পেঁয়াজের ঝাঁজ কমেছে বাজারে স্বস্তি ফিরবে তো?
বাজারে গিয়েছিলাম পেঁয়াজ কিনতে। দোকানি দাম চাইলেন ৯০ টাকা। বললাম, সরকার তো পেঁয়াজ আমদানি করছে। বললো, ভারতীয় পেঁয়াজ আসতে সময় লাগবে আরও কয়েকদিন। খুচরা বাজারে দাম কমবে তারপর।
বুঝলাম, খুচরা স্তরে পেঁয়াজের ঝাঁজ কমতে আরও সময় লাগবে। জাগো নিউজের রিপোর্টঃ চাষিরা জানান, গত রোববার (৪ জুন) আতাইকুলা হাটে প্রতি মণ পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। সে পেঁয়াজ তিনদিনের ব্যবধানে পরের হাট বুধবারে মণপ্রতি কমে যায় প্রায় এক হাজার টাকা। এদিন মানভেদে প্রতি মণ পেঁয়াজ ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ পাইকারি বাজারে যে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল ৮৫-৮৭ টাকা সে পেঁয়াজের প্রতি কেজির দাম এখন ৬০-৬৫ টাকায় নেমে এসেছে। (জাগো নিউজ/০৮ জুন ২৩)
কেন ইনফরমেশনকেই পাওয়ার বলে এবার নিশ্চয় বোঝা গেলো। সেটা চাষীরাও যেমন বোঝে এখন, তেমনি আড়তদারও বড় ব্যবসায়ী ও খুচরা দোকানিরাও বোঝে। এই বোঝার ফাঁকটুকু ধরে যদি টু-পাইস কামানো যায়, সেটাই তাদের লক্ষ্য। তাদের লাভের পরিমাণ কম। কাঁচামাল তো পচে যায়। দুদিন বা পাঁচদিন ধরে রাখার পর তা পচতে শুরু করবেই। তাই তারা বেশি ঝুঁকি নেয় না। সরকারির সিদ্ধান্তের পরই আড়তদার, ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ ছাড়তে শুরু করে। তাই তিনদিনের ব্যবধানে হাজার টাকা কমে যায় এক মণ পেঁয়াজের দাম।
এখন ৬০-৬৫ টাকা কেজি দরে খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। ভারতীয় পেঁয়াজ খুচরা বাজারে পৌঁছালে তার দাম ৪০-৪৫ টাকায় নেমে আসবে। এটাই বাজারের ব্যাপারী/ব্যবসায়ীদের ধারণা। এই দাম না পেলে না কি পেঁয়াজ চাষীদের ক্ষতি হবে বলেছেন মাঠ পর্যায়ের মানুষজন। তাহলে আমরা ধারণা করতে পারি পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ মিনিমাম কেজিতে ৩০-৩৫ টাকা বা কোথাও কোথাও ৪০ টাকা।
যদি উৎপাদন খরচ গড় করে হিসাব করি তাহলে ১৬শ’ টাকা খরচ হয় এক মণ পেঁয়াজ উৎপাদন করতে? এটা কি ঠিক হিসাব। নাকি উৎপাদন খরচ আরও অনেক কম? যদি ওই ১৬শ’ টাকা খরচ হয় এক মণ পেঁয়াজ আবাদে, তাহলে ২ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করতে না পারলে চাষীর তো ক্ষতি হবেই। কিন্তু প্রশ্নটা অন্য জায়গায়।
এই যে আমরা যারা মহানগর ঢাকায় বাস করি, আমরা পেঁয়াজ কিনেছি ১৫০-১৭০ টাকা কেজি দরে। পেঁয়াজ নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলাজাতীয় পণ্য হলেও প্রতিদিন তো আর এক কেজি পেঁয়াজ লাগে না রান্নার কাজে। তাই ক্রেতা/ভোক্তার গায়ে লাগে না। কিন্তু এই মহানগরবাসীর বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেলেই সর্বত্র ত্রাহি রব ওঠে। কারণ, এই নগরনন্দনেরাই সরকারের নিয়ামক শক্তি। এরাই সরকারের পক্ষে বা সরকারের বিপক্ষে মিটিং-মিছিল করে। নানান দাবি জানায়।
এখন যেমন তারা ভোক্তার অধিকার নিয়ে কথা বলছে। এরা কিন্তু প্রান্তিক এলাকার পেঁয়াজ চাষীদের নিয়ে তেমন একটা সরব না। মাঝে মধ্যে অবশ্য কথা বলেন তারা, সারের দাম, শস্যবীজের দামসহ কৃষিউপকরণের নানা পদের দাম নিয়ে, উচ্চমূল্য নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু তাদের হিস্যা যখন টান পড়ে তখন কিন্তু নেমে আসেন তারা মিছিল নিয়ে। এই নগর জীবনের চাহিদা নিয়েই সরকার অধিক ভাবেন। গায়ের মানুষের চাহিদা নিয়ে তেমনভাবে ভাবিত নন সরকার।
ধরা যাক, পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় কি চাষীরা লাভবান হয়েছে? এর জবাব এক কথায় দেওয়া যায়, না হয়নি। মাঠ স্তরে পেঁয়াজের চলতি দামই তারা পায়। শহরে বেড়ে গেলে তাদের লাভ সামান্য ১০-১৫ টাকা বাড়ে বটে, তাতেই তারা খুশি। কিন্তু বড় ব্যবসায়ী বা আড়তদারের লাভ চাষীর চেয়ে ৩-৪গুণ। এরাই হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল শ্রেণির ব্যবসায়ী। কেউ কেউ এদের ফরিয়া হিসেবেও চেনে। মাঠের ব্যবসার ক্ষেত্রে ফড়িয়া শব্দটি চালু। এরাই পাইকারি মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করে। এরাই দিন দিন দাম বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকটের ধোয়া তুলে দাম বাড়িয়ে দেয়। এদেরও রয়েছে প্রচলিত সিন্ডিকেট।
আমরা ছেলেবেলায় বলতে শুনেছি সব শেয়ালের এক রাঁ। সন্ধ্যে বেলায়, বেলা সবেমাত্র ডুবে গেছে, আমরা শুনেছি আড়ার প্রান্তে দাড়িয়ে কোনো শেয়াল হয়তো তার পরিবারজনদের ডাকে হুক্কাহুয়া শব্দে। অমনি চারদিকের আড়া-জঙ্গল তেকে হুক্কাহুয়া রব ওঠে। এজন্যই ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানোর সিন্ডিকেটকে ওই শেয়ালের রাঁ বা ডাকের সঙ্গে সিমিলি সৃষ্টি করেছে। পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে পেঁয়াজের একটাই দর।
কেবল পেঁয়াজের কথাই বলা হলো। এই একই রীতি কাঁচা বাজারের সর্বত্র। কাঁচাবাজারের যে দোকানি আমার কাছে নব্বই টাকা চেয়েছিল, একটু সামনে এগিয়েই সেই একই পেঁয়াজ কিনলাম ৮০ টাকা কেজি দরে। এতে আমার খরচ কমলো ১০ টাকা। আর দোকানির লাভ কমলো ১০ টাকা। কিন্তু লাভ ছাড়া তো সে জিনিস বেচেনি।
চাষীরা, মাঠস্তরের উৎপাদকরা সব সময়ই মিনিমাম দরটা পান। তাদের জন্য মূল্য বেঁধে দেওয়ার কেউ নেই। সরকার যদি এ কাজটা করতেন, তাহলে সব চাষী একই রকম লাভবান হতো। তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বেঁধে দেওয়ার মতো বাণিজ্য বা কৃষিমন্ত্রী নেই। তারা কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক খাতকদের জন্য, তারা হোক সব্যসায়ী, হোক ভোক্তা তাদের জন্য দাম নির্ধারণ করে দেবেন, যাতে ব্যবসায়ী, মানে পণ্যের মধ্যস্বত্বভোগী বেশি লাভবান হতে পারেন।
এ কারণে সরকারের চরিত্র সম্পর্কে বলা হয় এই সরকার ব্যবসায়ীবান্ধব, উৎপাদকবান্ধব বা চাষীবান্ধব সরকার নয়। চাষীদের উৎপাদনের দর বেঁধে দেওয়ার কথা একবারও মনে হয়নি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। অথচ ওই ন্যায্যমূল্য পাওয়ার অধিকারী আমাদের সব ফসলের উৎপাদকই। সরকার তার নানান নামের সারের দাম বেঁধে বিক্রি করেন চাষীর কাছে। আর তাদের কষ্টার্জিত ফসলের দাম বেঁধে দেওয়ার কথা একবারও মনে উদিত হয় না। এর কারণ, আমাদের মন-মানসিকতা গঠিত হয়েছে যে শিক্ষায়, তা বহন করছে সুযোগসন্ধানী চতুর ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষার জন্য।
মননে-মানসিকতায় চাষীদের ঠকানোর তরিকায় অভ্যস্ত তারা। এই মন-মানসিকতা আমরা সাংস্কৃতিকভাবে পেয়েছি পরাধীনতার কালচারাল বিহেভ থেকে। কালচারালি আমরা চাষীদের স্বার্থরক্ষার কথাটাকে গৌণ ভাবতে শিখেছি। সেই শিক্ষারই আউটফল হচ্ছে কৃষকের ফসলের দাম বেঁধে দেওয়ার কথাটা না মনে করা। আমাদের শিকার করতে হবে যে, যে সব পোশাক পরে আমরা অফিস-আদালতে, স্কুল-কলেজে যাই, ওই পোশাকটি যে আমাদের নয় এবং তা ব্রিটিশ বা ইউরোপিয়ান, তা আমরা ভাবতে শিখিনি। এই পোশাককেই ন্যাচারালি আমাদের নিত্যদিনের ভাবছি। এটা আধুনিক, এটা কাজের ক্ষেত্রে মানানসই এবং ঝামেলামুক্ত এবং …।
এসব যুক্তিই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়। এই মনে হওয়ার জন্য ওই ভিনদেশিরা আমাদের মননে-মণীষায় ওই চিন্তার ধারা বইয়ে দিয়ে গেছে। আমরা আজ আর আমাদের আদি পোশাককে আধুনিক ও প্রগতিশীল ভাবি না। এভাবেই আমরা আজও স্বাধীন হয়েও পরাধীন হয়ে রয়েছি। যত দিন পর্যন্ত এই মনন-মানসিকতার অন্ধকার ভেদ করে বেরুতে না পারবো ততদিন পর্যন্ত আমাদের কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবে না তাদের ফসলের। এবং আমরা বছরের পর বছর লিখেও এই ধারার অবসান ঘটিয়ে আমাদের নিজস্বতায় ফিরতে পারবো না।
আমি আশা করতে চাই সরকার, কৃষকের প্রত্যেক ফসলের দাম বেঁধে দেবেন তার উৎপাদন ব্যয়কে সামনে রেখে, তাকে লাভবান করে। ব্যবসায়ীদেরও মিনিমাম লাভের দাবিটা ন্যায়সঙ্গত করে কাঁচাবাজারের দামও বেঁধে দিতে হবে। সিস্টেম চালু করলে চাষীরা লাভবান হবে। আমরা সেটাই চাই।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস