ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নির্বাচন দেশে তৎপরতা বিদেশে

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ১০ জুলাই ২০২৩

ডিসেম্বরে বা সর্বোচ্চ আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোট গ্রহণের ৬ মাস বাকি থাকলেও নির্বাচনের আসলে বাকি চার মাসেরও কম সময়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে সমঝোতার সম্ভাবনা ফুরিয়ে যাবে। তাই তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে হবে। অংশগ্রহণমূলক করা গেলে তারপরের দায়িত্ব অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা।

তবে বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে দেশের চেয়ে বিদেশে তৎপরতা যেন বেশি। বাংলাদেশে দুই দলই অনড় অবস্থানে। সরকারি দল সংবিধান অনুযায়ী বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলের একমাত্র দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। দুই দলের দাবির মধ্যে ব্যবধান এত বেশি, মেলানোর সুযোগ খুব কম। সুযোগ যত কমই হোক, মেলাতে হলে আলোচনায় বসতে হবে।

আলোচনার ব্যাপারে কারোই আগ্রহ নেই। বিএনপি বলছে, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ছাড়া কোনো আলোচনা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার পদত্যাগ করলে আলোচনাটা কার সাথে হবে? সরকারি দল আলোচনার ব্যাপারে কোনো আগ্রহই দেখাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা আমির হোসেন আমু প্রয়োজনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আলোচনার কথা বললেও, একদিনের মধ্যেই পিছিয়ে এসেছেন।

কেউ যদি আলোচনায় বসতে না চান, তাহলে সমাধান হবে কীভাবে? আরও একটি নির্বাচন বর্জন বা বয়কট বা প্রতিহত করার সামর্থ্য বিএনপির আছে কি না, সেই প্রশ্ন যেমন আছে আবার বিএনপিকে আস্থায় না নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে আরও একটি নির্বাচন করা সম্ভব কি না, আলোচনা আছে তা নিয়েও। দুই দলের এ অনড় অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সবাই অপেক্ষা করছে অন্য কিছুর জন্য। বিএনপি নামকাওয়াস্তে আন্দোলন করলেও এই আন্দোলনে যে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দাবি আদায় করা যাবে না, সেটা তারা ভালো করেই জানে। বিএনপি যেন অপেক্ষা করছে, কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর নিস্পৃহতার সুযোগে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে বাইরের দেশগুলোর আগ্রহ বেশি মনে হচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে এমনিতেই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। গত এক দশকের অর্থনৈতিক সাফল্যও বাংলাদেশের প্রতি অনেকের আগ্রহ বাড়িয়েছে। ফলে বাংলাদেশকে ঘিরে এখন আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নানা মেরুকরণ চলছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া, ভারত, ইরান, জাপান, জার্মানি- সবারই আগ্রহের কেন্দ্রে যেন বাংলাদেশ। সবার চাওয়া আগামী নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়। এই চাওয়ার সাথে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাও সমান্তরাল। এমনকি সরকারও অন্তত মুখে বলছে, তারাও অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, চায় সব দল তাতে অংশগ্রহণ করুক। সবার চাওয়া অভিন্ন, এখন কাজ হলো সেই চাওয়ার বাস্তবায়ন। সমস্যা হলো, বিএনপি মনে করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলের সবার মুখে নিরপেক্ষ নির্বাচন থাকলেও, কারও মুখেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে নেই। বাংলাদেশের মতো অন্য কোনো দেশে রাজনীতিবিদদের মধ্যে এত অবিশ্বাস, সন্দেহ নেই।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব নয়, তবে সেটা নিশ্চিত করতে সবার কঠোর মনিটরিং দরকার। এই লেখা যখন লিখছি, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করছে। দুই সপ্তাহ বাংলাদেশে থেকে তারা বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ, নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা পর্যালোচনা করবেন। প্রতিনিধিদল আগামী নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পরিবেশ আছে কি না- তাও খতিয়ে দেখবে। প্রতিনিধিদলটি সরকারের প্রতিনিধি, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

মঙ্গলবার চারদিনের সফরে ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের সিভিলিয়ান সিকিউরিটি, ডেমোক্রেসি ও হিউম্যান রাইটসবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। তার সফরের মূল ফোকাসও নির্বাচন। গত কয়েক মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেছেন। শুধু সফরেই থেমে নেই যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা। বাংলাদেশের অবাধ নির্বাচনে যারা বাধা দেবে তাদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। নতুন ভিসা নীতির পর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে বিতর্ক ছাড়াই। চীন এবং রাশিয়া অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে।

নিজেদের ঘরের ঝগড়া নিজেরা মিটিয়ে ফেলতে পারলেই সবচেয়ে ভালো। বাইরের কাউকে যখন আপনি ডেকে আনবেন, তিনি আপনার ভালো চাইবেন না। ডেকে আনার আগে নিশ্চিত হতে হবে যাকে আমরা ডেকে আনছি, তারা আমাদের বন্ধু কি না। আন্তর্জাতিক মহল আমাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে, এটা আনন্দের খবর। এটাকে সবাই স্বাগত জানাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো হস্তক্ষেপ আমরা চাই না।

এমনিতে বিদেশি কূটনীতিকরা বাংলাদেশে রীতিমতো সেলিব্রেটি। বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ব্রিটিশ হাইকমিশনার বা ভারতীয় হাইকমিশনারের নাম সবাই জানে। তারা যাই বলেন, গণমাধ্যম তা অতি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। নিজেদের এ ভিআইপি মর্যাদাটা তারাও জানেন। তাই কারণে-অকারণে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। এমনকি কূটনৈতিক সীমা লঙ্ঘন করেও তারা সবকিছুতে নাক গলান। আমরা নিজেদের সুবিধামতো স্বাগত জানাই বা প্রতিবাদ করি। তবে কূটনৈতিক সীমাটা সবার জানা থাকলে ভালো।

তবে অতীত ইতিহাস বলে, বিদেশিরা একাধিকবার মধ্যস্ততার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেন। ২০০১ সালে এসেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। ২০১৩ সালে এসেছিলেন জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করেছেন, সমঝোতার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম আলোচিত অধ্যায়ের একটি ১/১১ এর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অস্বাভাবিক এই সরকারের আসল কুশিলব ছিলেন বিদেশি কূটনীতিকরা।

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন দেশের তৎপরতা নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। বরং বাংলাদেশ যে সবার আগ্রহের কেন্দ্রে, সবাই বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবছে; এটা আনন্দেরই খবর। এটা আমাদের অর্জনও। বিদেশিরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে। কিন্তু আমাদের নির্বাচনটা যেন আমরাই করি। কীভাবে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করা সম্ভব; বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকেই বসে তা ঠিক করতে হবে। আর সেজন্য আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। নিজের ইগো, দূরত্ব সরিয়ে রেখে দেশের স্বার্থে রাজনীতিবিদরা সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে পারেন। মনে রাখতে হবে সবার আগে দেশ। আমাদের নিজেদের দুর্বলতায় কেউ যেন বাংলাদেশ নিয়ে খেলার সুযোগ না পায়। ক্ষমতায় যাওয়ার স্বার্থে বিদেশিদের ডেকে এনে আমরা যেন দেশের স্বার্থ বিকিয়ে না দেই।

৯ জুলাই, ২০২৩

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ ফারুক/এমএস