ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মার্কিন ভিসানীতি: স্বস্তি-অস্বস্তি

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৯:২৩ এএম, ২৯ মে ২০২৩

একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন নিশ্চিত করতে ঘোষিত মার্কিন নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে রীতিমতো সাইক্লোন বইয়ে দিয়েছে। দৃশ্যত সবাই মার্কিন ভিসা নীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। কারণ মার্কিন চাওয়ার সাথে সরকারি দল, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ- কারও চাওয়ারই অমিল নেই।

অন্তত মুখে সবাই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। তবে মুখে স্বাগত জানালেও অস্বস্তি আছে সব মহলেই। প্রথমে নাগরিক সমাজ বা সুশীল সমাজের অস্বস্তির কথাটা বলে নেই। রাজনীতিবিদরা নিজেদের সুবিধামতো বিদেশি শক্তির কাছে ধরনা দিলেও নাগরিক সমাজ বা সাধারণ মানুষ সবসময়ই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে।

সাধারণ মানুষের এ আবেগের কথাটা রাজনীতিবিদদের অজানা নয়। তাই তারা যতই ধরনা দিক, মুখে বিদেশি হস্তক্ষেপের সমালোচনা করে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি, নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পরদিনই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে বৈঠক করে এসেছেন। বৈঠকে তারা নতুন ভিসা নীতিকে স্বাগতই জানিয়েছেন।

সাধারণ মানুষও দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। কিন্তু সেটা যদি আমরা নিজেরাই নিশ্চিত করতে পারতাম, তাহলেই সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহের কারণে সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সে কারণেই বিদেশি হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আর তাদের ভিসাকে সমান্তরাল করে তুলেছে; তা অস্বস্তিকর, অপমানজনক, দুঃখজনক। ব্যর্থতাটা রাজনীতিবিদদের, কিন্তু অপমানটা সবার।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই পারস্পরিক দায় চাপানোর প্রবণতা আছে। নতুন মার্কিন ভিসা নীতি নিয়েও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সরকারি দল বলছে, এটা বিরোধী দলের জন্য সতর্কবার্তা। আর বিরোধী দল বলছে, সরকারি দলের ধারাবাহিক অগণতান্ত্রিক আচরণের জন্যই এটা হয়েছে। তবে নতুন মার্কিন ভিসা নীতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, এই নীতি বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

যারাই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত, তারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। দৃশ্যত নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারি দলের ভূমিকাই বেশি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নতুন মার্কিন ভিসা নীতি সরকারি দলের জন্য প্রবল চাপ হয়েই এসেছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। আর ২০১৮ সালে নামকাওয়াস্তে অংশ নিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন ভালো না হওয়ার দায় পুরোটাই নিতে হয়েছে সরকারি দলকে। তাই আগামী নির্বাচনটি অংশগ্রহণমুলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার এক ধরনের দায় তৈরি হয়েছে সরকারি দলের ওপর। মার্কিন ভিসা নীতির প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর অব্যাহত অঙ্গীকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় সমর্থনকে সরকার সব সময় ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করে।’

এই আকাঙ্ক্ষা সবারই। কিন্তু এখন এই আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে হবে। ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনে যা ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তির সুযোগ আর থাকছে না। আর গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়া মানে কিন্তু শুধু নির্বাচনের দিন নয়, এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। নতুন ভিসা নীতিতেও সেটা স্পষ্ট করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে: ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার চর্চাকে সহিংসতার মাধ্যমে বাধাদান।

পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তার মানে বিরোধী দলের আন্দোলন আর আগের স্টাইলে দমন করা যাবে না, বাধা দেওয়া যাবে না মতপ্রকাশেও। এটা নিশ্চিত এই ভিসা নীতির ফলে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক স্পেস অনেক বাড়বে। সরকারি দলের জন্য সবচেয়ে বড় অস্বস্তি হলো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আগের মতো নাও থাকতে পারে।

নতুন মার্কিন ভিসা নীতিতে বিরোধী মহলে ব্যাপক উল্লাস পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেকদিন ধরেই বিরোধী দল একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। মার্কিন ভিসা নীতিকে তারা আন্দোলনের সাফল্য হিসেবেই বিবেচনা করছে। কিন্তু বিরোধীদের মূল যে দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সে ব্যাপারে ভিসা নীতিতে কিছু বলা হয়নি।

অনেকে বলছেন, এটা ভিসা নীতিতে বলার মতো বিষয় নয়। তবে কয়েক মাস ধরে নানা পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবাধ নির্বাচনের কথা বললেও কখনোই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেনি। তার মানে নতুন ভিসা নীতির ফলে বিএনপিকে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের ভরসায় বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশ না নেওয়াও নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

বিএনপি যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রতিহত করতে চায়, যদি জ্বলাও, পোড়াও করে; তাহলে সেটাও কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করাই হবে। এট ঠিক নতুন ভিসা নীতির ফলে বিএনপির আন্দোলন করার সুযোগ অনেক বাড়বে। সরকার হয়তো আগের মতো মামলা, হামলা, ধরপাকড় চালাতে পারবে না। কিন্তু আন্দোলনের নামে সহিংসতার সুযোগও কিন্তু থাকবে না তাদের সামনে।

গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় ধারণা করা হয়, বিএনপি আন্দোলন করে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করে ফেলবে, তেমন বাস্তবতা নেই মাঠে। বিএনপির মূল চাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল চাওয়া অবাধ নির্বাচন। এখন বিএনপি কীভাবে এই দুই চাওয়ার মধ্যে মেলবন্ধ ঘটাবে সেটার ওপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু।

মার্কিন ভিসা নীতির পরও যদি বিএনপি নির্বাচন বর্জনের পথেই হাঁটে, তাহলে সেটা তাদের জন্য আত্মঘাতী হবে। আবার ভিসা নীতির ভরসায় বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচনে গেলে তাদের এতদিনের আন্দোলন নৈতিক ভিত্তি হারাবে। বিএনপি মহলে তাই উল্লাসের স্রোতের পাশে অস্বস্তির চোরা স্রোতও রয়েছে। আওয়ামী লীগের অস্বস্তির চেয়ে বিএনপির অস্বস্তি কম নয়।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিসা নীতি ঘোষণার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমসহ সবার। যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায়, তাদের সবাইকে আমাদের সমর্থন দিতে আমি এই নীতি ঘোষণা করছি।’ মার্কিন ভিসা নীতি কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়, এটা একধরনের সতর্কবার্তা। আর সেই বার্তাটা সবার জন্যই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাত্তা না দেওয়ার বোকামি না করে আমরা যত তাড়াতাড়ি তাদের বার্তাটা ভালোভাবে বুঝতে পারবো, ততই মঙ্গল।

স্বস্তি, অস্বস্তি, চাপ সব মাথায় রেখে যদি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দায়িত্বশীল আচরণ করে তাহলে বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন, জনগণ ভোট দিলে আছি, নইলে নাই। তাঁর এই ইচ্ছার প্রতিফলন যদি নির্বাচনের মাঠে ঘটে, জনগণ যদি নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়; তাহলে সবার জন্যই লাভ।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম