ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ঢাকা-১৭ আসনের জয় পরাজয়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ১২:৩৭ পিএম, ২২ জুলাই ২০২৩

বহুল আলোচিত একটি উপ-নির্বাচন শেষ হয়েছে। কিন্তু জাতীয় সংসদের ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচন পর্ব শেষ হয়েও যেন হলো না। মাত্র ১১.৫ শতাংশ ভোট পড়লেও শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাত এখন এই আসনের সংসদ সদস্য, যেটা তার জন্য, তার দলের জন্য শতভাগ।

এই সামান্য জয়ের অসামান্য প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি। নির্বাচনের দিন ভোট চলার একেবারে শেষ সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী, অধ্যাপক আরাফাতের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলা এখন এই জয়ের চেয়েও বড় আলোচনা। এ নিয়ে কথা উঠেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ব্রিফিং-এ। হামলার পূর্ণ তদন্ত ও দোষীদের জবাবদিহিতার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশে নিয়োজিত ১১টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাস। টুইট করেছেন জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কিন্তু ক্ষতি যা হবার হয়েছে। এখন সরকারকে ভাবতে হবে ড্যামেজ কন্ট্রোল ম্যকানিজম কী তা নিয়ে। ক্ষোভ প্রকাশে ভাবমূর্তি ফিরবে না। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও বিষয়টি নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছে না।

অধ্যাপক আরাফাত হিরো আলমের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন, পুলিশও তৎপর আছে আক্রমণকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার প্রক্রিয়ায়। কিন্তু বিষয়টি এ পর্যন্ত কেন গেল, কেমন গেল এবং এ জন্য কে কে দায়ী সেটা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। হিরো আলম একজন প্রার্থী। তার এই হেনস্তা আলোচনা হবেই।

এই নির্বাচন এমন এক সময়ে হয়েছে যখন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিদেশিরা তৎপর, আজরা জায়া ও ডোনাল্ড লু’র মত উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন মিশন মাত্র তাদের সফর শেষ করেছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের টিমটি এখনও ঢাকায়। এবং খড়গের মত ঝুলছে মার্কিন ভিসা নীতি। তাই আমি বলব সরকারি দল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন ছিল।

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে এই হামলা একটি ষড়যন্ত্র তাতেও দায় এড়ানো যায় না। বিদ্যমান বাস্তবতায় দ্বিগুণ দায়িত্ব বহন করা দরকার ছিল প্রশাসনের, নির্বাচন কমিশনের এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের। সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবার কোনো অবকাশ কারও ছিল না এবং নেই।

এই নির্বাচনে হিরো আমলের মতো অতি সাধারণ নাগরিকের যে উত্থান হয়েছে তা কোনো দিন কেউ ভাবেনি। আভিজাত্যের কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা সেই বিবেচনায় না গিয়ে বলা যায় হিরো আলম যে শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করেন সেই জনগোষ্ঠীর কাছে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তির অনেক খানি ক্ষতি হয়েছে যা দলের পক্ষে ইতিবাচক নয়।

ভিডিওতে দেখা যায় হিরো আলম ভোটকেন্দ্র থেকে সড়কে বের হয়ে আসার পর অজ্ঞাত লোকজন তাকে মারতে শুরু করে। সংবাদ মাধ্যমের অনেক কর্মী পুলিশকে ডাকছিলেন তাকে বাঁচানোর জন্য। সাধারণ নাগরিকদের অনেকে চেষ্টা করেন তাকে রক্ষা করতে। কিন্তু তারা কেউ পেরে উঠেন নি। একদল লোক তাকে মারতে মারতে ফেলে দেয় এবং ফেলে দিয়েও মারে।

এক দৃষ্টিতে দেখলে হিরো আলম সরকারকে সহযোগিতাই করেছে। বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় এই নির্বাচন নিয়ে কোন আলোচনাই ছিল না। হিরো আলম কিছুটা হলেও সেই আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। জাতীয় পার্টি, যার নেতা এইচ এম এরশাদ এই আসনের এমপি ছিলেন, তার প্রার্থী হিরো আলমের চার ভাগের একভাগেরও কম ভোট পেয়েছেন। আটরশির পীরের এত এত মুরিদ থাকার পরও জাকের পার্টির প্রার্থীর খবরই নেই নির্বাচনে।

হিরো আলমকে ইউটিউবার কিংবা অন্য যেসব বিশেষণেই তাচ্ছিল্য করার চেষ্টা করুক না কেন, তিনি নৌকার মত প্রার্থীর সাথে যে লড়াইটা করেছেন তা অতুলনীয়। এবং তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী তার প্রতি সামাজিক সহানুভূতির জন্ম দিয়েছে। এক দৃষ্টিতে দেখলে নির্বাচনে আরাফাত বিজয়ী হলেও সামগ্রিক বিজয় হয়েছে হিরো আলমেরই।

নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকেই। ক্ষেত্রবিশেষে তা বৈরী হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু নির্বাচন শেষ হলে সেই তিক্ততার রেশ যাতে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে পারে বিজয়ী পক্ষই। কিন্তু সেটা দেখছি না আমরা। হিরো আলমের মত প্রার্থীর সাথে এটা হওয়ার কথা ছিল না, কারণ তিনি আওয়ামী লীগের জন্য বড় হুমকি নন।

 

কেউ আদর্শগত কারণে, বা অবস্থানগত কারণে শাসক দলের বিরোধী হতে পারেন। তারা কোনো বাধার সম্মুখীন না হয়েই সেই রাজনীতি করতে পারবেন, এমন একটি পরিবেশ তৈরি করাই শাসক দলের দায়িত্ব। স্পষ্টতই, এই নির্বাচনে হিরো আমলের মতো অতি সাধারণ নাগরিকের যে উত্থান হয়েছে তা কোনো দিন কেউ ভাবেনি। আভিজাত্যের কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা সেই বিবেচনায় না গিয়ে বলা যায় হিরো আলম যে শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করেন সেই জনগোষ্ঠীর কাছে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তির অনেক খানি ক্ষতি হয়েছে যা দলের পক্ষে ইতিবাচক নয়।

একজন প্রার্থীর শ্রেণির রং বিচার রাজনীতির কাজ নয়। তাই দল যাতে রং বিচারের এমন অন্যায্য পথে না হাঁটে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল এবং এখনও আছে। এই নির্বাচন রক্তক্ষয়ী হয়নি, কিন্তু অনেক মানুষের হৃদয়ে রক্ষক্ষরণ ঘটিয়েছে। একদিকে এত কম ভোট পড়েছে, অন্যদিকে এমন ঘটনা। এমন ঘটনায় সাধারণ মানুষ হতাশ হয়। হয়তো নেতাদের প্রশ্ন করার সাহস করে না তারা।

নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের পর গণতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করেছিল বাংলাদেশ। ভালো নির্বাচনের একটা মডেলও তৈরি করতে পেরেছিল নানা ঘাত প্রতিঘাতে। গণতন্ত্র দাবি করে নিরন্তর সহনশীলতা। সহনশীলতা আর সহিষ্ণুতার ব্যবস্থার যেকোনো খামতি দেশকে অস্থিতিশীল করে, মানুষকে বিপর্যস্ত করে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/জেআইএম