ক্রিকেট
তামিম ইস্যুতে শেখ হাসিনার অনন্য উদ্যোগ
৭ জুলাই (২০২৩) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জনগণের কাছে অনন্য প্রজাপালন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন পুনরায়। প্রজাতন্ত্রের একজন খেলোয়াড়কে নিজের বাড়িতে ডেকে যেভাবে ক্রিকেট খেলা নিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করলেন তা একদিকে যেমন তার উদার ও মহান মানসিকতার পরিচয় তেমনি অন্যদিকে শত ব্যস্ততার মধ্যে মানুষের জন্য, দেশের জন্য তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং যে কোনো সংকট নিরসনে ঐকান্তিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অভিনব। ‘পুনরায়’ বলার কারণ হচ্ছে শেখ হাসিনাকে শাসক হিসেবে বিশ্ববাসী গত সাড়ে ১৪ বছর একটানা দেখছে এবং তিনি যে জনগণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমস্যা অতি সহজেই সমাধান করতে সক্ষম হন তাও জানেন।
আমরা তাকে দেখেছি রাতদিন কাজে ডুবে আছেন কিংবা মিটিং ও সিদ্ধান্ত প্রকাশ করছেন, তারপরও হাসি-ঠাট্টায় মজা করে কথা বলছেন যেন তিনি এক ক্লান্তিহীন যোদ্ধা। কাজের মধ্যেই তার দৃষ্টি পুরো বাংলাদেশে প্রসারিত। তিনি কোনো এক স্কুলছাত্রের পত্রের জবাব দেন, কিংবা কোনো অসহায় ব্যক্তি অথবা চা-বাগানের শ্রমিকরা ভালোবাসা জানাতে এলে তাদের উপহার গ্রহণ করে দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেন। তিনি অসুস্থ লেখক-শিল্পী তথা গুণী ব্যক্তিদের স্নেহ-মমতা দিয়ে বেঁচে থাকার শক্তি জোগান। তিনি রাষ্ট্রনায়ক কিন্তু তার চেয়ে বেশি তিনি জননেত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ, নাটকীয় অবসরের ২৯ ঘণ্টা পর তামিমের নাটকীয় প্রত্যাবর্তন সাকিবসহ সব ক্রিকেটারকে উদ্বেলিত করেছে। ৬ জুলাই অনেক ক্রিকেটার তামিমের অবসরের সিদ্ধান্তে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। সাকিবসহ সতীর্থদের আবেগ শেখ হাসিনার কারণে ইতিবাচক পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেছে।
অথচ তামিম ইকবালকে নিয়ে ৬ তারিখে ফেসবুকে জনৈক সাংবাদিক লিখেছেন- ‘ক্রিকেট দলের পতন হয় ক্রিকেটারদের কারণে নয়, টিম ম্যানেজমেন্ট তথা কর্তৃপক্ষের কারণে। আমরা কেনিয়াকে দেখেছি, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দেখেছি, জিম্বাবুয়েকে দেখেছি। জিম্বাবুয়ে দলের অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্রান্ড ফ্লাওয়ার, অ্যালেস্টার ক্যামবেল, হিথ স্ট্রিকের মতো ভুবন বিখ্যাত খেলোয়াড়দের নিরুৎসাহিত করে, রিটায়ার করতে বাধ্য করে দলে ঢোকানোর চেষ্টা করা হয় কালো খেলোয়াড়। সঙ্গে সঙ্গে দলটি মাটিতে পড়ে যায়।
আজ তামিম ইকবাল বাংলাদেশ দল থেকে রিটায়ার করল। সারাদেশের মানুষের বুঝতে মোটেই অসুবিধা নেই যে টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বনিবনা না হওয়াই এর কারণ। তামিম ইকবাল নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ব্যাট্সম্যান। সেই একমাত্র ক্রিকেটার যে বিশ্বের সব বাঘা বাঘা বলারকে পিটিয়ে নাস্তানাবুদ করেছে। আমি বাল্যকাল থেকে ক্রিকেট খেলা দেখি।
ক্রিকেটের নেশার কারণে জীবনের অনেক মূল্যবান সময় ব্যয় করেছি। তামিম যতক্ষণ ব্যাট হাতে থাকে ততক্ষণ বিশ্বের কোনো শক্তিশালী দলও জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস আনতে পারে না। অথচ তাকে কেঁদে কেঁদে ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে হলো। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিঃসন্দেহে দুর্বল হয়ে গেলো। যাদের কারণে তামিম ক্রিকেট ছাড়লেন তারা কারা জানি না। কিন্তু এটা উপলব্ধি করি, হয় তারা কোনোদিন ক্রিকেট খেলেনি অথবা খেললেও বাংলাদেশ দলের বিরক্তিকর ব্যাট্সম্যান ছিলেন। খোদ হাটুরাসিংহেই কী তামিমের চেয়ে বড় খেলোয়াড় ছিলেন? মোটেই না।
আমি জানি না তামিমের রাজনৈতিক পরিচয় কী। কিন্তু কোনো দেশের ক্রিকেটেই সেটা ধর্তব্য হতে পারে না। ক্রিকেট এমন এক খেলা যেখানে হাত ও মেধাই সব। মুশফিকের মতো গোড়া খেলোয়াড়কেও তো সারাদেশের মানুষ প্রাণ দিয়ে সমর্থন করে, আমি নিজেও। বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের উচিত তামিমকে যে করেই হোক দলের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে ফিরিয়ে আনা। তা না হলে বোর্ডের বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যতের নেতিবাচক ফলাফলের জন্য দায় নিতে হবে।’
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত এই সাংবাদিক উত্তর পেয়ে গেছেন পরের তিনই। ৬ জুলাই (২০২৩) তামিম ইকবাল জানিয়েছিলেন আর খেলবেন না। একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের এই অধিনায়ক ঘোষণা দেওয়ার পর পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে নাটকীয় অবসরের ২৯ ঘণ্টা পর ৭ জুলাই নাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটে তামিমের।সংবাদপত্রের সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ডাকে তার বাসভবনে গিয়েছিলেন তামিম। সেখানে তিন ঘণ্টা আলোচনা হয়। তারপর বেরিয়ে এসে তামিম জানান যে, তিনি অবসর ভেঙে বেরিয়ে এলেন। তামিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দুপুরে তাঁর বাড়িতে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ওনার সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ আলোচনা হয়েছে। উনি আমাকে খেলায় ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি অবসর তুলে নিচ্ছি। সবাইকে না বললেও দেশের প্রধানমন্ত্রীকে না বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন তামিম। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে একদিনের সিরিজ খেলছে বাংলাদেশ। তার মাঝে অধিনায়ক যে হঠাৎ অবসরের সিদ্ধান্ত নেবেন তা ভাবতে পারেননি সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকরা। হঠাৎই ১৬ বছরের কেরিয়ার থেকে অবসরের কথা জানান তামিম। ৬ জুলাই তিনি বলেছিলেন, ‘এটাই আমার শেষ। আমি নিজের সেরাটা দিয়েছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছি। আমার ১৬ বছরের যাত্রাপথে পাশে থাকার জন্য সতীর্থ, কোচ, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও আমার পরিবারকে অনেক ধন্যবাদ।’
তামিম আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের সমর্থকদেরও একটা বড় ধন্যবাদ প্রাপ্য। আশা করছি আগামী দিনেও আপনারা আমাকে ভালোবাসবেন।’ অবসরের ঘোষণা করতে গিয়ে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি তামিম। কেঁদে ফেলেছিলেন। অবসরের কথা জানালেও কেন হঠাৎ অবসর নিলেন, তার কোনো কারণ জানাননি তামিম। এভাবে সিরিজ়ের মাঝপথে অবসর নেওয়ার বিষয়েও মুখ খোলেননি তিনি। তামিম অবসর নেওয়ায় আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে একদিনের সিরিজ়ে লিটন দাসকে অধিনায়ক করা হয়েছিল।
কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টে যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মধ্যহ্নভোজের পর অবসর ভেঙে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন তামিম। বলেছেন, ‘দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে আমরা যাই গণভবনে। কক্ষে পা দেওয়া মাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বললেন, ‘কি তামিম, কী সব পাগলামো নাকি করছো! এসব করলে তো চলবে না। … দেখো, শুধু আমার কথা নয়, মানুষের কথা ভাবো। কত মানুষ তোমাকে ভালোবাসে। সেটির মূল্য দিতে হবে না? সবকিছু মাথা থেকে সরিয়ে ফেলো…। তিনি সবসময় এত আন্তরিক ও অধিকার নিয়ে কথা বলেন, কোনো জবাব থাকে না। আমি শুধু হাসলাম।…উনার আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এভাবে বলেন, এরপর তো আর কিছু বলার থাকে না।’
তামিমের এই কথা শোনার পর স্যোশাল মিডিয়া এবং টিভি টকশোতে শেখ হাসিনার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে। একজন মন্ত্রী মহোদয় লিখেছেন- “তিনি শেখ হাসিনা। যেকোনো সমস্যা যখনই তার দৃষ্টিতে আসে, তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানের ব্যবস্থা করেন তিনি। মায়ের মমতা দিয়ে দেশ ও জাতিকে আগলে রেখেছেন সকল সংশয় সকল সংকটে। কোথায় নেই তার স্পর্শ। সবকিছুতেই তিনি সংবেদনশীলতা নিয়ে সমাধান করে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন প্রতিনিয়তই। সে কারণেই তাকে অভিহিত করা হয় ‘বেস্ট ক্রাইসিস ম্যানেজার’ হিসাবে।”
দেশের সীমা অতিক্রম করে বিদেশেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। কলকাতার আনন্দবাজার ৭ তারিখ লিখেছে- ‘একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তামিম। অন্যদিকে টি-টোয়েন্টি এবং টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়ক সাকিব। বাংলাদেশের অন্যতম সিনিয়র দুই ক্রিকেটারের সম্পর্ক নিয়ে নানা জল্পনা রয়েছে। তাদের ব্যক্তিত্বের সংঘাত বার বার শিরোনামে এসেছে। যদিও তামিম বা সাকিব কখনও প্রকাশ্যে সমস্যার কথা মানেননি। মাঠের পারফরম্যান্সেও প্রভাব ফেলতে দেননি। গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ব্যাটার তামিম।
সাকিব অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। অনূর্ধ্ব ১৫ পর্যায় থেকে দু’জনে একসঙ্গে ক্রিকেট খেলছেন। বয়সভিত্তিক জাতীয় দল থেকে সিনিয়র জাতীয় দল— একসঙ্গে বাংলাদেশকে বহু ম্যাচ জিতিয়েছেন তামিম এবং সাকিব। তামিমের অবসর নিয়ে ৬ জুলাই মুখ খোলেননি সাকিব। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর নিজের আবেগ আর গোপন করতে পারেননি। তাদের দু’জনের সম্পর্কে ঘিরে যে জল্পনাই চলুক, সাকিব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সে সবের অনেকটাই রটনা, যা তাদের ২০ বছরের বন্ধুত্বে ছাপ ফেলতে পারেনি।’
৬ জুলাই বন্ধুকে নিয়ে সাকিব ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘২০০৩ সালে অনূর্ধ্ব-১৫ জাতীয় দলের হয়ে আমাদের একসঙ্গে পথচলা শুরু। গত ২০ বছর ধরে আমরা নিজেদের স্বপ্ন এবং লক্ষ্যগুলো ভাগ করে নিয়েছি। একটা দৃঢ় বন্ধন এবং বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছি। আমরা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। তোমার (তামিমকে উদ্দেশ্য করে) আবেগ এবং আগ্রাসন আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে।’
সাকিব জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশকে জেতানোর জন্য তারা পরস্পরের দক্ষতার প্রতি বিশ্বাস রাখেন। একে অন্যের ওপর নির্ভর করেন। তামিমের রান এবং রেকর্ডগুলোই তার দক্ষতার পরিচয় বলেও লেখেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার। সাকিব লিখেছিলেন, ‘একজন খেলোয়াড় হিসেবে তুমি যা কিছু অর্জন করেছ, তার জন্য আমরা সতীর্থেরা গর্বিত। তোমার সঙ্গে আর মাঠে থাকতে পারব না। এটা একটা অদ্ভুত অনুভূতি। আমরা এরপর যখন মাঠে নামব, তোমার আগুন আমাদের সকলের ভিতরে জ্বলবে।’ দীর্ঘদিনের সতীর্থকে তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেননি সাকিব। লিখেছিলেন, ‘তোমার নতুন জীবনেও তুমি ছক্কা হাঁকাও। প্রিয় জনদের সঙ্গে নতুন মুহূর্তগুলো উপভোগ কর।’
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ, নাটকীয় অবসরের ২৯ ঘণ্টা পর তামিমের নাটকীয় প্রত্যাবর্তন সাকিবসহ সব ক্রিকেটারকে উদ্বেলিত করেছে। ৬ জুলাই অনেক ক্রিকেটার তামিমের অবসরের সিদ্ধান্তে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। সাকিবসহ সতীর্থদের আবেগ শেখ হাসিনার কারণে ইতিবাচক পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেছে।
এজন্য দেশের পুরো ক্রিকেট জগৎ প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রী শিখালেন যে- দেশ চালাতে হলে সবদিকে মনোযোগ দিতে হয়, সমস্যা হলে সরাসরি কথা বলে সমাধান সম্ভব হয়, আর খেলাধুলাও যে গুরুত্ব বহন করে তাও জীবন পরিচালনায় রাখতে হয়। কেবল বিরোধিতার জন্য অপপ্রচার যারা করছেন তাদেরও শিক্ষণীয় আছে এই ঘটনা থেকে। শেখ হাসিনা নিজের জন্য কিন্তু দেশের জন্য, মানুষের জন্য সবসময় নিবেদিত। তিনি বিশ্বনেত্রী। তিনি জানেন কোন সংকটের কোনো সমাধান কত সহজে নিরসন সম্ভব। এজন্য তিনি আজ গৌরবান্বিত রাষ্ট্রনায়ক।
লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]
এইচআর/ফারুক/এমএস