ধর্ম
সর্বত্রই আল্লাহপাকের মহিমা বিরাজমান
জগতের অধিকাংশ মানুষই কমবেশি খোদা বা ইশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। যারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, তারাও এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেন। আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস না করা মানুষদেরকেও দেখা যায় বিপদে পরলে ঠিকই সৃষ্টিকর্তাকে সাহায্যের জন্য ডাকেন।
সুদূর অতীত থেকে মানুষের মনে আল্লাহ্ সম্পর্কীয় চিন্তা এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। খোদার অস্তিত্ব নিয়ে মানুষের মনে বিস্ময় ও সংশয়ের অন্ত নেই। মানুষ ভাবে এ বিশ্ব জগতের স্রষ্টা কে? কেমন তার অবয়ব? খোদার অস্তিত্ব যদি থেকেই থাকে তাহলে কিভাবে প্রমাণ করা যায়।
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দার্শনিক, বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিক ইত্যাদি প্রায় সর্ব স্তরের মানুষ খোদার অস্তিত্বের সপক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন প্রকার যুক্তি প্রমাণ দাঁড় করেছেন। কেউ খোদার অস্তিত্ব প্রমাণে তার নিজ ধর্মীয় ঐশী গ্রন্থের আশ্রয় নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ খোদার অস্তিত্ব মিথ্যা প্রমাণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন যুক্তির আশ্রয় অবলম্বন করেছেন।
প্রকৃত অর্থে খোদা বা ইশ্বরের অস্তিত্ব, স্বরূপ কিরূপ তা নিয়েও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মত বিরোধ রয়েছে ফলে প্রতিটি ধর্মাবলম্বীর কাছেই খোদা সম্পর্কে সঠিক ধর্মীয় ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ধর্ম হচ্ছে খোদা কেন্দ্রিক। ধর্মের সাথে খোদার অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক বর্তমান। খোদাকে বাদ দিলে ধর্মের কোনো অস্তিত্বই থাকে না।
ধর্মের দিক থেকে খোদার অস্তিত্ব স্বীকার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও যুক্তিযুক্ত। কেননা মহান আল্লাহপাকের অস্তিত্ব, আদেশ-নির্দেশ ইত্যাদি প্রচারের জন্যই যুগে যুগে নবী-রাসুলগণের আগমন সাধিত হয়েছে এবং খোদাতে বিশ্বাসীদের আস্তিক ও খোদাতে অবিশ্বাসীদের নাস্তিক রূপে আখ্যা করা হয়েছে।
ধর্মের দিক থেকে খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাসীরা হচ্ছে আস্তিক। আর আস্তিকদের মধ্যে খোদার অস্তিত্বের স্বরূপ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। মূলত আস্তিকদের মধ্যে মতানৈক্যের প্রেক্ষিতে তিন ধরনের মতের আবির্ভাব পরিলক্ষিত হয়। যথা-বহু ইশ্বরবাদ, দ্বিইশ্বরবাদ ও একেশ্বরবাদ।
বহু ইশ্বরবাদ একটি প্রাচীন মতবাদ। এ মতবাদ সাধারণত প্রাচীন গ্রীস, মিশর, প্রাচীন ভারতবর্ষ ইত্যাদি স্থানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাদের মতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির পিছনে বহু অতীন্দ্রিয় অতিমানব দেবতা আছেন যারা এই পৃথিবী পরিচালনা করেন এবং তাদের বিশ্বাস এক একজন দেবতা প্রকৃতির এক একটি বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করতো এবং তাদের দৃঢ় বিশ্বাস এটাও ছিল যে, প্রতিটি বিভাগের নিয়ন্ত্রন্তা সেই বিভাগের খোদা।
দ্বিঈশ্বরবাদীদের মতে, একই ইশ্বর শুভ-অশুভ, কল্যাণ-অকল্যাণ ও মঙ্গলের সৃষ্টির জন্য একজন ইশ্বর। আর অশুভ, অকল্যাণ ও অমঙ্গলের সৃষ্টির জন্য আর একজন ইশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। সুতরাং দ্বিইশ্বরবাদে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী ইশ্বরের বিশ্বাস করা হয়েছে।
একইশ্বরবাদ হচ্ছে ধর্মবিশ্বাস বিকাশের সর্বশেষ বিশ্বাস যার সত্যায়ণ বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) করেছেন। বহুইশ্বরবাদ ও দ্বিইশ্বরবাদের দোষ-ত্রæটিকে মুক্ত করে মানুষের মনে এক অসীম অনন্ত, সর্বশক্তিমান ও পূর্ণ ইশ্বরের ভাব জাগিয়ে দিয়ে মানুষকে তুষ্ট করতে সচেষ্ট হয়। তিনি পূর্ণস্বভাব ও সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। ইশ্বর সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও দয়াময়। তিনি জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা তথা মানুষের সার্বিক তত্তাবধায়ক। তবে তিনি নিজে অসৃষ্ট, অনন্ত ও শাশ্বত।
এ মতই বিধৃত হয়েছে পবিত্র কুরআনে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং সবকিছুর স্রষ্টা ও নিয়ন্তা। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, অনাদি ও অনপেক্ষ। তিনি কাউকে জন্ম দেন না। নিজেও জাত নন এবং তার সদৃশ্য আর কেউ নেই। তার সার্বক্ষণিক সমর্থন ব্যতিরেকে কোনো কিছু টিকে থাকতে পারে না।
বিশ্বের সৃষ্টি, প্রতিপালন, পরিপোষণ ও পরিচালনা প্রভৃতি কোনো ব্যাপারেই আল্লাহর কোনো সমকক্ষ বা শীরক নেই। পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহপাকের অস্তিত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘বল (হে মুহাম্মদ) তিনি, আল্লাহ এক, আল্লাহ সমস্ত অভাবের ঊর্ধ্বে, তিনি জনকও নহেন, জাতও নহেন এবং তার সমতুল্য কেউ নেই’ (সুরা ইখলাস, আয়াত: ১-৪)।
‘তুমি বল, তোমরা কি তাকে অস্বীকার কর যিনি পৃথিবীকে দুটি পর্যায়কালে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তারই শরীক সাব্যস্ত কর। ইনিই হলেন বিশ্বজগতের প্রভুপ্রতিপালক’ (সুরা হামিম আস সাজদা: ৯)।‘আর পূর্ব পশ্চিম সবই আল্লাহর, তুমি যে দিকেই মুখ ফিরাও সে দিকেই আল্লাহর বিকাশ দেখতে পাবে। নি:সন্দেহে আল্লাহ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১১৫)। ‘তিনি হচ্ছেন সেই খোদা, যিনি প্রত্যেক জিনিষকে যথাযথ আকৃতি দিয়েছেন তারপর সেই জিনিষকে তার অভীষ্ট উন্নতি লাভের পথ প্রদর্শন করেছেন’ (সুরা তাহা, আয়াত: ৫০)।
আল্লাহপাক তার অস্তিত্বের জোরালো প্রমাণস্বরূপ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, তোমরা কেমন করে আল্লাহকে অস্বীকার করছ? অথচ তোমরা ছিলে নিষ্প্রাণ। অতঃপর তিনিই তোমাদেরকে প্রাণ দান করেছেন, আবার মৃত্যু দান করবেন। পুনরায় তোমাদেরকে জীবনদান করবেন। অতঃপর তারই প্রতি প্রত্যাবর্তন করবে। (সুরা বাকারা : আয়াত ২৮) আল্লাহ ভালোবেসে মানুষ সৃষ্টি করেছেন আল্লাহপাককে ভালোবাসবেন বলে। তাই মানব হৃদয়ে তার নির্মল নিঃসংশয় অস্তিত্ব এবং অনন্য ও নিত্য একত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠার জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ বিশ্বের প্রতি রহমতস্বরূপ হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণ করেছেন। তাই আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-কে জেনে, চিনে সৃষ্টি ও স্রষ্টার প্রেমে হৃদয়-মন ভরে নিয়ে আমরা সবাই যেন আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভে ক্রমাগত এগিয়ে যাই।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস