ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

প্রসঙ্গ ধর্মীয় জিহাদ

বুয়েটের আটক শিক্ষার্থীদের কথা বলার সুযোগ দিন

শাহানা হুদা রঞ্জনা | প্রকাশিত: ০১:২৫ পিএম, ০২ আগস্ট ২০২৩

 

হলি আর্টিজানের নৃশংস ঘটনার কথা আমরা কখনো ভুলতে পারবো না। এর আগে ও পরে জঙ্গি সংশ্লিষ্ট অনেক ঘটনা ঘটেছে কিন্তু এরকম ভয়াবহ পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড আমরা আগে দেখিনি। তরুণ হামলাকারীরা সবাই ছিল শহরের শিক্ষিত ঘরেরই সন্তান। সেই জঙ্গী তরুণদের অভিভাবকদের দেখেছি সন্তান হারানোর শোকে মুহ্যমান হতে। পাশাপাশি তাদের আরো বড় বেদনার জায়গাটা ছিল, যে, সন্তানকে তারা পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করেছেন, সেই সন্তান জঙ্গি হয়ে মানুষ হত্যার মতো অপরাধ করেছে, এটা ভেবে। হলি আর্টিজানের ঘটনা এতোটাই মর্মান্তিক ছিল যে, নানাভাবে আমরা এ থেকে শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করেছি এবং সরকার নজরদারি বাড়িয়েছে তরুণদের কর্মকাণ্ডের উপর।

ঠিক সেরকম বয়সেরই কিছু তরুণকে পুলিশ আটক করেছে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে গত রবিবার। ২৪ বুয়েট শিক্ষার্থীসহ গ্রেপ্তারকৃত ৩৪ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ করেছে, এরা ধর্মীয় জিহাদ সৃষ্টি, কর্মী সংগ্রহ ও ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরির মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে একত্রিত হয়েছিলেন। ইতোমধ্যে আটককৃত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করে তাদের সুনামগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।

এরমধ্যে যে খবরটি আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে, তা একজন বাবার হাহাকার। দুপুরের প্রচণ্ড রোদ, ভ্যাপসা গরমকে উপেক্ষা করে কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন বাবা, ফজলুল হক শাহিন। টেলিভিশনে খবর দেখে ছেলের চিন্তায় রাত কেটেছে নির্ঘুম। ভোরে রওনা হয়ে দুপুরে এসে পৌঁছেছেন সুনামগঞ্জে। ছেলের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ শুনে উনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘টানাপোড়েনের সংসার। অল্প আয়। কোনো রকম চলছি। ছেলেটা আমার খুবই শান্ত নিরীহ। সে কোনো রাজনীতি করে না। সে নির্দোষ।’

শুধু এই বাবা একা নন, গ্রেফতারকৃতদের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ মেনে নিতে পারছেন না। তারা নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগ 'হাস্যকর' বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন, 'আমাদের সন্তানদের অন্যায়ভাবে আটক করে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দিয়ে তাদের শিক্ষাজীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।' এই মামলাকে ‘মিথ্যা, সাজানো ও দুরভিসন্ধিমূলক’ বলেছেন। অভিভাবকরা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলছেন, তাদের সন্তান-স্বজনেরা কোনোভাবেই রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত নন।

আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, সব বাবা মায়েরাই তাদের সন্তান সম্পর্কে এমন ধারণাই করেন। যেমন এই বুয়েটেই আবরার হত্যার সাথে যারা জড়িত ছিল, তারা সবাই ছিল এদেশের উজ্জ্বল সন্তান। বাবা মায়ের আশার প্রদীপ। অথচ একটি ভয়াবহ অপরাধের সাথে জড়িয়ে এরা পুরো পরিবারকে পথে বসিয়ে দিয়েছে।

হলি আর্টিজানের ঘটনার পরে নিহত একজন জঙ্গির মা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ”আমার সন্তান এত জঘন্য কাজ করতে গিয়ে নিহত হলো, মানুষ খুন করলো, দেশকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল, সেই সন্তানের জন্য আমি কাঁদতে চাই না, চাইনা দুঃখ করতে। কিন্তু পারি না। কারণ আমিতো মা। পেটে ধরে, ওকে আমি বুকে করে বড় করেছি। এখন বুঝতে পারি, ঠিক শিক্ষাটা আমরা দিতে পারিনি ওকে। বুঝতেই পারিনি কেন, কখন, কবে আমাদের সন্তান বিপথে পা বাড়িয়েছে।”

সেই মায়ের কান্না ও দু:খ যেন অন্য মা-বাবাদের জীবনে আর না ঘটে, এজন্য সরকার সেইসময়ই কঠিন হাতে জঙ্গিবাদী তৎপরতা ঠেকানোর চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু হঠাৎ করেই বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অবস্থার দোদুল্যমানতা, দেশের ভেতরে অন্তহীন সমস্যা, সামনে নির্বাচন, রাজনৈতিক দলগুলোর সচল হয়ে ওঠার চেষ্টা এবং জনগণের নানামুখী ক্ষোভকে সামনে রেখে কিছু জঙ্গিবাদী সংগঠন মাথাচাড়া দেয়ার সুযোগ খুঁজছে।

৩৪ ছাত্রকে আটক প্রসঙ্গে পুলিশ স্পষ্টভাবে বলেছে যে তারা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং গোপন বৈঠকে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সংগঠনটির বুয়েট শাখার বায়তুল মাল সম্পাদক আফিফ আনোয়ার, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। ছাত্র শিবিরের সঙ্গে আসামিদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি মামলার এজাহারে উল্লেখ করা না হলেও তাদের কাছ থেকে জব্দকৃত জিনিসের তালিকায় ছাত্র শিবিরের সদস্য হওয়ার সহায়িকা, কল্যাণ তহবিল সংক্রান্ত প্রচারপত্র, ইসলামী মানবাধিকার সংক্রান্ত কাগজপত্রসহ বিভিন্ন নথির উল্লেখ করা হয়েছে।

পুলিশ কী বলছে, কিভাবে মামলা সাজাচ্ছে সেটা নিয়ে অভিভাবক ও আমরা সাধারণ নাগরিকরা জানতে চাইতেই পারি, বিশেষ করে বুয়েটের ছাত্রছাত্রী ও প্রশাসন। আবরার হত্যাকান্ডের পর বুয়েটে সবধরণের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানে আবার কেন একটি ছাত্র সংগঠনের নাম উঠে আসছে? আমরা জানতে চাই গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাচের যেসব শিক্ষার্থীদের নাম উঠে এসেছে, তারা সত্যিই এইধরণের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত কিনা, এর প্রমাণ পুলিশকেই দিতে হবে।

কারণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অত্যন্ত ভয়ংকর। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে এ ব্যাপারে পূর্ণ বিবৃতি দিতে হবে এবং গ্রেফতারকৃতদের নামের সাথে শিবির এর সংযুক্তির পক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ সবার সামনে আনতে হবে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছ থেকেও বক্তব্য আশা করছি। কারণ পুরো বিষয়টার সাথে ৩৪ জন উজ্জ্বল ছাত্র, তাদের ভবিষ্যৎ, পরিবারের আশা স্বপ্ন সব জড়িত। সর্বোপরি দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও জড়িত।

এর আগেও আমরা খবরে দেখেছি দুর্গম পাহাড়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ক্যাম্পে প্রশিক্ষণশিবির স্থাপন করেছে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের ১৯টি জেলা থেকে ‘হিজরতের’ নামে ৫৫ জন তরুণ ঘর ছেড়েছেন তাদের মধ্যে অনেকে কেএনএফের ক্যাম্পে স্থাপন করা প্রশিক্ষণ শিবিরে আছেন বলে র‌্যাব মনে করছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমদিককার সশস্ত্র জঙ্গিবাদ উত্থানের সবচাইতে বড় উদাহরণ দেখেছি ২০০৫ সালে, যখন জেএমবির ৬১টি জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। এরপরে সারা দেশে ছোট-বড় আরও অনেক সশস্ত্র জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে।

বেশ কয়েকবছর বিরতি দিয়ে যেসব তরুণরা নতুন করে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন, এদের মধ্যে অধিকাংশই সাধারণ নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরের সন্তান। এরা বয়সে তরুণ এবং একটা গোষ্ঠী এদেরকে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করেছে। সাহায্য সহযোগিতা করার নামে, আশ্রয় দেয়ার কথা বলে এবং ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েমের কথা বলে কিশোর তরুণদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।

আমরা দেখেছি আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা শুধু দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত কিংবা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষিত নয়। একটা বড় অংশ এসেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল, বিদেশে পড়ুয়া এবং ধনী, শিক্ষিত পরিবারের। জঙ্গিবাদ ও উগ্র সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যে সংস্থাগুলো কাজ করছে তারা বলছে, শুধু কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণেই সন্ত্রাসী তৈরি হয় না এবং জঙ্গিবাদ বিস্তারলাভ করে না। অন্যভাবে বলা যায়, একই রকমের আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে এসেও সবাই সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে না।

মনেকরার কোন কারণ নেই যে ধর্মীয় মৌলবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যই তরুণ-তরুণীরা সন্ত্রাসী কাজে যুক্ত হয়। এর পেছনে নানাধরণের লোভ, মোহ, সামাজিক চাপ ও পিয়ার প্রেশার বা বন্ধুদের চাপ। আমরা দেখেছি তাদের এমন সব বিষয়ে আকৃষ্ট করা হয়, যা থেকে তরুণরা ধারণা করে যে, জঙ্গিবাদী সংগঠনের কাছ থেকে তারা লাভবান হবে। এরা তাদের এমনকিছু দিতে পারে, যা তাকে সমাজের অন্য কোনো সংস্থা, পরিবার বা বন্ধু দিতে পারছে না। এরকম নানা ধারণা মানুষকে সন্ত্রাসের পথে ঠেলে দেয়। এভাবেই সমাজের একটা অংশ জঙ্গিবাদকে গ্রহণযোগ্য বলে মনেকরে এবং একসময় সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে।

সহিংস উগ্রবাদীদের লক্ষ্য কারা, এটা নির্ধারণ করতে পারলেই খুব সহজে বোঝা যাবে আমাদের সমাজের কারা এই ভুল পথে যেতে পারে? নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের মানুষজনকে উগ্রবাদীরা তাদের দলে নেওয়ার চেষ্টা করে যেমন: তরুণ ও যুবক, ধর্মভীরু মানুষ, হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি, সমাজ ও পরিবার বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি, অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল, ধনীর বা প্রভাবশালীদের সন্তান, ঝরেপড়া শিক্ষার্থী, পারিবারিক অশান্তিতে থাকা নারী ও পুরুষ কিংবা তাদের সন্তান, ইন্টারনেটে আসক্ত ব্যক্তি এবং মাদকাসক্ত।

জঙ্গিবাদ নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তারা মনেকরেন জঙ্গীবাদ তৈরির রাজনৈতিক চালকগুলোর মধ্যে আছে রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তির ব্যাপারটা। সরকারের কঠোর নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন যখন উপস্থিত থাকবে, তখনই জঙ্গিবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে তা অনুকূল বিষয় হিসেবে কাজ করবে।

অনেকের মধ্যে একটি ধারণা জোরেশোরে চেপে বসেছে, তা হচ্ছে ইসলাম বিপদের মুখোমুখি, তাই একে রক্ষায় ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ এবং সমাজে অন্যদের ওপরে ইসলামি সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেয়ার কৌশল সৃষ্টি করতে হবে। আজকের বাংলাদেশে এইগুলোর প্রকাশ দেখতে পারছি। একটি সমাজের বা দেশের অনেক মানুষ যখন জঙ্গিবাদী মনোভাব পোষণ করেন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও নারীর পোশাকের ও চলাফেরার অধিকারকে খর্ব করতে চান, অন্য ধর্ম ও মতের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এবং নিজের মত ও পথকেই সেরা ভাবেন, তখন দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হতে খুব একটা কষ্ট করতে হবে না।

সাধারণত ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশোনা করা, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, ধোপদুরস্ত পোশাক পরিহিত, গান-বাজনা করা একজন তরুণ বা তরুণী যখন একেবারে ঝট করে একটা পরিবর্তিত জীবনে প্রবেশ করে, তখন তা একটু অস্বাভাবিক বইকী। পরিবারের মনে প্রশ্ন জাগা উচিৎ কেন সন্তানের এই আচমকা পরিবর্তন? তাহলে হয়তো তারা তাদের সন্তানের উগ্রবাদে জড়ানোর প্রাথমিক লক্ষণ ধরতে পারবেন। বাবা-মা, পরিবার ও শিক্ষকদের মধ্যে সচেতনতা বোধকে জাগ্রত করতে হবে, যেন তারা সন্তানের জীবনের গতি-প্রকৃতি বুঝতে পারেন।

২ আগস্ট, ২০২৩
লেখক: যোগাযোগকর্মী।

এইচআর/এমএস