ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

হালদায় ডিমপাড়ার লগ্ন যায়

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ৩১ মে ২০২৩

এবছর আমপাড়ার ক্যালেন্ডারে ঘোষিত প্রথম নির্দিষ্ট তারিখ পার হলেও আমের আঁটি ভালোভাবে চাপেনি। ঘোষিত লগ্ন পার হলো, কিন্তু বিপত্তি থেকেই গেলো। তাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষীরা কেউ সেদিন আম পাড়তে উৎসাহী হননি। এ মৌসুমে বিব্রতকর পরিস্থিতি নিয়ে সে সময়টা পার হয়েছে।

এর দুই সপ্তাহ না পেরোতেই আবার আরেকটি প্রাকৃতিক ঘটনা সংবাদের শিরোনাম হয়ে এলো। তা হলো- হালদা নদীতে শত শত জেলে নৌকা ও মশারি জাল নিয়ে মাছের ডিম সংগ্রহের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। তারা ঘূর্ণিঝড় মোখাকে লক্ষ্য করে অতিবৃষ্টির আশা করেছিলেন। সেই অতিবৃষ্টি শুরু হলে রুই-কাতলা ও অন্য কার্পজাতীয় মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে হালদা নদীতে প্রবেশ করবে।

মা মাছেরা হালদার বাঁকে বাঁকে স্রোতের মধ্যে ডিম ছাড়তে শুরু করলেই বাজিমাত। সেখানে পাতানো পাতলা কাপড়ের জাল ছেঁকে ডিম আহরণ করা হবে। মাছের ডিম ধরে হ্যাঁচারিতে পোনা তৈরি করে সেই পোনা নার্সারি পুকুরে বড় করে বিক্রি করে অনেক টাকা আয় হবে। এজন্য সারা বছর ধরে এই দিনটির আশায় নদীপাড়ের জেলেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন। কিন্তু মোখা চলে গেলো। যৎসামান্য বৃষ্টি হয়েছে মোখার প্রভাবে। দেশের আশিভাগ জেলার মানুষ মোখা নামক ঘূর্ণিঝড়ের কোনো প্রভাবই বুঝতে পারেনি। দেশের উত্তরাঞ্চলে সেসময় বৃষ্টিই হয়নি। বরং মোখার প্রভাবে প্রচণ্ড গরম অনুভূত হয়েছে।

মোখা চলে যাওয়ার পর গরমের প্রভাবে হিমালয়ের পাদদেশে এবং আসামের পাহাড়ি এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা। সীমান্তের ওপাড়ে ভারী বৃষ্টি হলে বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকার নদী ও হাওরে ঢল নামে। এবছর উজানে বৃষ্টি হলেও আমাদের পাহাড়ি নদীগুলোতে এখনও ঢল নামেনি। রুই-কাতলা আসার সুযোগ পায়নি। মে মাস শেষ হতে চললো তবুও হালদা পাড়ের জেলেদের অপেক্ষার পালা ফুরায়নি। তারা বেকার হয়ে বসে আছে।

এই দুটো অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়, প্রকৃতির আচরণে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। সেমিনার-কনফারেন্সে প্রকৃতির পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আশঙ্কা করে যেসব বিবৃতি দেওয়া হয় তা অনেকে গ্রাহ্য করেন না। এমনকি মনুষ্যসৃষ্ট ক্ষতির আশঙ্কা এড়াতে আরোপিত কার্বন ট্যাক্স দিতে গড়িমসি করতে দেখা যায় অনেক সভ্য দেশে নীতিনির্ধারকদের। প্রকৃতিকে বশ করে মানুষ বাঁচতে চায়। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকৃতির ক্ষতি সাধন করার পর সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য পুনরায় আরও জটিল বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার তাগিদ ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

সারা পৃথিবীতে উন্নয়নের নামে প্রকৃতি বিনাশ করার আয়োজন থেকে নেই। করোনাকালে আমাদের নজরে এসেছিল বিমান, জাহাজ, কলকারখানা বন্ধ রাখার ফলে শব্দ দূষণের মাত্র কতটা নিচে নেমে গিয়েছিল। পৃথিবীতে কম্পনের মাত্রাও অনেক কমে গিয়েছিল। গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ থাকার ফলে শব্দ ও আলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বনের প্রাণীরা নির্ভয়ে লোকালয়ে এসে ভিড় জমাচ্ছিল। করোনা ছড়িয়ে দিয়ে প্রকৃতি নিজে একটু জিরিয়ে শান্তির নিশ্বাস নিতে চেয়েছিল মনে হয়। কিন্তু মানুষ নাছোড়বান্দা। দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালিয়ে মরণব্যাধি করোনার বিকাশ রুখে দিয়েছে। ডাব্লিউএইচও ইতোমধ্যে সারা পৃথিবী থেকে করোনার বিদায় ঘণ্টার কথা ঘোষণা করে ভয় দূর করার বার্তা দিয়েছে। কিন্তু মানুষের প্রকৃতি ধ্বংস করার কর্মসূচি থেমে যায়নি। আমরা বিজ্ঞান ও নিত্যনতুন প্রযুক্তির জয়গান গাই প্রতিদিন।

সাথে সমুদ্রে বিষাক্ত বর্জ্য নিক্ষেপের মাধ্যমে মারাত্মক দূষণ ছড়ানো, পাহাড় কাটা, নদীতে বাঁধ নির্মাণ, নদীদখল, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, নদী-খাল ভরাট, ব্রিজ নির্মাণ, অটোমোবাইল তৈরি, বন উজাড়, এমনকি রাস্তার পাশের ছায়াদানকারী গাছগুলো কেটে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করে চলছি। যেগুলো প্রকৃতির অঙ্গচ্ছেদনের নামান্তর। আমরা একদিকে প্রকৃতি বিনাশ করছি অন্যদিকে প্রকৃতির দয়ার ওপর ভরসা করে আমপাড়া, মাছের ডিমধরা ইত্যাদির জন্য ক্যালেন্ডার বানিয়ে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। আমাদের মধ্যে এমন বৈপরিত্য কেন?

তার প্রধান কারণ মানুষের চরম সীমাবদ্ধতা। মানুষ এখনও প্রকৃতির প্রতি অসহায়। এখনও মানুষ প্রকৃতির বহুদিক সম্পর্কে অজ্ঞ। এই অজ্ঞতার বহর অস্বীকার করে অনেক মানুষ নিজ জ্ঞানের বড়াই করে। মানুষ যখন তার নিজের বড় ছায়া দেখে নিজেকে অনেক বড় মনে করে তখন সে অনেক বড় ভুল করে। কারণ, সূর্য যখন হেলে পড়ে তখন সেই সূর্যের আলোতে মানুষের নিজের ছায়াকে বড় দেখা যায়। তাই মানুষ যখন নিজের জ্ঞানকে অনেক বড় ভেবে বড়াই করে, তখন বুঝে নিতে হয় যে তার জ্ঞান অস্তাচলের দিকে ধাবমান।

তাই তো একজন রোগী সম্পর্কে অশিক্ষিত কবিরাজ বা হাতুড়ে ডাক্তার প্রথমেই যা বলেন সেটা একজন নামকরা, পাস করা ডাক্তার রোগীকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা চরিত্র করার পর একবারে ঠেকে গেলে সেই একই কথা বলেন। আর তা হলো- আমার চেষ্টার আমি কোনো ত্রুটি করিনি, এখন সৃষ্টিকর্তাকে ডাকুন!

এটাই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। এটাকে কোনোভাবে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবুও কিছু মানুষ জ্ঞানপাপী হওয়ার চেষ্টা করে। তারা প্রকৃতির ওপর খবরদারি করতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করে বসে। এটা করতে গিয়ে তারা কোনো কূল রক্ষা করতে না পেরে হতাশ হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।

এজন্য আমাদের ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। মানুষ সারাবছর সবকিছুর স্বাদ আস্বাদন করতে আগ্রহী। তাই সবকিছুতে সবার মনে ‘বারোমাসি’ প্রাপ্তির ধারণা উথলে উঠেছে।বছরব্যাপী সবকিছু পেতে চাই, খেতে চাই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এটা আমাদের শিক্ষাদান করছে। গ্রাফটিং করে একই গাছে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা ফলাচ্ছি। একই সবজির গাছে ডালে বেগুন, টমেটো, মাটির নিচে আলু ফলাতে চেষ্টা করছি।

বহুদিন আগে রেডিওতে একটি গান শুনেছিলাম, ‘শুনেন ভাই নতুন সমাচার, ইনজেকশন দিয়া মাছের বাচ্চা ফুটায় চমৎকার!’ ইনজেকশন দিয়ে কৃত্রিমভাবে মা-বাবা মাছের পেটের ডিম ও স্পার্ম পাড়িয়ে একত্রে মিশিয়ে পোনা তৈরি করে মাছের অভাব পূরণ করে চলেছি। সবই তো সম্ভব করা হচ্ছে! তাহলে হালদা নদীর পাড়ে মা রুই-কাতলাদের আগমন ও ডিম পাড়ার দিনক্ষণ নিয়ে এত হতাশা দিয়ে সময়ক্ষেপণ করছি কেন?

তার কারণ হলো কিছু মানুষ সবসময় প্রকৃতি বিনাশ করবে। আর কিছু মানুষ সেটাকে রক্ষা করার জন্য জীবনভর কান্নাকাটি করবে, সংগ্রাম করবে, গবেষণা করবে। এটাই হলো ডেরিল মেসারের কথা- ‘বায়োএথিকস্- দ্য লাভ অব লাইফ’। প্রকৃত বা আসলের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা- একশ্রেণির মানুষের প্রাকৃতিক বা জন্মগত বৈশিষ্ট্য।

আরেক শ্রেণির মানুষ রয়েছে তারা প্লাস-মাইনাস থিওরিতে বিশ্বাস করে। সকালে পাপ করে, বিকেলে পাপ খণ্ডনের জন্য পরিতাপ করে। তারা চোরকে চুরি করতে বলে আবার গিরিকে সাবধান হতে বলে। পৃথিবীতে এদের সংখ্যা অনেক বেশি। এজন্য হয়তো পৃথিবীটা প্লেটোর কল্পনার স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে না। এজন্য দ্বিবিধ ভূমিকা বা মানব মনের অস্থিরতাকে দোষারোপ করা যেতে পারে।

তবে এ কেমন অস্থিরতা বা বৈপরিত্য আমাদের মেজাজে মননে? আসলে বৈপরিত্যটা হলো আমাদের জিহ্বায়, আমাদের রুচিতে। প্রকৃতি বা আসল বা দেশিটা পরিবর্তন করে দিয়েছি নিজের প্রয়োজনের তাগিদে। দেশিটা ধ্বংস হয়ে গেছে। সবকিছু এখন কৃত্রিম। তবুও বাজারে গিয়ে খুঁজি দেশি মুরগি, দেশি খাসি, দেশি কৈ, নদীর পাবদা। আর বলি, আগের সেই স্বাদ কোথায় হারিয়ে গেলো? অপরের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়ে খাবার টেবিলে ব্রয়লার, হাইব্রিড দেখলে নাক সিটকাই!

প্রকৃতির ওপর মানুষের ক্রমাগত সীমাবদ্ধতার জন্য সব জায়গায় দ্বন্দ্ব নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে যেতে হচ্ছে। তাই উপযুক্ত গবেষণা না করে শুধু ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণ দিয়ে আম পাড়ার দিনক্ষণ দিয়ে ক্যালেন্ডার বানানো হচ্ছে ও মাছের ডিম ছাড়ার জন্য হালদা তীরে অপেক্ষা করার কথা বলা হচ্ছে। এসব ভবিষ্যদ্বাণীতে আমরা বিফল হয়ে যাচ্ছি। তাই শুধু পরিবর্তিত প্রকৃতির ওপর ভরসা করে বানানো লগ্নসূচির ওপর নির্ভর না করে আরও গভীর গবেষণা নির্ভর তথ্য পাওয়ার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালানোর বিকল্প নেই।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এএসএম

আরও পড়ুন