মানুষ আসলে মায়ায় আটকায়
জাস্টিন ট্রুডো ও সোফির সেপারেশনের অভিঘাতে এই ফেসবুকে পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজিত হয়ে একটি খণ্ড প্রলয় হবে; সেটা আন্দাজ করে ই-আরকিতে একটি রম্যগল্প লিখেছিলাম।
গল্পটা প্রায় অক্ষরে অক্ষরে মিলে যেতে খুব যে খুশি হয়েছি আমি; তা কিন্তু নয়। শেষ পর্যন্ত আমি আমার শেকড় সংলগ্ন সমাজকেই ভালোবাসি। এই সমাজ প্রেডিক্টেবল আচরণ করুক; তা আমি চাই না।
কে যেন একজন ফেসবুকে লিখেছিল, বিল গেটসের টাকায়, ইলন মাস্কের কারিশমায়, জাস্টিন ট্রুডোর ক্ষমতায়, ফুটবলার হাকিমির জনপ্রিয়তায়, হুমায়ুন ফরিদীর ভালোবাসায়— কোনো কিছুই নারীকে আটকাতে পারে নাই! নারী আসলে কিসে আটকায়?
অমনি লোকজ নারীবাদ গর্জে ওঠে, চ-বর্গীয় গালাগাল শুরু হয় পুরুষদের; সে গালি গড়ে; সব পুরুষকে। কলতলার এই যে জাদুবাস্তব রাগ; এখানে রবীন্দ্রসংগীত শুনে দুলে ওঠা, জোড়া সাঁকোর পরিবারের অষ্টাদশ শতকের নারীর মতো কস্টিউম পরে; আবার এক ঝটকায় এলিজাবেথান পিরিয়ডের শেক্সপিরিয়ান নারীর মতো কস্টিউম পরে, ফেসবুকে লাইকে লাইকে ‘আপনিই পারেন, আপনিই পারবেন আপা’-বলে পনেরো মিনিটের আইকন হয়ে উঠলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার কিশোরীরা ভাবে, ওই আকলিমা নদী আপার মতো হলেই স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়া যাবে!
ফলে সেই কিশোরী টের পায় না; এমেরিকায় সিভিল রাইটস মুভমেন্টের সময় কীরকম দুর্মর লড়াই করেছিল এমেরিকার নারীরা। নারী শ্রমিকের আন্দোলন থেকেই নারী অধিকারের দাবি উচ্চকিত হলে, নারী ভোটাধিকার পায়; পুরুষের সমান শ্রম মজুরি পায়। কিংবা বাংলাদেশের সাহসী নারী বেগম রোকেয়া মোমবাতির কাঁপা আলোয় রাত জেগে অক্ষর জ্ঞান নিয়ে; তারপর জ্ঞান সমুদ্রে সন্তরণ করে; তারপর একদিন কালির দোয়াতে পাখির পালক চুবিয়ে লেখেন, সুলতানার স্বপ্ন।
কিন্তু এই সুলতানার স্বপ্ন হাইজ্যাক হয়ে যায় সরকারি নারীবাদে, সংসদের সংরক্ষিত আসনে। এই যে বেগম পত্রিকার নূরজাহান বেগম, নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের অসংখ্য নারী, মুক্তিযোদ্ধা নারী তিল তিল পরিশ্রমে নারী মুক্তির সনদ লিখলেন জীবনব্যাপী! তা হাইজ্যাক হয়ে গেলো সরকারি ভটভটি আপাদের ক্ষমতার মুজরায়।
যেই লোকটা ২০১৪ সালে সিপি গ্যাংয়ের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হয়ে চ'-বর্গীয় গালি দিয়ে বেড়াতো; আকলিমা নদী আপ্পিদের গালি দিয়েছিল; কী করে কী করে যেন, ক্ষমতার প্রেমের আঠায়; এখন সেই চ বর্গীয় গালি দেন নারীবাদের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সরা। যেমন দেব, তেমনি দেবী; ফেমিনিস্ট পুরুষ হয়ে এখন নারী বনাম পুরুষ বিতর্কে পুরুষকে গালি দিয়ে যায় সিপি গ্যাংয়ের ক্ষমতা নাগর। ফলে চ-বর্গটা এখন সরকারি নারীবাদী ও ফেমিনিস্ট সিপি গ্যাংয়ের সমবেত ক্ষমতা সংগীত।
সিপি গ্যাং কোন প্রতিবাদী পুরুষের কাল্পনিক বেড রুমের কাহিনি বানিয়ে একখানা পোস্ট দিলে সেইখানে সরকারি নারী গিয়ে লাভ সাইন দিয়ে মন্তব্যে কলতলার জুলেখা-চামেলির মতো পুলকে হুটোপুটি খায়; কাল্পনিক কাহিনিকারকে আদর করে নাকে ভালোবাসার সাবান মাখিয়ে দেয়। এই তো কালচার! এই তো দেশপ্রেমের ম্যানেজারির ধরন।
এতো হওয়ারই কথা। ওসব রবীন্দ্রসংগীতের দুটো কলি; দুটি কঠিন ইংরেজি বইয়ের বুক কাভারের ছবি; এইসব এনলাইটেনমেন্টের শো অফে কী মুছে যায়; গালাগালির অন্তর্গত সংস্কৃতির টান। যে বিল গেটস বা ইলন মাস্কের সাফল্য নারীকে আটকাতে পারে না বলে আক্ষেপ করেছে; সে আসলে বুদ্ধ দাশগুপ্তের ‘চরাচর’ চলচ্চিত্রের ওই পাখাল; যে পাখি ধরে বিক্রি করতো; আর বিক্রির টাকা দিয়ে বউয়ের জন্য উপহার কিনে ফিরতো। এতো ভালোবাসা দিয়েও সে বউকে আটকাতে পারেনি। বউটি ঠিকই গ্রামের ব্যাপারীর ছেলের বাইকে চড়ে ললিতলোভনকান্তি মাংসের দোকানে গেছে; স্বর্ণালঙ্কারের মোহের কাছে চলে গেছে। এরপর পাখাল বিরহে লীন হলে তার একাকী জীবনে পাখিরা এসে সঙ্গ দেয়; একদিন সে মৃতপ্রায় হয়ে জলাধারের দিকে হেঁটে গেলে, সে যেন পাখির মতো উড়ে যায়।
বাংলাদেশ সমাজে দরিদ্র নারীর জীবনে অসহায়ত্ব আছে। নারী নির্যাতনের মাঝেও বিবাহ নামের সামাজিক শেকলে তাকে আটকে রাখার বিরাট খাঁচা আছে। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত নারীর জীবনে খুব রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী পরিবারে পড়ে গেলে; নির্যাতনে প্রাণ দেওয়ার ঘটনা আছে। ফুটবলার কিশোরীকে আঘাত করার ধর্ম মোল্লা আছে, গান শেখা কিশোরীর শরীরে হাত দেওয়া সংস্কৃতি মামা আছে। নারীকে ধর্ষণ করা ক্ষমতার ক্যাডার আছে।
কিন্তু ওই যে জীবন থেকে নেওয়ার খান আতা; যে শতবর্ষ ধরে আটকে আছে বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানের খাঁচায়; ফ্যাসিস্ট স্ত্রীর অঙ্গুলিহেলনে যার জীবন; যে সৎ হলে খোঁটা শুনতে হয়, আলম সাহেব সরকারকে তেলাঞ্জলি দিয়ে প্লট পেলো; তুমি একটা অপদার্থ আজও একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো না।
পুরুষের চাহিদা আর কী; ওই একটু দামি ঘড়ি পরে ভোরবেলা ফুলের বাগানে কয়েকটা ছবি তোলা; পলিটিক্যাল মনসুরের মায়ের বাড়ির দাওয়াতে একটু রোস্ট; মাছের মুড়ো। কিন্তু সেই পুরুষের স্ত্রীর বাড়ি-গাড়ি-বিদেশ ঘোরার বায়নাক্কা। বাংলাদেশে দুর্নীতিতে যারা ধরা পড়েছে; তাদের বাসায় একজন ‘সাবরিনা’ আছে যে শাহেদকে নিয়ে ‘বান্টি আউর বাবলি’র ঠগী গ্যাং তৈরি করে। নেহি নেহি আভি নেহি থোড়া কারো ইন্তেজারের লাস্যে ওয়েটিং ফর গডোর বোকা হয়ে রয়ে গেলো পুরুষ।
গত ১৫ বছরে যেরকম হানি ট্র্যাপ ঘটেছে আমাদের চারপাশে; তা ভয়ংকর ছবি আঁকে। আচ্ছা বলেন তো, থাগস অফ বেঙ্গলের জীন থেকে কী শুধু পুরুষ জন্ম নেয়! কন্যা যেহেতু বাপের সবচেয়ে কাছের; ঠগী বাপকে শক্ত করে রুমাল বানিয়ে দিতো ‘নিরীহ মানুষের গলায় ফাঁস দিতে’ সেই সতের ও আঠেরো শতকের ঠগী কন্যারা। সেসময় হানি ট্র্যপের জন্য মর্জিনা ছিল; যারা সুগার ড্যাডি জমিদার হৃদয়ে তুফান তুলে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাকে মাতাল অবস্থায় নৌকা থেকে জলে ফেলে দিতো।
সুতরাং খুব সৎ কোমল মায়াময় নারীর ভাবমূর্তিটি আসলে মজনু টাইপের কবি-গায়কদের সৃষ্টি। কল্পনার রঙ্গে এরা জন্ম দিয়েছে মায়াময় মানবী; অথচ নারী হচ্ছে ম্যাজিক ফ্যান্টাম; আলেয়ার আলো! তাই সামান্য একটু আটকে রাখা নিয়ে কথায় ফোঁস করে চ-বর্গীয় গালি দিয়ে; আমজাদ হোসেন চলচ্চিত্রের সুন্দরীর মতো গলাবাজি করে লাভ নাই; গলা চাইলে আমরাও চড়াতে পারি ছাদের কার্নিশে ও দেওয়ালের খিলানে; বিতর্কের সপ্তমীতে।
যে সমাজে বাচ্চাকে ঘরে আটকে রেখে এক পাহাড় হোমটাস্ক করানো হয়, খেলতে যেতে না দিয়ে আটকে রাখা হয়, পরিবার কবিকে আটকে রাখে কবিতা লেখা থেকে, চিত্রকরকে আটকে রাখে পাড়ার মুরুব্বি, ছাইপাশ এঁকে কপয়সা হয় জীবনে, সন্তানের স্বপ্নকে আটকে দেওয়া হয় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বিসিএস-এ, সৃজনশীলতাকে আটকে দেওয়া হয় বাড়ি গাড়ি ভুঁড়ির সজ্ঞা, সরকারি অফিসে ফাইল আটকে ঘুস নেওয়া হয়, পুলিশ নির্দোষ মানুষকে আটকে রাখে ইউনিফর্মের জোরে।
ডিবি পুলিশ আটকে রাখে তার খাবার হোটেলে, ভোটারকে আটকে রাখে সহমত ভাই, গণতন্ত্রকে আটকে রাখে উগ্র জাতীয়তাবাদের চাবুক, ক্ষমতা আটকে রাখে পরিবারতন্ত্রের মাজার, দেশের মানুষের ভাগ্য আটকে রাখে রাজনীতিক-আমলা-পুলিশ-ব্যবসায়ী-সামরিক বাহিনী; সেইখানে ‘আটকে’ রাখা ও ‘আটকে থাকা’ একেবারে প্রতিটি মানুষের অস্থিমজ্জায়।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে আটকে থাকে বাকস্বাধীনতা; এই অচলায়তনে; অশোভন শব্দের কলতলায়নে, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ধার করে বলি, হারেরেরেরে আমায় ছেড়ে দেরে দেরে!
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক।
এইচআর/এএসএম