শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে
পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে এই বর্ষা মৌসুমে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা প্রতিদিনই সংবাদপত্রে চোখে পড়বেই। প্রাণ হারানোর দিক থেকে শিশুদের সংখ্যাই বেশি। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের শিশুরা নিউমোনিয়া রোগের পরই পানিতে ডুবে বেশি প্রাণ হারায়। বিশেষ করে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা বেশি এই মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। কি মর্মান্তিক ও বেদনাবিধূর দৃশ্য চোখের ওপরে ভেসে ওঠে।
নোয়াখালীতে বুধবার (৫ জুলাই) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক দিনে পৃথক ঘটনায় পানিতে পড়ে ৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। জেলার কোম্পানীগঞ্জের গাংচিল, কবিরহাটের চাপরাশিরহাট, সূবর্ণচরের থানারহাট ও হাতিয়ার নলচিরা ইউনিয়নে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সোমবার (৩ জুলাই) খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে ঝিরিতে গোসল করতে নেমে পানিতে ডুবে দুই বোনের মৃত্যু হয়েছে। বিকেল ৩টার দিকে ঝিরিতে গোসল করতে গেলে দুই বোনের লাশ ভাসতে দেখতে পান। ওই সময় তাদের বাবা ও মা জুম চাষের কাজে বাড়ির বাহিরে ছিলেন।
এভাবে প্রতিদিনই ঘটছে এই ঘটনা। দুই দিনের মৃত্যুর তথ্য থেকে দেখা যায় ৫ থেকে ১০ বছর বয়সীরা এই ঘটনার শিকার হয়েছে। আর বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নদীতে গোসল করতে গিয়ে, অথবা খেলতে গিয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটছে। আমরা সাধারণত ৫ বছর পর্যন্ত সন্তানদের চোখে চোখে রাখি। তারপর বড় হয়েছে মনে করে তেমনটা খোঁজ রাখি না। ফলে অগোচরে তারা নদীর পাড়ে খেলতে গিয়ে কিংবা নদীতে গোসল করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসছে। সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না এই বয়সী ছেলে-মেয়েদেরকেও নজরে রাখতে হবে।
২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৮৭৫টি ঘটনায় সারাদেশে ১১৬৪ শিশুসহ মোট ১৪০২ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায়। মৃতদের ৮৩ শতাংশই শিশু। গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম ও স্থানীয় পর্যায়ের অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত ঘটনা থেকে পানিতে ডুবে মৃত্যুর এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ২০২২ সালে পানিতে ডুবে মৃতদের ৯৪ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এর মধ্যে চার বছর বা কম বয়সী ৫৫৬ জন, ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৩৬৩ জন, ১০ থেকে ১৪ বছরের ১০২ এবং ১৫ থেকে ১৮ বছরের ৪৩ জন। ৬৬ জনের বয়স ছিল ১৮ বছরের বেশি।
পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর হার কমাতে আগে জানতে হবে কোন কোন কারণে শিশুরা পানিতে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছে; পরে এর প্রতিরোধব্যবস্থার বিষয়ে জানতে হবে। শিশুদের পানিতে ডোবার অন্যতম কারণ হলো মা-বাবা বা পরিবারের সদস্যদের অসচেতনতা। গ্রামে দেখা যায়, বাবারা জীবিকার তাগিদে বেশি সময় বাইরে বাইরে থাকেন এবং মায়েরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গৃহস্থালি কাজের ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাচ্চাকে সঠিকভাবে দেখাশোনা করতে পারেন না। ফলে একটা বাচ্চা তার মায়ের দৃষ্টিগোচরে বাড়ির পাশে পুকুর বা জলাশয়ে কাছে গিয়ে কৌতূহলবশত পানিতে নেমে যায় এবং সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়।
সমাজে অনেক সামাজিক সংগঠন রয়েছে। সামাজিক সংগঠন সমাজের সচেতনতামূলক কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। সামাজিক সংগঠনগুলো যদি এই সময়ে যে সকল বাড়ির আশেপাশে অপ্রয়োজনীয় খাল রয়েছে বা পুকুর রয়েছে সে সকল বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এগিয়ে আসত আমার মনে হয় এর চেয়ে বড় সামাজিকতা আর কিছু হতে পারে না। কারণ এটা জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন। আসুন না আমরা সচেতন হই, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু থেকে দেশকে রক্ষা করি, সচেতনতায় এগিয়ে আসি।
এ ছাড়া পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো সঠিক তত্ত্বাবধান ও শিক্ষার অভাব। একটি শিশুকে সাঁতার শেখানোর সঠিক বয়স পাঁচ বছর। কিন্তু সাঁতার শেখানোর পর্যাপ্ত বয়সেও একটা শিশুকে সাঁতার শেখানো হচ্ছে না, ফলে একটি শিশুর সাঁতার শেখার পর্যাপ্ত বয়স থাকা সত্ত্বেও পানিতে ডুবে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। সাঁতার শেখার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি শিশুকে অবগত করতে হবে। একজন শ্রেণিশিক্ষকও এ ক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা পালন করতে পারেন। তিনি সাঁতার শেখার শারীরিক প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে সাঁতার শিখতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
বাড়ির পাশে অপ্রয়োজনীয় ডোবা বা জলাশয় থাকাটাও শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তাই আমরা একটি শিশুর অকালমৃত্যু ঠেকাতে বেশ কিছু প্রতিরোধব্যবস্থা নিতে পারি। বাড়ির পাশের পুকুর বা জলাশয়ের চারদিকে বেড়া দিতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় পুকুর বা গর্ত-ডোবা থাকলে বন্ধ করে দিতে হবে। এ প্রতিরোধব্যবস্থার মাধ্যমে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
মৃত্যু স্বাভাবিক কারণ যার জন্ম আছে তার মৃত্যু থাকবেই। কিন্তু প্রত্যেকটি পিতা-মাতার সবচেয়ে আদরের ও প্রজন্মের ঠিকানা শিশু মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাই শিশুদের এই অকালমৃত্যুর হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে আমাদের সর্বস্তরের মানুষ সচেতন হতে হবে। পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব একমাত্র শিশুদের প্রতি সচেতন মানসিকতায়।
সমাজে অনেক সামাজিক সংগঠন রয়েছে। সামাজিক সংগঠন সমাজের সচেতনতামূলক কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। সামাজিক সংগঠনগুলো যদি এই সময়ে যে সকল বাড়ির আশেপাশে অপ্রয়োজনীয় খাল রয়েছে বা পুকুর রয়েছে সে সকল বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এগিয়ে আসত আমার মনে হয় এর চেয়ে বড় সামাজিকতা আর কিছু হতে পারে না। কারণ এটা জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন। আসুন না আমরা সচেতন হই, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু থেকে দেশকে রক্ষা করি, সচেতনতায় এগিয়ে আসি।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম