উচ্চশিক্ষা
র্যাংকিং, গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধিতে নজর দিন
উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ২০২৩ এ বিশ্বসেরা এক হাজার ৭৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ পায়। এই র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সেরা পাঁচশ’র মধ্যে নেই। এই র্যাংকিং এ ৫ টি বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
র্যাংকিংয়ে পূর্বের ন্যায় এবারও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান শেষের দিকে। বিশ্বব্যাপী এই তালিকায় ৬০১ থেকে ৮০০তমের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। র্যাংকিংয়ে পাঁচশ’র মধ্যে থাকলে আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। কারণ আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উচ্চশিক্ষায় ঐ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুনির্দিষ্ট অবদান প্রকাশ করে টাইমস হায়ার এডুকেশন ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ।
বাংলাদেশ থেকে এই র্যাংকিং এ কোন বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচশ’র মধ্যে স্থান না পেলেও প্রতিবেশী ভারতের ৫টি ও পাকিস্তানের ১টি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বসেরা পাঁচশ’র তালিকায় রয়েছে। এছাড়াও শীর্ষ ২০০ এর মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে চীন চতুর্থ অবস্থানে আছে। কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সেরা পাঁচশ তে নেই? এসব প্রশ্ন নিয়ে গভীর ভাবে পরিকল্পনা করা এবং দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নেওয়া আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ছে।
এই র্যাংকিংয়ে যেসব সূচক বিবেচনা করা হয় তার মধ্যে একাডেমিক খ্যাতি এবং গবেষণা (৬০% স্কোর)সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ। সূচকের মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণার মান বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক খ্যাতি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গত কয়েক বছর উচ্চশিক্ষায় অনেক উন্নয়ন হলেও গবেষণা তেমন কোন গুরুত্ব পায়নি। গবেষণা খাতে আমাদের আর্থিক বরাদ্দ যথেষ্ট না থাকলেও গবেষণা হয়, কিন্ত সেটা আন্তর্জাতিক মানে জায়গা করে নেয়ার মত যথেষ্ট না। লেখাপড়া, গবেষণা বাদ দিয়ে আমরা অনেকেই শিক্ষক রাজনীতি,কোন্দল, বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ—পদবী ইত্যাদির পেছনে প্রতিনিয়ত সময় ব্যয় করে যাচ্ছি।
আমাদের অনেক সহকর্মীর লেখা বা গবেষণা ভাল জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু আগ্রহী শিক্ষকদের জন্য গবেষণায় তেমন কোনো প্রণোদনা নেই। আমাদের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন ও উচ্চশিক্ষায় গবেষণার ওপর জোর দেওয়া উচিত। সেজন্য শিক্ষকদের আর্থিক গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং আর্থিক প্রণোদনার কিছু নীতি থাকা জরুরি। যেমন, একাডেমিক গবেষণার ক্ষেত্রে, অনেক চীনা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষকদের জন্য বড় নগদ বোনাস অফার করে যারা শীর্ষস্থানীয় একাডেমিক জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করে, যা একজন চীনা গবেষকের মোট বেতন বৃদ্ধি করতে পারে।
এছাড়াও ভারতে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষক বা অধ্যাপকের বাসস্থানের জন্য পুরো বিল্ডিং বরাদ্দ থাকে যেখানে তাঁরা ফ্রি বা খুবই কম ভাড়ায় থাকতে পারে। অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কায় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি বিজ্ঞপ্তিতে দেখতে পাই প্রত্যেক শিক্ষক তার মূল বেতনের ৩৫% গবেষণা ভাতা পাবেন। এমনকি পাকিস্তানে সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত, উচ্চশিক্ষা কমিশন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পূর্ণরূপে নিবন্ধিত ১৬১৪ পিএইচডি প্রার্থীদের অর্থায়ন করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারের অর্থায়নে অন্যান্য দেশে অনেকেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে থাকে যারা শিক্ষা বা গবেষণার সাথে সরাসরি জড়িত নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকারের বিভিন্ন ফেলোশিপের মাধ্যমে বিদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা বা গবেষণার সুযোগ দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের প্রতি সপ্তাহে ৩৫.৮ ঘণ্টা গবেষণায় এবং অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রমে ২২.২ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হয়। কারণ গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের এসব পলিসি এবং গবেষণাই টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে পারে। তাই আমাদের দেশে এরকম কিছু নীতি থাকলে অবশ্যই ভালো গবেষণার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের ১২.১ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। ইউনেস্কোর শিক্ষা দলিলে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে মোট বাজেটের ২০-২৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিলে দেশের গবেষণাখাতকে শক্তিশালী করা সম্ভব হতে পারে।
বিশ্বের যে সব দেশে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে কম বরাদ্দ দেয়া হয়,তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এ খাতে বাংলাদেশের ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সর্বনিম্ন। প্রতিবেশী নেপাল,ভারত,পাকিস্তান,শ্রীলঙ্কা,ভুটান, মালদ্বীপ এবং আফগানিস্তানও শিক্ষা খাতে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে ৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে ঘোষণা করা বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৯২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ে ৪ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে গবেষণায় বরাদ্দ ছিল ১১ কোটি ৫ লাখ টাকা। আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৫ কোটি ৫ লাখ টাকা,যা মোট বাজেটের ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। যা খুবই নগণ্য।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেটের ১ বা ২ শতাংশ গবেষণা খাতে বরাদ্দ করলে গবেষণা কিভাবে হবে? শুধু শিক্ষকদের দোষ তারা গবেষণা করে না। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে দেশের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ৪৪৪ কোটি ৪ লাখ টাকা। যা থেকে গবেষণার জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল বাজেটে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
চলতি অর্থবছরের তুলনায় বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ৩২ কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৫৭৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং গবেষণা খাতে ১১৮ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছিল। গতবছরের তুলনায় বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ০.২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমরা গবেষণাকে কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্তু মূল বাজেট যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যেই হারে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়েনি।
উচ্চশিক্ষা টেকসই উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে যদি গবেষণায় বরাদ্দ বেশি থাকে এবং সেই অনুসারে শিক্ষকগণ মানসম্মত গবেষণা করে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আসবে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব, যারা তাদের সৃজনশীল চিন্তা, মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে টেকসই উন্নয়ন অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। করোনাভাইরাসের মত মহামারিতে ‘জনকল্যাণমুখী গবেষণা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণা বৃদ্ধি করতে হলে শিক্ষা বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দ বেশি দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
যখন অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করোনাভাইরাসের টেস্ট কিট বা প্রতিষেধক আবিষ্কারের গবেষণা করছে, তখন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করোনা মোকাবেলায় তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। গবেষণার সরঞ্জামদির অভাব এবং আর্থিক বরাদ্দ কম থাকা এই না পারার অন্যতম কারণ। তাই সরকারকে এবিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনায় নিয়ে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য জোর অনুরোধ করছি। উচ্চশিক্ষায় গবেষণার মানের ব্যাপক উন্নয়ন ছাড়া টেকশই উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা অসম্ভব।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমন করে গড়তে হবে যাতে বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির উৎস হয় এবং এবিষয়ে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নিয়মিত মূল্যায়ন এবং পর্যাপ্ত বরাদ্দের মাধ্যমে গবেষণার বিবর্তনে শক্তিশালী প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
এইচআর/ফারুক/এএসএম