সাইবার নিরাপত্তা আইন
আইন কাদের জন্য এবং একটি মৌলিক প্রশ্ন
আইন কাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে? আইন কি জনগণের জন্য, তাদের অধিকার ও স্বপ্ন-কল্পনা ও বিবেকের মুক্তিকে চিরস্থায়ী করার জন্য, নাকি তাদের জীবনকে নিরাপত্তাময় করে নিরবচ্ছিন্ন সুখি করবার জন্য?
আইন সৃজিত হয়েছিল মূলত জনগণের/নাগরিকের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে। কিন্তু বাংলাদেশের আইন ও আইনি ব্যবস্থা ও তার প্রয়োগ কি সেই কথা বলে?এক কথায় বলা যায় এ-দেশের আইন প্রণীত হয়েছে সরকার ও তার শ্রেণির মানুষদের স্বার্থকে রক্ষার জন্য। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিসিএল) প্রতিস্থাপিত সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিসিএল) আইন হতে যাচ্ছে তার সর্বশেষ উদাহরণ। একজন আইনজ্ঞ রেজাউর রহমান লেলিন প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন-
`সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। নাগরিক সমাজ এটির খসড়া পায়নি। যতটুকু লোকমুখে শুনেছি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ থেকে খসড়াটি করা হচ্ছে। তারা খসড়া করার পর নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনা না করে মন্ত্রিপরিষদে তুলে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। পরে সেটা সংসদে যাবে। অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ এবং দুর্নীতিমুক্ত ও কৈফিয়ত দিতে বাধ্য প্রক্রিয়ায় আইন প্রণয়ন না করা হলে তা বৈধ নয়, হয়তো আইনিভাবে ঠিক আছে। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকেরা তা মেনে নেবেন না।
আরেকটি বিষয় হলো, সাইবার নিরাপত্তা আইনে ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি থাকা উচিত নয়। এই শব্দ যখন ব্যবহার করি, তার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনিরাপদ বোধ করি। এটা হওয়া উচিত ছিল সাইবার সুরক্ষা আইন কিংবা নাগরিকদের জন্য সাইবার সুরক্ষা আইন, যা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারের সুরক্ষা দেবে, নিরাপত্তার নামে পুলিশি স্মরণ চিহ্ন দেবে না। সেটা আসলে হয়নি।
রেজাউর রহমান লেলিনে তোলা প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার প্রয়োজন আছে আইনমন্ত্রীর। কিন্তু তিনি বা সরকার মনে করে তারা সব নাগরিকের অভিভাবক। তাই তারা নাগরিকের প্রশ্নে জবাব দেয়া জরুরি নয়। একটা বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট যে সরকার নাগরিকের কথা মনে রেখে আইন প্রণয়ন করেন না। তারা তাদের নিরাপত্তার কথা, তাদের সুবিধার কথা তাদের অধিকারের কথা মনে রেখে আইন প্রণয়ন করেন। সেই মোতাবেক শব্দ প্রয়োগ করেন। আইনের নামকরণই বলে দেয় যে বিষয়টি সরকারের, জনগণের নয়। জনগণের জন্য নয়, সাইবারের জন্য নিরাপত্তার কথাই বলা হয়েছে।
জনগণকে নিরাপদ না রেখে সাইবারের নিরাপত্তা নিয়ে তারা ভাবিত। এর মানে কি এই নয় যে ওই আইন সাইবারকে সুরক্ষা দেবে? নাকি নিরাপত্তার অর্থ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে বলেই প্রণেতারা আইনের নামের সঙ্গে নিরাপত্তা শব্দটি প্রয়োগ করেছেন।
সাইবারের সুরক্ষা (ভালোভাবে রক্ষা করা) করতে হলে আইন প্রণেতাদের ভাবনার এ্যান্টেনাটিকে জনগণের দিকে ফেরাতে হবে। অর্থাৎ, প্রণেতাকে ভাবতে হবে তিনি সরকারের অংশ নন, তিনি জনগণের প্রতিনিধি। তিনি জনগণের তরফে এই আইন প্রণয়ন করছেন বা সংসদে তা পাস করবেন। আইন পাস হলে জনগণের বিরুদ্ধে সাইবার বিষয়ক আইন যাতে ব্যবহার করতে না পারে সরকার, সেটা বিবেচনা করতে হবে।
জনগণ সবসময় অন্যায় ও অপরাধ করে- এই দৃষ্টিভঙ্গি ব্রিটিশীয়। তারা (ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার) নেটিভদের দুষমন ভাবতেন। কারণ তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলেন। নিজেদের রক্ষার জন্য আইনগুলো প্রণীত হয়েছিল। সেটাই আজও ব্যবহৃত হচ্ছে স্বাধীনসত্তার অধিকারী বাংলাদেশে। এটা আরেক দুর্ভাগ্য যে যাদের (ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসক) নির্মম আইনি ও বেআইনি ও সংবিধান বহির্ভূত আচরণ ও পুলিশি নির্য়াতন/অত্যাচারে, শাসন-শোষণে ত্যক্ত বাঙালি অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল ১৯৭১ সালে, আমাদের বিজয়ী রাজনীতিকরা সেই আইনি টানেলেই ঢুকিয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম দেশকে। আর সেই সুতো ধরেই আজকের সরকার সেই ধারায় প্রণয়ন করছেন সাইবার নিরাপত্তার মতো অমানবিক আইন, যা জনগণের বিরুদ্ধে যাবেই।
জনগণ জামিনযোগ্যতা অর্জন করলো সাইবার আইনে, যদি তা সংসদে পাশ হয়। পাশ হবেই, কেন না, সংসদে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের সরকারের উত্থাপিত বিলের বিরোধিতার কোনো ক্ষমতা সরকারি দলের সাংসদদের নেই। সেখানে তাদের রাজনৈতিক অধিকার কেটে দেয়া হয়েছে।
কেন্দ্র আর প্রান্তের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিদ্যমান দুনিয়া জুড়ে, সাইবার বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তারই ধারাবাহিকতায় আসছে। আমার প্রশ্নটি জনগণের স্বার্থ নিয়ে। সরকার নিজেই যেখানে কেন্দ্র হয়ে বসেছেন, সেখানে প্রান্তের মানুষ তো অপরাধী হবেন- এই চিন্তাই তো তারা নির্মাণ করেছেন। সরকারকে এই দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে হবে। কারণ জনগণ হচ্ছে সংবিধানে এই দেশের ঘোষিত মালিক।
মালিকগণ নিরীহ ও উৎপাদনমুখি, তারা রাজনৈতিক সাতেপাঁচে নেই। শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের বড় অংশ মুক্তির মিছিলে শরিক হয়েছিল। সেই মালিক জনগণকে শত্রু ভাবা বা তারাই অন্যায় অপরাধকারী ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং সরকারকে এটা ভাবতে হবে যে সরকার নিজে প্রতিনিয়তই আইনের অপব্যবহার করে ওয়াদা বা শপথের খেলাপকারী এবং তার প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের ওপর জুলুম চাপিয়ে দেয়। আবার সেই জুলুম শাদা চোখেই যখন দেখা যায় যে তা অন্যায়, কিন্তু সরকারি চোখে তা ন্যায়।
সরকারী চোখ যে অস্বচ্ছ ও অন্যায় করার সব উপাদান উপকরণ রেখে দেয়, যেটা আমরা দেখেছি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু শাব্দিক সজ্জায়, তার অপনোদন সাইবার আইনে হলেও/বা হবেই এটা আশা করা যায় না। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বললেন আমরা অজামিনযোগ্যকে জামিনযোগ্য করে দিয়েছি। অর্থাৎ তিনি দাতা। তিনি বা সরকার দান করেন বলেই আমরা যারা জনগণের অংশ আমরা সেই দানে সমৃদ্ধ হই।
আইনটি কি সরকারের সম্পদ নাকি জনগণের সম্পদ— সেটা সব কিছুর আগে ভাবতে হবে। জনগণের থিংকিং আর সরকারের থিংকিং ভিন্ন হবে কেন? সরকার কি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নাকি তারা সুপার জনগণ? জনগণের চিন্তার পথ বেয়ে সরকারকে চলতে হবে। সংবিধান যখন জনগণের সম্পদ তাহলে সেই সম্পদের সদ্ব্যবহার জরুরি।
সংবিধানের ৩৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ` চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হইল (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনের প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে-
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং
(খ)সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হইল। এই উদ্ধৃতিটুকু কি আইনমন্ত্রী পাঠ করে অনুধাবন করেননি? তিনি
কেবল আইন প্রণেতাই নন, তিনি তো আইনের ব্যবসায়ীও (ছিলেন)।
জনগণের চিন্তা করার ও তাদের বিবেকের স্বাধীনতাও সংবিধান দিয়েছে। আর দিয়েছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও। সংবাদপত্রগুলো যা উপস্থাপন করবে, তা তার অধিকারের অংশ ( নৈতিক ও অশালীন না হলেই হলো)।
এই অধিকার সরকার কর্তৃক লঙ্ঘিত হলে তার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিই দায়ী হবেন এবং তার বিরুদ্ধেই আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা দেখেছি, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রশাসনের যে মহিলা কর্মকর্তা শারীরিক ও মানসিক নির্য়াতন করেছিল এবং বাতিল ঔপনিবেশিক আইনদ্বারা মামলা সাজানো হয়েছিল, যারা সেই অবৈধ আইন ও অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে সরকার ও আইনি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
তিনি যে অপরাধ করেছিলেন, সেই অপরাধের/অন্যায়ের/অপপ্রয়োগের বিচার হয়নি। আমরা লক্ষ্য করেছি, একটি মামলার রায়ে আসামি বেকসুর খালাস পেলেন। কিন্তু সেই মামলা করার অপরাধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালত নীরব থাকেন বা রায়ে তার অপরাধের বিরুদ্ধে কোনো রায় থাকে না।
পুলিশ বাদী মামলাগুলোর পুলিশের বেআইনি কার্য়ক্রমকে রায়ের উল্লেখ করা হলে বা অপরাধের জন্য পুলিশের সাজা হলে,পুলিশ বাহিনীর ভেতরে ভুল বা আক্রোশের বশবর্তী হয়ে কোনো প্রতিবেদন দেবে না। এমন কি রাজনৈতিক সরকারের ইশারায় বা সরাসরি নির্দেশে কোনো অন্যায় মামলাও করবে না। মনে রাখতে হবে পুলিশও একটি মামলার অংশীজন এবং আমামি ঘায়েলে তার বিশেষ তৎপরতা থাকে।
সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধারা-উপধারা নিয়ে আলোচনার সময় মাননীয় সাংসদগণ এই সব বিষয় আলোচনা করলে, আমাদের দেশে যে সব আইন বিদ্যমান তার ভেতরের অসঙ্গতিগুলো বেরিয়ে আসবে। অন্যায়/অপরাধ ইত্যাদি বিষয়গুলো কেবল জনগণদ্বারা সংগঠিত হয়, এমন একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে সরকার ও কর্মকর্তা-কর্মকর্তারও যে তার এক অংশীজন সেটা আইনের মধ্যে থাকতে হবে।
আইনমন্ত্রীকে এই কথা মনে রাখতে হবে যে আইনটি যেন সার্বজনীন হয়। অর্থাৎ কেবল জনগণের দিকে দৃষ্টি দেবার পাশাপাশি ক্ষমতাসীনদের অপরাধের বিষয়টিও যেন তাতে থাকে। তা নাহলে, যে লাউ সেই কদুই থেকে যাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রতিস্থাপিত সাইবার নিরাপত্তা আইন কোনো শুভ কিছু দিতে পারবে না আমাদের।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস