ধর্ম
স্মরণ করি প্রতিনিয়ত
মহান সৃষ্টিকর্তার স্মরণের মাঝেই প্রকৃত সুখ নিহিত। এই পৃথিবীতে কেউ স্থায়ী নয়। প্রকৃতিতে প্রত্যেক প্রাণির জন্য মৃত্যুর চাইতে সুনিশ্চিত বিষয় আর কিছুই নেই। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘তোমার পূর্বেও কোনো মানুষকে আমি অনন্ত জীবন দান করিনি। সুতরাং তুমি মারা গেলে তারা কি চিরঞ্জীব হবে? প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং তোমরা আমার কাছেই প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ৩৪-৩৫)
আবার তিনি ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক প্রাণিকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর কেয়ামতের দিন তোমাদের পরিপূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে। তারপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেই সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ধোঁকার বস্তু ছাড়া কিছুই নয়।’ (সুরা আলে ইমরান: আয়াত ১৮৫)
প্রত্যেক আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে অথচ মানুষ এ মৃত্যুর কথা একেবারেই ভুলে থাকে। মৃত্যুর কথা একবারও স্মরণ করে না। আমরা যেখানেই থাকি না কেন আমাদেরকে মৃত্যু বরণ করতেই হবে। যেভাবে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও।’ (সুরা আন নিসা: আয়াত ৭৮)
প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে মৃত্যু যে একটি অবশ্যম্ভাবী সত্য তা এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। এ পৃথিবী বাহ্যত অত্যন্ত মধুময় ও আকর্ষণীয় বলে মনে হয় কিন্তু দুনিয়াটা আসলেই ছলনায় পূর্ণ। অল্প ক’দিনের এ দুনিয়ায় আমরা মেহমান মাত্র। তাই আমাদের উচিত হবে মৃত্যুর কথা স্মরণ করে পুণ্য কাজ করা। এছাড়া আমাদের আত্মীয়স্বজন যারা আমাদেরকে ছেড়ে চলেগেছেন তাদের জন্য আমাদের দোয়া করা উচিত। আমরা মৃতদের জন্য দোয়া করব।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সুন্দর একটি দোয়া শিখিয়েছেন, ‘রাব্বানাগফিরলানা ওয়া লি ইখওয়ানিনাল্লাযিনা ছাবকুনা বিল ইমানি ওয়ালা তাজআল ফি কুলুবিনা গিল্লাল লিল্লাযিনা আমানু রাব্বানা ইন্নাকা রাউফুর রাহিম।’ (সুরা হাশর : আয়াত ১০) অর্থ: ‘হে আমাদের প্রভু প্রতিপালক! আমাদের ক্ষমা কর এবং আমাদের সেসব ভাইকেও ক্ষমা কর যারা আমাদের আগে ইমান এনেছে আর মুমিনদের প্রতি আমাদের হৃদয়ে কোন বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয় তুমি অতি স্নেহশীল ও বার বার কৃপাকারী।’
আমরা আমাদের পিতা মাতার জন্য এই দোয়াটি করব: ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৪) অর্থ : ‘হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি তাদের প্রতি সেভাবে দয়া কর যেভাবে শৈশবে তারা আমায় লালনপালন করেছিল।’ পবিত্র কোরআনের এই দোয়া প্রমাণ করছে, পিতামাতার বৃদ্ধ বয়সে তাদের প্রতি স্নেহমমতার ব্যবহার করা জরুরি যেভাবে তারা শৈশবে তাদের সন্তানদের লালনপালনের জন্য করে থাকেন।
আমাদের আপনজন কেউ মারা গেলে তাদের আত্মার মাগফেরাত ও শান্তি কামনায় নিকটাত্মীয় জীবিতরা যে কাজগুলো অব্যাহত রাখতে পারেন সে বিষয়ে হাদিসে এসেছে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বর্ণনা করেছেন, ‘মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার সমস্ত আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের দরজা বন্ধ হয় না। (ক) সদকায়ে জারিয়া (খ) যদি কেউ এমন সন্তান রেখে যায়, যে সন্তান বাবা মায়ের জন্য দোয়া করবে (গ) এমন দীনি শিক্ষা রেখে যায়, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে।’ (মুসলিম)
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, এক সাহাবি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার মা হঠাৎ মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি কোনো ওসিয়ত করে যেতে পারেননি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন, তাহলে দান সদকা করতেন। আমি তার পক্ষ থেকে দান সদকা করলে কি তিনি এর সওয়াব পাবেন? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হ্যা, অবশ্যই পাবেন।’ (বোখারি ও মুসলিম)
মৃতদের কবরে গিয়ে আমরা দোয়া করব, কেননা গোরস্থানে গেলে পরকাল স্মরণ হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি এর আগে তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, তবে এখন থেকে অনুমতি দিলাম, তোমরা কবর জিয়ারত করো। কেননা তা তোমাদের দুনিয়াবিমুখ করে এবং পরকালকে স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (ইবনে মাজাহ)
কারও মৃত্যুর পর তার জন্য বিলাপ করে কান্না করা, মাতম করা, পকেট ছেঁড়া, গালে বা পিঠে আঘাত করা ইসলামের নিষেধ। যে ব্যক্তি এমন করে তাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মতের বাইরের লোক হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গালে থাপ্পড় মারে, পকেট ছিঁড়ে ফেলে ও জাহিলিয়াতের রীতিনীতির প্রতি আহ্বান করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (বোখারি)
কেউ মারা গেলে কুলখানি এবং চল্লিশা করার কোন শিক্ষা ইসলামে নেই বরং মৃতের শোকাহত পরিবারের জন্য খাবার আয়োজন করার নির্দেশ করেছে ইসলাম। (আবু দাউদ)
মানুষের দৈহিক মৃত্যু হয় কিন্তু তার জীবনের সৎকর্ম তাকে পৃথিবীতে অমরত্ব দান করে। তাই আমরা যেন এই মেহমানখানায় এমন কাজ করি যাতে তিনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। আমরা যদি প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে স্মরণ করি আর খোদাকে ভয় কির তাহলে অনেক মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকা সম্ভব হবে।
আসুন, দয়াময় প্রভুর দরবারে সবিনয় প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের ক্ষমা করেন এবং তার দয়ার চাদরে আবৃত করে নেন, আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস