্দন ধ্বনি বাঙালির জাতীয় জীবনে বিষাদে রূপ নিয়েছে বারবার। শুভ্রতায় অবগাহন করে শরতের আগমনী- শুভ্র মেঘ, কাশফুল আর কলমি শাখের দোলে, শিউলি-কদমের হিন্দোলে। সেই শরতেই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে রচিত হয়েছে অনেক বেদনার ইতিহাস, লেগেছে অজস্র কালিমা।
শুভ্র আলোয় ঝলমলে এক বিকেলে ঢাকার রাজপথে নেমে এসেছিল এক বিদঘুটে আঁধার, যেন দিনের আলো নিভে গিয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। চারদিকে ছোপ ছোপ রক্ত, পড়ে থাকা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ আর অবিস্ফোরিত গ্রেনেড, আহতদের আর্তনাদ, রক্তাক্ত নেতাকর্মীদের ছোটাছুটিতে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল আগস্টের সেই ভয়ংকর শনিবার।
সেদিন হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সভাপতি, জাতির পিতার কন্যা, বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সন্ত্রাসবাদ, হত্যা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিবাদের অংশ হিসেবে মিছিলপূর্ব-সমাবেশে আহ্বান করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা’র বক্তব্য সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই তাকে লক্ষ্য করে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মহুর্মুহু গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে থাকে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে রক্ষার জন্য মানববর্ম রচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বঙ্গবন্ধু তনয়া সেদিন বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান আইভি রহমানসহ চব্বিশ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং শত শত নেতাকর্মী পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর এটাই প্রথম আক্রমণ নয়, আগের বহুবার তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হয়েছে। ১৯৮১ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই একের পর এক রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হয়েছেন তিনি। রাজনীতির কঠিন ব্রত ও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের সাধনা থেকে তাকে বিরত রাখতে না পেরে হত্যাচেষ্টা চলেছে বারবার। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করাই ছিল এসব হামলার মূল লক্ষ্য।
বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে আগস্ট মাস বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তি ও তাদের প্রেতাত্মারা। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদ মাথা উঁচিয়ে জানান দিয়েছিল। অর্থাৎ নাইন-ইলিভেনের ডামাডোলে জোট সরকারের প্রশ্রয়ে উত্থিত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ, ২১ আগস্ট হামলা ও হামলায় জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা এসব কিছু কাকতালীয় নয়, বরং জোট সরকারের সুচিন্তিত রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের প্রতিফলন।
যেসব মহান আদর্শ- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আদর্শ ঠিক করেছে, সেসব আদর্শের বিরোধী শক্তিই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। কিন্তু তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সমুন্নত রয়েছে, এগিয়ে চলছে দেশ। তাই, যেসব অপশক্তি মুজিব আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করতে চায় তারা বারবার বঙ্গবন্ধু কন্যাকে নিঃশেষ করতে চেয়েছে। সুতরাং, এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা একই সূত্রে গাঁথা। আর এর নেপথ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিনাশের অপচেষ্টা।
সন্দেহাতীতভাবে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা রাষ্ট্রীয়মদতপুষ্ট রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের একটি নগ্ন উদাহরণ। কারণ হত্যাকারীরা রাষ্ট্রীয় মদত লাভ করেছিল এবং বিরোধীদের নির্মূল করাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। এ হামলার মাধ্যমে তৎকালীন সরকার গণতন্ত্রকে অরাজনীতিকীকরণ করতে চেয়েছিল, এমনকি নানা রাজনৈতিক প্রহসনের মাধ্যমে হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে ভিন্ন দিকে প্রবাহের চেষ্টা করেছে।
সংসদে হাসি-তামাশা করে, ভ্যানিটি ব্যাগ তত্ত্ব দিয়ে, হত্যাকাণ্ডের আলামত লোপাটের সুযোগ তৈরি করে, জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে। কিন্তু পরে আদালতে এটি প্রতীয়মান হয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই গ্রেনেড হামলা চালানো হয় এবং তার জন্য বিএনপি সরকারের নীতিনির্ধারকরা দায়ী, এদের কেউ কেউ আদালতে দণ্ডিতও হয়েছে।
বিএনপি সরকারের ওই হামলার দায় অস্বীকার করা সত্যের অপলাপ বৈ কিছু নয়। ওই ঘটনায় দায় স্বীকার করে জনগণ ও জাতির কাছে ক্ষমা না চাওয়াটা বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার অংশ। বরং, তৎকালীন সরকারপ্রধান ও মন্ত্রীরা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ সরকারের সাফল্যকে আড়াল করতে বোমা হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে- প্রচারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার জন্য সব রকমের কসরত চলতে থাকে। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সুষ্ঠু তদন্ত করে এর বিচার নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছিল কিন্তু জোট সরকারের সময় তদন্ত ও বিচারকাজ এগোয়নি।
বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতিতে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে- অন্তত হামলার পরবর্তী রাজনীতির গতিপ্রকৃতি তা-ই বলে। প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ আদর্শিক ও সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়েছে এবং জনসমর্থন আরও জোরালো হয়েছে। আওয়ামী লীগ আরও জনমুখী ও জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের রাজনীতিকে ত্বরান্বিত করেছে। ফলে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
তাছাড়া, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় জনগণের সমর্থনে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করে দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পেরেছে। এতে আরও প্রমাণিত হয়, পালিয়ে যাওয়া নয়, বিপদে জনগণকে সাথে নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই আওয়ামী লীগের শক্তি। যতবার বঙ্গবন্ধু কন্যার ওপর হামলা হয়েছে, হত্যার চেষ্টা হয়েছে, ততবারই আওয়ামী লীগ আরও সুসংহত ও সুসংগঠিত হয়েছে। নেত্রীর জন্য ও দলের প্রয়োজনে কর্মীরা জীবন বিসর্জন দিতে পারে এ আদর্শিক অবস্থান আরও জোরালো হয়েছে।
২১ আগস্ট হামলা রাজনীতিতে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। আর এ সংকটের সূচনা হয়েছে বিএনপির হাত ধরেই। এ হামলা বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট দুটি ধারার সৃষ্টি করেছে। একটি ধারা স্বাধীনতার মূল চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় নিজেদের নিবেদিত করেছে। অন্যপক্ষ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংসের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের অপচেষ্টায় মগ্ন রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বিএনপির রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। দলটি বর্তমানে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। দলটির জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি জনগণ গ্রহণ করছে না, যা রাজপথের আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততার পরিসংখ্যান দেখে অনুধাবন করা যায়। জনগণ জীবনমানের উন্নয়নে প্রদত্ত রাজনৈতিক কর্মসূচিকে গ্রহণ করছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা সাম্প্রদায়িক ঘৃণাকে নয়। বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূজি জনমুখী না হওয়ার বড় একটি কারণ হলো অতীতের ভুল রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে দলটির মধ্যে কোনো আত্মসমালোচনা নেই; ভবিষ্যতে তাদের রাজনীতি চর্চার প্রকৃতি কেমন হবে, দলটি তা কখনোই স্পষ্ট করেনি; এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় দলটির অবস্থান কি হবে তা জনগণের সামনে সুস্পষ্ট নয়। অতএব, একুশে আগস্টের দায় স্বীকার না করে রাজনীতিতে নতুন অবস্থান তৈরি করতে চাওয়ার চেষ্টা-ই বর্তমান বিএনপির রাজনৈতিক দৈন্যের জন্য দায়ী।
তৃতীয়ত, ২১ আগস্ট হামলা রাজনীতিতে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। আর এই সংকটের সূচনা হয়েছে বিএনপির হাত ধরেই। এ হামলা বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট দুটি ধারার সৃষ্টি করেছে। একটি ধারা স্বাধীনতার মূল চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় নিজেদের নিবেদিত করেছে। অন্যপক্ষ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংসের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের অপচেষ্টায় মগ্ন রয়েছে।
পরিশেষে, ২১ আগস্ট হামলার মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করা এবং আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করা। রাজনীতিতে মতপার্থক্য, ভিন্নমত কিংবা বিরোধ স্বাভাবিক হলেও হত্যা কিংবা হত্যার ষড়যন্ত্র নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বড় অন্তরায়।
গ্রেনেড বা বোমা হামলা করে অপর রাজনৈতিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করা গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। এ ধরনের অপরাজনীতিতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার অপমৃত্যু ঘটে। তাই জনগণকে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাজনীতির পুনরাবৃত্তি রোধে সদাজাগ্রত থাকতে হবে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সমুন্নত রেখে সোনার বাংলা বিনির্মাণে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম