কর অব্যাহতি আর খেলাপির দৌরাত্ম্য সরকার কি পারবে?
শিরোনামের শব্দগুলোর অর্থ কী তা আমাদের সমাজে যারা শিল্পমালিক ও ব্যবসা করেন, তারা ভালোভাবেই জানেন। কেননা, তারাই এসব সুযোগ গ্রহণের হোতা এবং ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দিয়ে নানা বাহানায় তা আত্মস্মাৎ করাই তাদের কাজ।
অনেকেই বলবেন, আপনার এ মোটা দাগের মন্তব্য সব শিল্পপতির বেলায় খাটে না, খাটবে না। কথাটি ঠিক। সবাই যদি ঋণ খেলাপি হতেন, তাহলে ব্যাংকগুলোতে লালবাতি জ্বলতো। এই যে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ খেরাপ করার পরও ব্যাংকগুলো এখনো সচল আছে, তার জন্য যারা ঋণ পরিশোধ করছেন, তাদের ধন্যবাদ জানানো উচিত। আর সেব সব মানুষকে আরও সজাগ সচেতন করার জন্য বলা উচিত, আপনারা আর ব্যাংকে টাকা রাখবেন না। কারণ আপনাদের টাকা নিরাপদ নয়। আর যারা ঋণ খেলাপ করে নানা বাহানা ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করে চলেছেন বুক ফুলিয়ে, সরকারকে তাদের ব্যাপারে সিনা টান টান করে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
কারণ, সরকার যদি নিজের লোক, দলীয় লোক, দলীয় শিল্পপতি ইত্যাদি খাত সৃষ্টি করে ঋণখেলাপিদের রেয়াত দিতে থাকেন, তাহলে সেই সরকারই আর্থিক বেকায়দায় পড়বেন। এবং বর্তমান সরকার কি অস্বীকার করে বলতে পারবেন যে তারা এসব রাজনৈতিক ঋণখেলাপিদের কারণেই লাখ লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায়নি? লাখ লাখ কোটি টাকা খেলাপিদের তহফিলে থাকায় এবং ফিরে না আসায় সেই টাকা আবারো পুনরায় ইনভেস্টমেন্ট করতে পারছে না। ফলে শিল্প ও ব্যবসা সেক্টরে একটা মন্থরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যাকে বলা হচ্ছে মন্দাকাল।
এই মন্দাকাল সৃষ্টি কে বা কারা করছেন? সাদা চোখে দেখে আমরা বলি সরকার। হ্যাঁ, সার্বিক দায়িত্ব তো সরকারেরই। সরকারে বিভিন্ন অফিস এসব কাজ করেন। যেমন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তার একটি। শুধু একটি বললে ভুল হবে। এই বোর্ড সরকারের আয়-রোজগারের প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা। এ বছর, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের যে বাজেট করেছেন সরকার, সেই বাজেটে দেখানো হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সব থেকে বেশি অর্থ জোগাবে। সেই হিসাবে এই সংস্থাটি দায়িত্ব অনেক বেশি। তাদের কাজের ওপরই নির্ভর করছে সরকারের মূল আয়। আর সেই টাকাই তো সরকার জাতির মেগা ও অমেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করেন। তো, এ রকম একটি সংস্থার কাজ দেখলেই বোঝা যাবে তারা সরকারকে কতোটা সাহায্য করতে পারবে বা পারছে।
গত দুটি অর্থবছরেও সরকার বেশ আর্থিক সংকটের চাপে ছিলেন। টাকার অভাবের কথা তো প্রতিদিনই উঠে আসছিল সংবাদপত্রগুলোতে। ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট ছিল/আছে/থাকবেই। তারা আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে পারছিলেন না। ব্যবসায়ীদের হাহাকারও শোনা গেছে। এখনো তা অব্যাহত।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কেন তাদের রোজগারের লক্ষ্য পূরণ করতে পারে না, তার কারণ তারা এবং রাজনৈতিক সরকারই মূলত দায়ী। কীভাবে? তাহলে একটি রিপোর্টের খণ্ডাংশ উপস্থাপন করা যাক। সেটুকু পড়লেই বোঝা যাবে।
`গত দুই অর্থবছরে ( ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গুরুত্বপূর্ণ খাতে শুল্ক অব্যাহতি দিয়েছে মাত্র ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রজ্ঞাপন ও আদেশের মাধ্যমে ৫১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে অব্যাহতির পরিমাণ প্রায় আঠারো শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৬১ হাজার ৩২ কোটি টাকা। কোনো কোনো খাতে এই কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তার একটি তালিকাও দেওয়া যাক। খাতের বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে বিশেষ অব্যাহতি, মূলধনী যন্ত্রপাতি, ত্রাণসামগ্রী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কাঁচামাল, মোবাইল উৎপাদন পোলট্রি ফার্ম, অগ্রিম আয়কর অব্যাহতি, ফ্রিজ ও এসি উৎপাদন, চালের শুল্ক অব্যাহতি, টেক্সটাইল এসআরও, অগ্রিম আয়কর ছাড়া শুল্ক অব্যাহতি, বেজা, ভোজ্যতেলের ৫% ভ্যাট অব্যাহতি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানিসহ অন্যান্য।
এসব খাতের শুল্ক অব্যাহতির ওয়াদা ছিল যে তারা জনগণকে ওই কর বা শুল্ক অব্যাহতির সুফল দেবে। তারা এতোটাই দিয়েছে যে, হু হু করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতা জনগণের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। একটা গল্পের কথা মনে পড়ছে। চোর ঢুকেছে ঘরে। গেরস্থ সেটা টের পেয়েছেন। কিন্তু গেরস্থ পুরে পুলিশকে বলে যে দেখি বেটা কি করে।
সব মালামাল নিয়ে যাওয়ার পরও তিনি বলেন, দেখি বেটা কি করে। আমাদের গেরস্থ হচ্ছেন সরকার। সরকারও জানেন ওই শুল্ক অব্যাহতি কোনো কাজ দেবে না। অতীতে বহুবারই এই কর্ম সরকার করেছেন এবং অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রজ্ঞাবানরা সব লুটে নিয়েছেন, জনগণকে দেওয়ার যে ওয়াদা তারা করেছিলেন, তারা অব্যাহতি পাওয়ার পর তাদের কথা ভুলে গেছেন। সেটাই স্বাভাবিক। টাকার কাছে কি আর চাষার মুখ, শ্রমিকের মুখ বা সরকারের মুখ মনে থাকে?
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৪১ কোটি টাকা। এ খাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে অব্যাহতির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতেও অব্যাহতির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল ৮ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। গত অর্থবছর তা বেড়ে হয় ৯ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। পোলট্রি ফার্মেও গত অর্থবছরে শুল্ক অব্যাহতির পরিমাণ বাড়িয়েছে এনবিআর। এ খাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৭০ কোটি টাকা শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৯৭৮ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, ‘সরকার শুল্ক সুবিধা দিলেও প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা এ থেকে বঞ্চিত। মূলত সব সুবিধা নিচ্ছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার তারাই ভোক্তাদের পকেট কাটছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে করপোরেট খামারিদের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায় সেটা ভাবা এখন জরুরি। তাদের উৎপাদন ধরে রাখার জন্য সরকারকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করি।’
স্ট্যাটিউটরি রেগুলেটরি অর্ডার (এসআরও) জারির মাধ্যমে টেক্সটাইলে গত অর্থবছরে শুল্ক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ৯৫৩ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৭২৯ কোটি টাকা। এছাড়া দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে প্রতি অর্থবছরই বিশেষ শুল্ক সুবিধা দেয় সরকার। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেজার অব্যাহতির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৬৬৩ কোটি টাকা। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানিতেও শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ৮২৭ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৫৮ কোটি টাকা অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে ভোজ্যতেলেও শুল্ক অব্যাহতির পরিমাণ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা, আগের অর্থবছরে যা ছিল ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা।
শুল্ক অব্যাহতির মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বা কমিয়ে আনা। যাতে ভোক্তা জনগণ সুফল পায়। সয়াবিনের দাম হু হু করে বাড়ানো বা সর্বশেষ ডিমের দাম বাড়ানো, চালের দাম বেড়ে যাওয়া, ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, আবার সরকার রূপপুর পরমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি বছরই হাজার হাজার কোটি টাকার শুল্ক অব্যাহতি নিয়েছেন। কিন্তু এসব খাত থেকে কোনো ভালো সেবা বা ফল জনগণ পায়নি আবার ভবিষ্যতেও পাবে বলে মনে হয় না।
এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে সুবিধা দিতেই সরকার শুল্ক অব্যাহতি দেয়। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সয়াবিন তেলে এ সুবিধা দিয়েছে সরকার। ফলে জনগণ কম দামে সয়াবিন তেল পেয়েছে। যখন এ সুবিধা তুলে নেওয়া হলো তখন তেলের দাম বেড়ে গেলো।’ (বণিক বার্তা/ ১৩ আগস্ট, ২৩)
শুল্ক অব্যাহতির মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বা কমিয়ে আনা। যাতে ভোক্তা জনগণ সুফল পায়। সয়াবিনের দাম হু হু করে বাড়ানো বা সর্বশেষ ডিমের দাম বাড়ানো, চালের দাম বেড়ে যাওয়া, ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, আবার সরকার রূপপুর পরমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি বছরই হাজার হাজার কোটি টাকার শুল্ক অব্যাহতি নিয়েছেন। কিন্তু এই সব খাত থেকে কোনো ভালো সেবা বা ফল জনগণ পায়নি আবার ভবিষ্যতেও পাবে বলে মনে হয় না। এটা একটি রাজনৈতিক সরকারের অর্থনৈতিক শোষণের চক্র। সরকার যে সব খাতে কর অব্যাহতি দিয়েছেন তারা মূলত রাজনৈতিক সরকারের নিজস্ব লেজুড়। তদবির করে তারা ওই টাকা লুটে নিচ্ছে।
অত্যন্ত জরুরি নয় ইলেকিট্রনিক্স পণ্যের জন্য শুল্ক রেয়াতের। শহরের সুযোগসন্ধানীদের খুশি করতে ওই রেয়াত দেওয়া হলেও, কোনো কাজে আসে না/আসেনি। এরা চিহ্নিত লোক। সরকারের ঘনিষ্ট ও সরকারের পেছনের শক্তি। এরা শুল্ক অব্যাহতি থেকে লাভবান হচ্ছে। এরা ব্যাংকে খেলাপি হয়েও কোনো অসুবিধায় পড়ে না, বরং নতুন ঋণ নেওয়ার নতুন নতুন খাত সৃজন করে। এরা মূলত সরকারের জন্য খারাপ শক্তি। কিন্তু সরকার এটা বুঝেও কিছুই করতে পারে না। সরকার এদের কাছে মূলত ঘেরাও হয়ে আছে।
ধরা যাক, দুই বছরের ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা যদি সরকারের কোষে থাকতো বা যেত, তাহলে কি সরকারকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হয়? একটি মাত্র খাত থেকে যদি ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যেতো, যদি এনবিআরের কর্মকর্তাদের ঘুস খাওয়ার খাতটির মাত্র ৫০ শতাংশও রদ করা যেতো তাহলে সরকারের ৭-৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট ১০ লাখ কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া কঠিন হতো না।
সরকার নিজেই যদি অব্যাহতি নেন, তাহলে লুটেরা বাণিজ্যপতিরা তো সেই সুযোগ নেবেই। এনবিআরকে দুর্নীতিমুক্ত করুন। তবে তার আগে সরকারকেই ছাড়তে হবে রাজনৈতিক লেজুড় ও খেলাপি ঋণীদের লালনপালনের চিরায়তপ্রায় ব্যবস্থা। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এলেই খেলাপির টাকা দ্রুতবেগে ফেরত আসতে শুরু করবে। সেটা কি সরকার পারবেন?
০৮/১৮/২৩
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম