ডেঙ্গু পরিস্থিতি
শিশুদের জন্য প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা
ডেঙ্গুতে আক্রান্তের মধ্যে ৬০ ভাগই ঢাকায় থাকে। শিশুদের অবস্থা একটু বেশিই খারাপ, আক্রান্ত হচ্ছে তারাই বেশি। ৮ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২৪ ঘণ্টায় অর্থাৎ ৭ জুলাই সকাল ৮টা থেকে ৮ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত, ঢাকায় নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ৬০৩ জন, ঢাকার বাইরে নতুন ভর্তি রোগী ২১৭ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা দুজন। এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১২,১১৮ জন। ৫৭ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ঢাকায় রোগী সবচেয়ে বেশি।
যারা শুধু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কখন, কোন হসপিটালে যাবেন- এটা নিয়ে চিন্তিত থাকেন, বাসায় অবস্থান করেন বা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকেন, যার ফলে চিকিৎসা নিতে দেরি হয়, রোগীর অবস্থা খারাপের দিকে চলে যায়। ডেঙ্গুজ্বরে, শিশুদের মধ্যে লক্ষণ পরিলক্ষিত হলেই কখন হসপিটালে নিতে হবে, এ ব্যাপারে জ্ঞান থাকা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
ডেঙ্গু জ্বর (সমার্থক শব্দ ডেঙ্গি) এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনের দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলোর মাঝে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, ফুসকুড়ি, পেশি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, চোখের পেছনের দিকে ব্যথা। তবে জ্বর, মাথাব্যথা এবং শরীরে লাল দানা বা দাগ- ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ। এসব লক্ষণ সাধারণত দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। এক সপ্তাহের মধ্যে বেশির ভাগ রোগীই সুস্থ হয়ে ওঠে।
ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ানো থেকে ছয়দিনের (৩-১৩ ক্ষেত্রে) মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।
সর্বপ্রথম ডেঙ্গু ভাইরাস আবিষ্কার করেছিলেন ১৯৪৩ সালে রেন কিমুরা এবং সুসুমু হোত্তা। প্রথম ডেঙ্গু ভাইরাসকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন তারা। এই দুই বিজ্ঞানী জাপানের নাগাসাকিতে ১৯৪৩ সালে মহামারির সময় নেওয়া রোগীদের রক্তের নমুনা নিয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন। শহরাঞ্চলে ডেঙ্গু জ্বর বেশি দেখা যাচ্ছে তার কারণ হলো অনেক মানুষের সমাগম, বাড়ি নির্মাণ, বিশ্বজুড়ে মানুষ এবং মশার চলমান ভ্রমণের ফলে শহুরে ডেঙ্গু জ্বর ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
গুরুতর ডেঙ্গু মারাত্মক জটিলতা তৈরি করে, যেখানে প্লাজমা লিক হয়, তরল জমা, শ্বাসকষ্ট, মারাত্মক রক্তপাত বা অঙ্গ দুর্বলতার কারণে রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে যেতে পারে। ফলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হতে পারে, অনেক সময় মৃত্যুও হতে পারে। এক্ষেত্রে সতর্কতামূলক লক্ষণ যা ডাক্তারদের দেখা উচিত তা হলো তীব্র পেটে ব্যথা, ক্রমাগত বমি, শ্বাসকষ্ট ও অস্থিরতা।
ডেঙ্গু সাধারণত ভালো হয়ে যায়। অসুস্থতার সবচেয়ে খারাপ লক্ষণগুলো সাধারণত এক থেকে দুই সপ্তাহ স্থায়ী হয় এবং বেশিরভাগ রোগী এর মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে। সাধারণ ডেঙ্গু ১ শতাংশ এরও কম ক্ষেত্রে মারাত্মক হয় ও ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর ২.৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়। যদি ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের চিকিৎসা না করা হয়, মৃত্যুহার ২০ শতাংশ- ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
যদিও ডেঙ্গু মশা কামড়ানোর আশঙ্কা দিনের বেলায় বেশি হয়। দিনের বেলায় মশার বিস্তার বেশি হয়, তাই এ সময় সংক্রমণ ও বেশি ঘটাতে পারে। মানুষ থেকে মানুষে ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ নেই। একবার একটি মশা সংক্রমিত হলে, এটি তার জীবনকালের জন্য সংক্রমিত থাকে।
ডেঙ্গু জ্বরের ফেজগুলো সাধারণত তিন ভাগে থাকে। প্রথম হলো ফেব্রাইল বা জ্বরের ফেজ, যা ২ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়। ডেঙ্গু জ্বর হঠাৎ উচ্চ জ্বর দিয়ে শুরু হয়, প্রায়শই ১০৫° F (৪০.৫° C) পর্যন্ত উচ্চ হয়। ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে শরীরের বেশিরভাগ অংশে একটি সমতল, লাল ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয় হলো ক্রিটিক্যাল ফেস যা ৪৮ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা স্থায়ী থাকে। জ্বর খুব একটা থাকে না, কিন্তু রোগী ক্লান্ত হয়ে পড়ে, রক্ত কণিকার মধ্যে শ্বেত কণিকা ও অনুচক্রিকা কমে যায়, হেমাটোক্রিট (রক্তের হিমোগ্লোবিনের ঘনত্ব) বেড়ে যায়। তৃতীয় বা শেষ হলো কনভালোসেন্ট (Convalescent) বা রোগ থেকে উন্নতি হওয়ার পর্যায়।
সাধারণ ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হলে বলা হয় দুই তিন দিন অপেক্ষা করার জন্য। কিন্তু বর্তমানে জ্বর আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলা হয়। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে চিকিৎসক বাড়িতে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন। সাথে জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল সিরাপ দেওয়া হয় বয়স এবং ওজন অনুযায়ী। প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খাওয়ানোর জন্য বলা হয় শিশুটিকে। এরপর চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষার জন্য উপদেশ দেন এবং তিন দিন পর আসতে বলেন যদি না অন্য কোনো উপসর্গ চলে আসে। মাঝারি বা তীব্র ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত হসপিটালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে রক্ত চাপের পরিমাণ কমে যায়, প্লাজমা লিকেজ হয়, বাচ্চার মধ্যে অস্থিরতা এবং খেতে না পারা লক্ষণগুলো চলে আসে। সাধারণত ইন্ট্রাভেনাস হাইড্রেশন প্রয়োজন হয় ২/১ দিন। এ সময় চিকিৎসকরা রক্তচাপ, ভাইটাল সাইন ও হেমাটোক্রিট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন। যেখানে আইসিইউ এবং হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট থাকবে সেসব হসপিটালগুলোকে বেছে নেওয়া ভালো।
ওষুধ এবং স্যালাইনের মাধ্যমে শিশুটি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যায়। যেহেতু এটি ভাইরাসবাহিত রোগ তাই উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ডেঙ্গুর জন্য কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল নেই। সহায়ক যত্নের পরামর্শ দেওয়া হয়, রোগীদের ভালোভাবে হাইড্রেটেড থাকার পরামর্শ দেওয়া হয় এ সময়। অ্যাসপিরিন (অ্যাসিটিসালিসিলিক অ্যাসিড), অ্যাসপিরিনযুক্ত ওষুধ এবং অন্যান্য ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ (যেমন আইবুপ্রোফেন) তাদের অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। রক্তক্ষরণ বেশি হলে তার জন্য প্রয়োজনে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এন্টিবায়োটিকের খুব বেশি দরকার হয় না, যদি না শিশুটির মধ্যে অন্যান্য সেকেন্ডারি ইনফেকশন থাকে যেমন- নিউমোনিয়া, বুকে ইনফেকশন, প্রসাবে ইনফেকশন ইত্যাদি।
যথাযথ ওষুধের সাথে ও পরিচর্যার মাধ্যমে, সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশুরা ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব সুস্থ হওয়ার পরে আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। সাধারণত অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে ব্যথা থাকে বেশ অনেকদিন। শিশুদের মধ্যে দুর্বলতা থাকে ও খাবারের রুচি থাকে না।
ডেঙ্গু জ্বরে একবার আক্রান্ত হলে আবারও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। ডেঙ্গুর চারটি ভিন্ন সেরোটাইপ (যা ‘প্রকার’ হিসাবে বোঝা যায়) রয়েছে। সুতরাং, যদি প্রথম সেরোটাইপ দ্বারা সংক্রমিত হয়, তবে দ্বিতীয়টি, তৃতীয় এবং চতুর্থ দ্বারা সংক্রমিত হওয়াও সমানভাবে সম্ভব। এটা ঠিক যে, প্রথম সেরোটাইপের বিরুদ্ধে জীবনের জন্য প্রতিরোধী হয়ে যায়।
ডাক্তাররা রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু সংক্রমণ নির্ণয় করতে পারেন, যাতে ভাইরাস বা এন্টিবডি পরীক্ষা করা হয়। যদি আপনার শিশু একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ভ্রমণের পরে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে সেটা ডাক্তারকে জানান। এটি ডাক্তারকে ডেঙ্গু সংক্রমণের কারণে আপনার শিশুর লক্ষণগুলো হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না তা ভেবে দেখবেন। এছাড়া উপসর্গ অনুযায়ী অন্যান্য পরীক্ষা প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো করতে হবে।
শিশুরা যেন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত না হয় তার প্রতিরোধে আসলে আমাদের করণীয় হলো টিকা দেওয়া এবং অন্যটি বাহকের বিস্তার রোধ করা। টিকা বা ভ্যাকসিন বহির্বিশ্বে চলে এসেছে। আমাদের দেশে এখনো সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। এজন্য আমাদের বাহক মশার বিস্তার রোধে প্রথম গুরুত্ব দেওয়া উচিত। দিনের বেলায় সাধারণত মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে দিতে হবে শিশুকে। এ সময় শিশুদের ফুলহাতা জামাকাপড় পরিয়ে রাখাটাই ভালো। বাজারে এখন বিভিন্ন ধরনের মশা কামড় নিরোধক ক্রিম পাওয়া যায়, যা ব্যবহার করতে হবে।
সর্বোপরি স্কুল খুলে গেছে, স্কুলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি, যাতে মশার বংশ বিস্তার না হতে পারে। দ্বিতীয়ত বাড়ির চারপাশে ফুলের টব, টিন, বোতল, নারকেলের খোলস ইত্যাদিতে যেন পানি না জমতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। ফ্রিজ বা এসির পানি যাতে না জমে সেটার ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয় ধাপের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নির্ভর করে সরকারি পর্যায়ে বা সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনার ওপর।
এবছরের শঙ্কার জায়গা হচ্ছে অনেকেই দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের মতো আক্রান্ত হওয়া এবং তাদের অনেকের এমন উপসর্গ দেখা দেয় যেটা ডেঙ্গুর সাধারণ উপসর্গের সাথে মেলে না। যেমন দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া (যেমন ৩-৫ দিনেও কমে না), ওষুধ চলার পরও বমি, পেটে পানি জমে যাওয়া, বুকে পানি জমে যাওয়া, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, মস্তিষ্কের প্রদাহ, খিঁচুনি হওয়া, শরীরে পানি জমে যাওয়া, হাত পা ফুলে যাওয়া।
ডেঙ্গু জ্বরের বর্তমান অবস্থা জটিল আকার ধারণ করেছে, শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, ভালো পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকার কারণে মশার বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়নি। মশার বিস্তার বেড়েছে, রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ আরও ঊর্ধ্বগতিতে বেড়েছে। এজন্য প্রয়োজন দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স ও স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত সবাইকে উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শেষ পর্যায় পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বর শনাক্তকরণের পরীক্ষার যন্ত্রপাতি পৌঁছে দেওয়া ও শিশুদের অভিভাবকদের সচেতনতা। তাহলেই ডেঙ্গু জ্বর মোকাবিলা আমাদের জন্য অনেক সহজ হবে।
লেখক: কনসালটেন্ট: নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট এন্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল। প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ: ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম