বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। মাস ছয়েক পরই বাংলাদেশে ভোট। ইতিমধ্যে এই ভোটকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নড়াচড়া দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। যখনই ভোট আসে তখনই দেশের ভেতরের-বাইরের স্বার্থান্বেষীগোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবারো ভোটের আগে তাদের তৎপরতা চোখে পড়ছে।
গত কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতি ও আসন্ন ভোট নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করে যাচ্ছেন। গত কয়েকদিনের মধ্যে তিনি জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও সরকারের মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সবশেষ গত ৬ জুন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন পিটার ডি হাস। এই বৈঠকগুলো রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে হয়েছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এত কী কথা? তিনি কী বিষয়ে কথা বলেন, তা-ও প্রায়ই বলা হয় না।
সরকার বলছে, রাষ্ট্রদূতরা যদি তাদের কাজের বাইরে গিয়ে সীমারেখা অতিক্রম করে তাহলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জাতীয় পার্টির সঙ্গে এক বৈঠকে জিজ্ঞেস করছেন, আপনারা কি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবেন নাকি আলাদা নির্বাচন করবেন? জাপানের রাষ্ট্রদূত বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, যদি ক্ষমতা বদলায় তাহলে বাংলাদেশে কি বিনিয়োগের পরিবেশ থাকবে?
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে দুজন রাষ্ট্রদূতের অতি তৎপরতায় প্রশ্ন ওঠে, তাদের এসব কাজ কতটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে? সাধারণত ভোট এলেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নাক গলানো শুরু হয়। ২০১৩ সালে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন মার্কিন প্রশাসনের প্রতিনিধিরা। সেই সময় ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড্যান মোজিনা। সেদিন বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সামনেই আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা রসিকতার ছলে বলেছিলেন, ‘ড্যান মোজিনা রাষ্ট্রদূত শুধু নন; আপনাকে আমরা বিএনপি দলের ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য বলে মনে করি’।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর প্রথমবারের মতো বিদেশি কূটনীতিকরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাক গলাতে শুরু করেন। সরকারের কী করা উচিত, কীভাবে করা উচিত- এসব নির্দেশনা আসতে থাকে বিদেশ থেকে। সময়ের পরিক্রমায় কিছু পরিবর্তন হলেও স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও তা বন্ধ হয়নি। একাদশ সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে কিছু রাষ্ট্রদূতের ‘অতি-উৎসাহী ও অতি-সক্রিয় কর্মকাণ্ড’ ছিল লক্ষণীয়। এবার তারা দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়েও মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন। বিদেশি কূটনীতিকরা কীভাবে এবং কেন আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত শিষ্টাচার অনুসরণ না করে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছেন- এ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেছেন, ‘এটা পুরোনো ইস্যু। তারা বলেন, আমরা শুনি। সবশেষ ভোটে গাজীপুরে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তবু জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন প্রশ্ন ভাবনার জন্ম দেয়। এ ধরনের হস্তক্ষেপ কিন্তু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ভোট এলেই বিদেশি কূটনীতিকদের এমন তৎপরতা আমাদের রাজনীতির দুর্বলতা। আমাদের নেতারা সব সময় তাদের দিকেই তাকিয়ে থাকেন। নালিশ জানানোর কারণে তারা আরও উৎসাহী হয়ে ওঠে। অথচ উন্নত দেশে এমনটি করা কখনোই সম্ভব নয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত জুলাই মাসে ঢাকায় অবস্থিত সব বিদেশি দূতাবাস, জাতিসংঘের কার্যালয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল; যাতে কূটনৈতিক সম্পর্কের ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন এবং কনস্যুলার সম্পর্কের ১৯৬৩ সালের নীতিমালা মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের অবশ্যই জানা উচিত তাদের আচরণ ভিয়েনা কনভেনশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারা কী করতে পারে এবং কী করতে পারে না তা স্পষ্টভাবে সেখানে বলা আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে দায়িত্ব পালন করা বিদেশি কূটনীতিকরা কনভেনশনের বাইরে যান না। রাষ্ট্রদূতরা দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়নে কথা বলবেন, কাজ করবেন এবং সহায়তা করবেন। এটি সর্বোত্তমভাবে কূটনৈতিক শিষ্টাচার। এর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই তাদের।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে নিয়োগকৃত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অবশ্যই তার পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানাতে হবে তারা কোথায় যাবেন, কার সঙ্গে কথা বলবেন বা কাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। কিন্তু কখনো কখনো তা মানা হয় না। আবার, ঢাকায় অবস্থানরত কিছু দেশের কূটনীতিকরা এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে সম্প্রতি যে ধরনের মন্তব্য করছেন তা আন্তর্জাতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থি।
এজন্য অবশ্য আমাদের রাজনীতিবিদদের দায় কম নয়। এ দেশের রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ যেভাবে বিদেশি দূতাবাসে দৌড়াদৌড়ি করেন, তা লজ্জাজনক। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য যারা বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের আমন্ত্রণ জানান, তাদেরও মনে রাখতে হবে- রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান পারস্পরিক আলোচনা ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়ই করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের কাছে অভিযোগ করা অনুচিত। এটা দেশের জন্য অসম্মানের। মূলত তাদের অভিযোগের কারণেই বিদেশিরা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ পাচ্ছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল সম্প্রতি একটি টেলিভিশন আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেছেন, রাজনীতি সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যার কারণে বিদেশিদের কথা আলোচনা করতে হচ্ছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূত এমন প্রশ্ন তোলার সাহস কোথা থেকে পেল? আমি মনে করি, রাজনৈতিক দলের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে- ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় থাকা হচ্ছে তাদের মূল লক্ষ্য।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গত ৫ জুন বলেছেন, বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা যদি তাদের কাজের সীমারেখা অতিক্রম করেন, তাহলে সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইয়ামা কিমিনোরির বিএনপির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার আলম বলেন, আমার বিস্তারিত (জাপানের রাষ্ট্রদূতের দুই বৈঠক সম্পর্কে) জানা নেই। ছয় মাস আগে অবশ্যই একটা পর্ব গেছে। যদি কোনো দেশের রাষ্ট্রদূত আবার সে ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হন, যেটা আমরা মনে করি যে তাদের কাজের সীমারেখা অতিক্রম করছে, তাহলে আমরা অবশ্যই তা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনীতিবিদ বিদেশি কূটনীতিকদের প্রতি অদ্ভুত এক মানসিকতা পোষণ করেন। বিদেশি কূটনীতিকদের দেখলে তাদের উৎসাহ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কিছু হলে এসব বিদেশিকে ডেকে অভিযোগ করা হয়। অথচ তাদের অভিযোগ করার কথা জনগণের কাছে, দেশের ভোটারদের কাছে। তারা বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে অভিযোগ জানাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, যা হওয়া উচিত নয়।
অন্যদিকে, কিছু সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ভূমিকাও প্রশংসা করার মতো নয়। বিদেশি কূটনীতিকদের দেখলে সাংবাদিকরা কেন হুমড়ি খেয়ে পড়েন? তাদের মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য সাংবাদিকের এত ব্যাকুলতা কেন? ‘বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ আছে কি, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী’- এজাতীয় প্রশ্ন অন্য কোনো দেশের সাংবাদিকরা কি কূটনীতিকদের করেন? এটি আমাদের দেশের সাংবাদিকতা পেশার একটি দুর্বলতা। কাকে সম্মান করতে হবে, কী জিজ্ঞাসা করতে হবে, কীভাবে সঠিক প্রশ্ন করতে হবে এবং উত্তর পেতে হবে তা অনেকেই জানেন না। বিশ্বের আর কোনো দেশে বিদেশি কূটনীতিকদের সাংবাদিকরা এতটা গুরুত্ব দেন না। অবশ্য আগেই বলেছি, এর জন্য আমাদের রাজনীতিবিদরাই প্রধানত দায়ী। তারাই বিদেশি কূটনীতিকদের রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ দিয়েছেন।
নির্বাচন এলে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা নিজেরাই সক্রিয় হয়ে ওঠে; আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও তাদের সক্রিয় করে তোলার উপাদান জোগান দেয়। বিদেশি কূটনীতিকদের উন্মুক্ত তৎপরতা এখনো চলছে, ভবিষ্যতেও চলতে পারে। ক্ষমতায় থাকা দলের নেতারা কূটনীতিকদের খুব বেশি দৌড়াদৌড়ি পছন্দ করেন না। কিন্তু বিরোধী দলে থাকলে তারা বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপে উৎসাহিত করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস নিয়ে নানা মন্তব্য করেন বিদেশি কূটনীতিকরা। তবে বাস্তবে দেশের রাজনৈতিক দুর্বলতা কূটনীতিকদের তৎপরতা বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে যতদিন পর্যন্ত সুস্থ ধারা ফিরে না আসবে, ততদিন বিদেশিদের অযথা নাক গলানোর প্রবণতাও দূর হবে না। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বড় দুর্বলতা যে, আমরা নিজেদের নাক কেটেও পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে চাই। রাজনীতিবিদরা নিজেরা নিজেদের শুধরে না নিলে বাইরের লোকেরা কান কথা বলতে পারবে, তাতে ভালো কিছু হবে না।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম