ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ
ইতিহাসের সেই কালো দিন
সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে বহু প্রথা-আইন চালু হয়েছে পৃথিবীতে। সময়ের আবর্তনে আবার কখনও সেটা পরিবর্তন,পরিবর্ধন বা পরিমার্জন হয়েছে। কিন্তু আইন করে কোনো পরিকল্পিত অপরাধের বিচারের পথ রুদ্ধ করার ঘৃণিত কাজটি করা একমাত্র দেশ বাংলাদেশ। আর সেই আইনটি হল ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বা দায়মুক্তির অধ্যাদেশ।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বা দায়মুক্তি আইন – ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোন আদালতে মামলা,অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। অধ্যাদেশের দ্বিতীয় অংশে বলা আছে,রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবে, তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো,অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোন আদালতে মামলা,অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবেনা।
সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি,অসুস্থতা বা অন্য কোন কারনে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে তদস্থলে উপ-রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতিরূপে কাজ করবেন। একইভাবে রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হলে স্পিকার রাষ্ট্রপতিরূপে কাজ করবেন। সংবিধানের এই বিধান বলবৎ থাকার পরেও উপ-রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারকে বাদ দিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরে সংবিধান লঙ্ঘন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ২০ আগস্ট মার্শাল ল জারি করা হলেও সেসময় সংবিধান ছিল বলবৎ যা দ্বিমুখী নীতির শামিল। এরপর ২৫ আগস্ট ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ জিয়াউর রহমানকে চীফ অব আর্মি নিযুক্ত করা হয়।
জাতির পিতার খুনিদের দায়মুক্তি দিতে তৎকালীন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। যা ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ ৫০ নামে অভিহিত হয়। ‘দ্য বাংলাদেশ গেজেট,পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষরের পর তৎকালীন আইন ,বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে।
১৯৭৫ সালের তিন নভেম্বর কারগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর সাত নভেম্বর জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল জিয়া রাষ্ট্রপতি সায়েমের নিকট থেকে প্রধান সমরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে নেয় । ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল জিয়াউর রহমান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। বিচারপতি সায়েম তার ‘At Bangabhaban, Last phase’ গ্রন্থে বিস্তরিত তুলে ধরেছেন।
সাংবিধান ও সেনা আইন লঙ্ঘন করে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে হ্যাঁ-না গণভোটের আয়োজন করেন জিয়া। এরপর ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া সামরিক আইনের অধীনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। এসময় জিয়া মানবতাবিরোধী অপরাধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ,ষোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেয়া হয়। আইনটির নাম ছিলো সংবিধান (সংশোধনী) আইন,১৯৭৯। এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত হয়েছিল।
পঞ্চম সংশোধনীকে বৈধতা না দিলে জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত কিন্তু জিয়াউর রহমান তা না করে আইনটি সংসদে পাস করেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে অনুমোদন দিয়ে জিয়া প্রমাণ করেছেন তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের রক্ষক এবং ষড়যন্ত্রকারীদের ক্রীড়ানক। মোশতাক ও জিয়া সরকার খুনিদের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিচার না করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে ভিন্ন ভিন্ন কূটনৈতিক পদে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন।
তাদের মধ্যে-লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিমকে চীনে প্রথম সচিব, লে.কর্ণেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব, মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, কর্ণেল কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, লে.খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব, লে. নাজমুল হোসেন তৃতীয় সচিব, লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব পদে পদায়ন করেন।
জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ ও জিয়ার সহধর্মিণী খালেদ জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেননি, বরং তারা দায়মুক্তি আইনের দোহায় দিয়ে খুনিদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
এরশাদ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচাতে করা ইনডেমনিটি আইন বাতিল না করে বরং নিজের ক্ষমতায় থাকার সুবিধার্থে দ্বিতীয়বার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন,যা ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং সপ্তম সংশোধনীতে অর্ন্তভুক্ত হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত এরশাদ সরকারের জারিকৃত সকল প্রকার সামরিক আইন,অধ্যাদেশ,বিধি নির্দেশ ইত্যাদি বৈধতাদানের উদ্দেশ্যে এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয় ।
খুনিচক্র জিয়াউর রহমানের সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেয়েছিলো। একইভাবে ১৯৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত বিএনপি সরকারও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। এমনকি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর খুনী লে. কর্ণেল খন্দকার আব্দুর রশিদকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার স্থান করে দেয়া হয়। অপর আর এক খুনি কর্নেল ফারুককে ফ্রিডম পার্টির সাথে রাজনীতির মঞ্চে মঞ্চস্থ করা হয়।
দীর্ঘ ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট -১৯৯৬ ’ নামে একটি বিল উত্থাপিত হয় জাতীয় সংসদে। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদের অধিবেশনে খন্দকার মোশতাক কর্তৃক ১৯৭৫ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ও জিয়া কর্তৃক ১৯৭৯ সালে ৯ এপ্রিল সংসদে বৈধতা দেওয়া কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে আইন পাস করা হয়।
১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে এটি আইনে পরিণত হয়। খুলে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের রুদ্ধ পথ। আইনটি পাসের বিরোধিতা করে বিএনপি-জামায়াত হরতাল ডাকে এবং বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত থাকে। এতে প্রতীয়মান হয় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী ও পঁচাত্তরের খুনীদের বাঁচাতে তৎপর। এরপর ১৯৯৬ সালের দুই অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়েরের মাধ্যমে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের আট নভেম্বর মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ১৫ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করলে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেয়।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি–জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে উচ্চ আদালতে বিচার প্রক্রিয়া অকার্যকার করে রাখে। এরপর বিএনপি–জামায়াত জোট সরকার ২০০৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি যৌথ অভিযান দায়মুক্তি বিল ২০০৩ নামে সর্বশেষ ইনডেমনিটি আইন পাস করে। বাংলাদেশে মোট তিনবার দায়মুক্তি আইন পাস করা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুঃশাসন শেষে,তাদের ছলচাতুরীর কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লেবাসে দুই বছর দেশ শাসন করে অগণতান্ত্রিক সরকার। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় লাভের মাধ্যমে সরকার গঠন করে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচারকার্য চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপিলের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
আপিল শেষে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আদালত। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি পাঁচ জনের ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল রাতে জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনি ও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। জাতির পিতার খুনীদের মধ্যে এখনও পলাতক রয়েছেন-খন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এমিবি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান। এর মধ্যে একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী বিদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করেছেন।
খুনিদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য ২০২৩ সালে এই দায়মুক্তি আইনটি স্মরণ করছি। নতুবা নুতন প্রজন্মের অগোচরে রয়ে যেত কিভাবে জিয়াউর রহমান ঠান্ডা মাথায় ধারাবহিক ঘটনার জন্ম দিয়ে পরিকল্পনামাফিক ক্ষমতা দখলে করেছে। খন্দকার মোশতাকের জারি করা অবৈধ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই সংবিধানে যুক্ত করে বঙ্গবন্ধু হত্যায় নিজের সম্পৃক্ততা প্রকাশ করে জিয়াউর রহমান। আজ ইতিহাসের সেই কালো আইন পাসের দিন,যা জাতির জন্য লজ্জা। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হোক সেই প্রত্যাশা রইলো।
লেখক: প্রতিবেদক,প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)
এইচআর/জেআইএম