ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কেন দেশ ছাড়ে মানুষ?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ১০ জুন ২০২৩

একটা সময় ছিল যখন আমলা, প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও ধনী ব্যবসায়ীদের ছেলেমেয়েরা এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষার পর বিদেশে পড়তে যেতো। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্বের সব বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। আরেকটা অংশ রাজনৈতিক সুবিধায় সোভিয়েত রাশিয়া, পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরিতে পড়তে যেত। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে বেশিরভাগ ফিরে এলেও উল্টো চিত্র ছিল পশ্চিমা দেশের বেলায়। এরা ফিরে আসতো কম। আর ফিরে এলেও তাদেরই দখলে থাকতো বহুজাতিক কোম্পানিসহ বড় প্রইভেট সেক্টরের চাকরি।

কেউবা সরাসরি পারিবারিক ব্যবসায়। বৃত্তি নিয়ে গ্রাম বা শহর থেকে যে অনেক অতি সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েও বিদেশ যেতো। আর যেতো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক যারা এমএস বা পিএইচডি করতে যেতেন। বিশ্ববিদ্যালয় হতে ছুটি গ্রহণ করে বিদেশে পাড়ি জমালেও আর দেশে ফিরতেন না অনেকে। সেই ধারা এখনও অব্যাহত আছে।

এখন চিত্র বদলে গেছে। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এমনকি গরিব ঘরের ঘরের ছেলেমেয়েরাও বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নিতে যাচ্ছে। আমার মতো অতি সাধারণ চাকরিজীবীর কন্যাও বৃত্তি নিয়ে পড়ছে বিদেশে। নিজেকেও কিছু খরচ বহন করতে হয়। চিত্রটা বদলালো কেন? কেন ছেলেমেয়েরা দেশে থাকতে চায় না? একটা বড় কারণ দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে। চাকরির বাজারের বেহাল দশা। একটা সাধারণ ধারণা তৈরি হয়েছে যে, এদেশে পড়াশোনা করেই বা কী হবে?

এটি একটি দিক। আজকাল দেখা যাচ্ছে দেশের ভেতরে বড় চাকরি করছে বা ব্যবসা করছে, তারাও চলে যাচ্ছে বা বিদেশে একটি ঠিকানা রাখছে। যারা দুর্নীতি করে টাকা পাচার করেছে, বিদেশে সম্পদ গড়েছে তাদের সাথে এই পক্ষটাকে মিলিয়ে দেখা যাবে না। একটা দিক হলো দেশে একটা বড় অংশ পড়ছে ইংরেজি মাধ্যমে। বাংলা মাধ্যমের প্রয়োজনীয় ও মানসম্পন্ন বিদ্যালয় না থাকায় আর্থিক দুরবস্থা আছে এমন পরিবারও সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

এরা নকল করে পড়েনা, এদের পরীক্ষা হয় একটা বিশ্বমানের প্রশ্নে। এদের স্কুলে ফাঁকি নেই, সিলেবাস আন্তর্জাতিক মানের এবং শিক্ষকরাও আধুনিক ও যোগ্য। কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন করে ভর্তি প্রথা করে রেখেছে যেন এই পড়ুয়ারা সুযোগ না পায়। এদের জন্য একমাত্র উপায় ব্যয়বহুল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এবং সেই খরচটা এমন যে, এই টাকায় বিদেশে পড়া যায়। ছেলেমেয়েরা নিজেরাই যোগাযোগ করে, বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষা দিয়ে এখন বিদেশ যায়।

আজকাল যেকোনো আলোচনায় সাধারণ বিষয় ছেলেমেয়েদের কীভাবে বিদেশে পাঠানো যায়। ছেলেমেয়েরাও এই আলোচনা বা পরিকল্পনাই বেশি করে। আমাদের মেধাবী সন্তানরা বিদেশে পাড়ি জমাতে হন্যে হয়ে চেষ্টা করছে। এই প্রবণতাকে নেতিবাচক ভাবার কোনো কারণ নেই। সারা পৃথিবীতেই আমাদর ছড়িয়ে পড়তে হবে যেমনটা ছড়িয়েছে ভারতীয়রা। শুধু শ্রমশক্তি পাঠানোর দিন শেষ হয়ে গেছে।

বিদেশে যারা পড়ছে তারা পড়ছে, ক্লাস করছে আড্ডা দিচ্ছে, বেড়াতে যাচ্ছে এবং পড়ালেখা নষ্ট না করে কাজ করে কিছু আয়ও করছে। এই ছেলেমেয়েরা বিদেশে বসে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরও পায়, তারা জানে এবং দেশে থাকতেও জানতো যে, এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক চরম আধিপত্যবাদী রাজনীতি আছে, আবাসিক হলে গণরুম আছে, টর্চার সেল আছে, খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন আছে এবং নেই শুধু শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ। দিনের পর দিন এসব দেখে পড়ালেখা করতে চাওয়া ছেলেমেয়েরা সিদ্ধান্ত নেয় ‘চলে যেতে হবে যে করেই হোক’।

সুশাসনের অভাবও মানুষকে দেশ ছাড়া করে। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আমরা ছেলেমেয়দের ভেতর রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের ধারণাটা দেখতে পেয়েছিলাম। দুঃখজনক যে আমরা তাদের চাওয়াটা আমলে নেইনি। কথা দিয়েও সড়ক নিরাপদে রাষ্ট্র সচেষ্ট হয়নি।

এখনকার ছেলেমেয়দের সামনে পুরো দুনিয়াটা খোলা। তারা পশ্চিমের সুশাসিত গণতান্ত্রিক সমাজটা দেখে আর নিজের সাথে তুলনা করে। ওরা খুব ভাল করেই জানে যে, এখানে চাকরি মানেই বিসিএস পাস কর, নয়তো কোনো মর্যাদা নেই। ঘুস বা রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব ছাড়া অন্য চাকরি বা নাগরিক সেবা জুটেনা। এখানে নানা আইনে মত প্রকাশ নিয়ন্ত্রিত এবং সর্বত্র এক ভয়ের সংস্কৃতি।

এরকম আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতার কারণে বিকশিত হওয়ার অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে মেধাবী তরুণ প্রজন্ম উন্নত দেশে পাড়ি জমায়। আর আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার অভাবেও স্থানান্তর ঘটে অনেক।

ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে অবস্থান করা একটা ছোট অংশ ছাড়া নিজ দেশ নিয়ে সন্তুষ্ট এমন নাগরিকই পাওয়া কঠিন এখন। বিদেশে পাড়ি জমানোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হলো এই প্রবণতার ফলে দেশে শিক্ষিত জনসমষ্টি ক্রমশ কমতে থাকবে। এর বড় প্রভাব পড়বে দেশের প্রতিটি খাতে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এসব ক্ষেত্রে সত্যিকারের শিক্ষিত জনসমষ্টি না থাকলে দেশের অগ্রগতি আটকে যাবে।

অনেকেই বলবেন মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করলে ছেলেমেয়েরা কম বিদেশে যাবে। এতে কিছুটা হলেও বড় পরিবর্তন ঘটবে না। মানুষ একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চায় যেখানে তার নিজের একটা মর্যাদা আছে। সেটি হাতছাড়া হয়ে গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখান থেকে ফেরার সবচেয়ে বড় পথ সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতি। যথাযথ নিরাপত্তা ও জীবনযাপনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না পেলে মানুষ দূরের পথে হাঁটবেই।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন