ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

গ্রন্থ পর্যালোচনা

‘অ-জনগণকরণের’ রাজনৈতিক অর্থনীতি

ড. মতিউর রহমান | প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ২৮ মে ২০২৩

 

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে গণমানুষের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত রচিত গবেষণাগ্রন্থ ‘অ-জনগণকরণের’ রাজনৈতিক অর্থনীতি: বাংলাদেশে ৫০ বছরের রাষ্ট্রীয় বাজেটে পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ ও ভূমি সংস্কার’। দেশ ও দেশের বাইরে বরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ ও গবেষক তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “ধারণা হিসেবে ‘অ-জনগণ’ এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় স্পষ্ট ধারণা নয়। সমাজ বিশ্লেষণে ‘অ-জনগণ’ ধারণাটি এখন পর্যন্ত খুব একটা স্বীকৃত নয়। অথবা বলা চলে ব্যাখ্যায়িত নয়।

এসবের বিপরীতে আমাদের ধারণা হলো সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র এর বিবর্তন ও বিকাশ বিশ্লেষণে সমাজবদ্ধ মানুষের বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতার বহুমুখী রূপ ও মাত্রা অনুসন্ধান বেশ কার্যকর ফল দিতে পারে। এসব বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতা যে সমাজে বিধিবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করে সে সমাজে সংশ্লিষ্ট মানুষ―ব্যক্তি হিসেবে এবং সমাজবদ্ধ গোষ্ঠী হিসেবে―জনগণ নন। তারা অ-জনগণ। আর ‘অ-জনগণকরণ’ অথবা একই কথা ‘অ-জনগণীকরণ’ হলো সে প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট মানুষের বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতা বিধিবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করে এবং এসবের গতি হয় ঊর্ধ্বমুখী (সরকারি—আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান যাই-ই বলুক না কেন)।”

স্বনামখ্যাত গবেষক ড. আবুল বারকাত উল্লেখ করেছেন, “এই গ্রন্থে বড় মাপের দুটো কাজ করতে হয়েছে। প্রথম কাজটি হলো— ‘অ-জনগণ’ ধারণাটি সুসংহত করা; এবং তার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সারবত্তা উদ্ঘাটন করা। গ্রন্থ রচনার প্রক্রিয়ায় বহুবার পরীক্ষা-নীরিক্ষাপূর্বক ‘অ-জনগণ’ ধারণাটি পরিবর্তন-পরিমার্জন করতে হয়েছে। আর দ্বিতীয় কাজটি হলো, বিভিন্ন বৃহৎ বর্গের ‘অ-জনগণ’।

মানুষকে রাষ্ট্র—সরকার কোন দৃষ্টিতে দেখেন—সেটা উন্মোচন করা। দ্বিতীয় কাজটি করা হয়েছে গত ৫০ বছরের জাতীয় বাজেটে বৃহৎ বর্গের ‘অ-জনগণ’ মানুষের হিস্যার বিবর্তন ও ধারা অনুসন্ধান করে। একই সঙ্গে করা হয়েছে ‘অ-জনগণ’ মানুষের ‘জনগণকরণ’ রূপান্তরে জাতীয় বাজেটে ন্যায়সঙ্গত-ন্যায্য হিস্যা কী হতে পারে এবং কেন—সেসবেরও ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণ।”

তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ‘এ কাজটি সম্পন্ন করতেই মনে হলো ওইসব মানুষের জন্য রাষ্ট্র-সরকার তাদের জাতীয় বাজেটে কী বাবদ—কতটুকু (কী পরিমাণ) ব্যয়-বরাদ্দ দেয় সেটা দেখা দরকার। একপর্যায়ে মনে হলো, এসবের প্রবণতা দেখা জরুরি। আর সে ক্ষেত্রে কোনো এক/দুই বছরের জন্য নয় বিষয়টি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘমেয়াদে দেখা দরকার। এভাবেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে সম্ভব হলে স্বাধীনতাপরবর্তী বিগত ৫০ বছরের জন্য এসব দেখব। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় জানতাম যে প্রযোজ্য পদ্ধতিতত্ত্বসহ ৫০ বছরের হিসেবপত্তরের কাজটিই হবে একমাত্র চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কাজে নেমে দেখলাম যে বিগত ৫০ বছরের সংশ্লিষ্ট সব বাজেট দলিল-দস্তাবেজ পাওয়াটাই এক দুরূহ কাজ।’

অধ্যাপক আবুল বারকাত লিখেছেন, ‘এই গ্রন্থে অ-জনগণকৃত চারবর্গের মানুষের জন্য বিগত ৫০ বছরের বাজেটীয় হিসেবপত্তর উত্থাপন ও বিশ্লেষণ করেছি। এক্ষেত্রে পর্বতসমান চ্যালেঞ্জ দেখা দিল তখন, যখন আমরা বিগত ৫০ বছরের বাজেটে প্রত্যেক বছরের জন্য উন্নয়ন বাজেটের আওতাধীন প্রকল্প/কর্মসূচি ধরে ধরে এসবের কোনটা-কীভাবে-কতটুকু আমাদের অনুসন্ধানউদ্দিষ্ট চারবর্গের (পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী, ভূমি সংস্কার) সাথে সম্পর্কিত সেসব হিসাবপত্তরে হাত দিলাম। এ সম্পর্কে পদ্ধতিগত কোনো প্রাক্-ধারণা না থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট ধারণা বিনির্মাণে একমাত্র উপায় ছিল নিজের মস্তিষ্ক।’

ড. বারকাত উল্লেখ করেছেন, ‘রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী দলিল হিসেবে আমাদের সংবিধান সবধরনের বঞ্চনা থেকে মানুষকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়। এই প্রতিশ্রুতি কার্যকর হলে মানুষের দারিদ্র্য-বঞ্চনা-অসমতা দূর হওয়ার কথা। কিন্তু গত ৫০ বছরের সমাজ ইতিহাস বলে―তা হয়নি। বিভিন্ন ধরনের দরিদ্রবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অসমতা। এমনকি সরকারি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে হিসাবকৃত ক্রমবর্ধমান গিনি সহগ এবং পালমা অনুপাত দিয়ে এসবের পরিমাণগত দিকও উপলব্ধি করা যায়।’

এই গ্রন্থের দুটি অংশ। প্রথম অংশের শিরোনাম ‘অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি: একটি বিভাবনা’। গ্রন্থের এই অংশটিকে অ-জনগণকরণ-এর রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষণের পদ্ধতিতত্ত্ব বলা চলে। মানুষের ‘অ-জনগণকরণ’ বলতে যা বোঝায় সে-সবের শবব্যবচ্ছেদই গ্রন্থের প্রথম অংশের মর্মবস্তু।

এই গ্রন্থের প্রথম অংশে ‘অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি’-সংশ্লিষ্ট চিন্তাভাবনায় যুক্তিপরম্পরা যেসব বিষয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ:
ক. অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতির মর্মবস্তু; খ. অ-জনগণ হলো সংবিধান অমান্য-উদ্ভূত মানুষ; গ. পারিবারিক কৃষিকাজে নিয়োজিত কোনোমতে বেঁচে থাকা মানুষ—অ-জনগণ; ঘ. গ্রামীণ নারীরা অ-জনগণ (এর অর্থ এই নয় যে শহর/নগরের নারী অ-জনগণ নয়); ঙ. আদিবাসী মানুষ—অ-জনগণ; চ. কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার-উদ্দিষ্ট মানুষ‒অ-জনগণ; ছ. প্রত্যক্ষ ‘দাস’ ও দাসতুল্য মানুষ—‘অ-জনগণ’; তারা ‘মানুষ’ পদবাচ্য কি না সেটাও প্রশ্ন।

গ্রন্থের প্রথম অংশে ‘অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নিয়ে যা বলতে চেষ্টা করা হয়েছে, তাই-ই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশের পদ্ধতিতত্ত্বীয় ভিত্তি বা কাঠামো। বাস্তব জীবনে ‘অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ কোথায়, কতটুকু, কীভাবে বিদ্যমান ও দৃশ্যমান সেসবই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশে অনুসন্ধান করা হয়েছে। এবং সেটা করা হয়েছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। আর তা করা হয়েছে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় (জাতীয়) বাজেটে কয়েকটি বড় বর্গের অ-জনগণকে মাথায় রেখে। এসব বড় বর্গের মধ্যে আছেন পারিবারিক কৃষির সাথে সম্পর্কিত মানুষ, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার-উদ্দিষ্ট মানুষ । চারবর্গের এসব মানুষ-ই সংখ্যাগরিষ্ঠ―দেশের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ।

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সেইসব মানুষ এবং গোষ্ঠী অ-জনগণ, যারা রাষ্ট্রে রেডারের বাইরে ‘বহিঃস্থ’, ‘অন্যজন’, যারা হিসাবের খাতায় অন্তর্ভুক্ত নন, যারা গণনার বাইরে, যারা নাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন-উচ্ছেদিত, সমূলে উৎপাটিত, নির্বংশ। ঐতিহাসিকভাবে এহেন অ-জনগণ—এর ‘বিশুদ্ধতম রূপ’ হলো দাসব্যবস্থার ‘দাস’; পরবর্তীকালে অ-জনগণ হলো সামন্তবাদী ব্যবস্থায় ‘প্রজা কৃষক’, আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ‘মজুরি শ্রমিক’। দাসব্যবস্থার ‘দাস’ হলেন ‘বিশুদ্ধতম অ-জনগণ’ আর আধুনিক যুগের এখনকার ‘অ-জনগণ’ হলেন ‘মুক্তির প্রলেপযুক্ত দাস’।

তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, দেশের মানুষের মধ্যে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিরন্তর বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতার শিকার একই সাথে যা দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো সৃষ্ট তারাই অ-জনগণ প্রক্রিয়াভুক্ত। এ দৃষ্টিতে গুটিকয়েক লুটেরা-পরজীবী-রেন্টসিকার ও তাদের সহযোগীরা ছাড়া সবাই সম্ভাব্য অ-জনগণ। আর সম্ভাব্য অ-জনগণদের মধ্যে সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ও গোষ্ঠীই হবেন নিরঙ্কুশ অ-জনগণ। নিরঙ্কুশ অ-জনগণকৃত এসব মানুষের কোনো তালিকা নেই, তবে তা হবে অনেক দীর্ঘ—বিস্তৃত।

গবেষণাকাজের সুবিধার জন্য নিরঙ্কুশ অ-জনগণকৃত এত ব্যাপক, বিস্তৃত ও বহুমুখী অ-জনগণকৃত মানুষদের গবেষক চারটি বৃহৎ বর্গে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন; ১. পারিবারিক কৃষিসংশ্লিষ্ট মানুষ, ২. গ্রামীণ নারী, ৩. আদিবাসী ও ৪. কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষ। গবেষক বারকাত উল্লেখ করেছেন সুনির্দিষ্ট ধরনের নিরঙ্কুশ অ-জনগণ মানুষ প্রস্তাবিত চার বৃহৎ বর্গের এক বা একাধিক-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং সম্পর্ক জালটি জটিল।

অনুসন্ধিৎসু গবেষক ড. বারকাত তার গ্রন্থে গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, পারিবারিক কৃষি ও সংশ্লিষ্ট মানুষ (ভূমিহীন-প্রান্তিক মানুষ, দরিদ্র-বিত্তহীন-নিম্নবিত্ত, খুদে খামারি), গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষ―এসব বর্গের প্রতিটির ক্ষেত্রে বিগত ৫০ বছরে জাতীয় বাজেট বরাদ্দ জনসংখ্যানুপাতে নগণ্য; প্রকৃত বরাদ্দ ‘স্বল্প বরাদ্দ ফাঁদ’-এ পড়ে আছে; বরাদ্দ বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। এই চারটি বর্গের মানুষই হলেন অ-জনগণ। এদের সম্মিলিতভাবে দেখলে এরা হবেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, মোট জনসংখ্যার ৯০%। অথচ বিগত ৫০ বছরের বাজেটে এদের সম্মিলিত বরাদ্দ হবে জনসংখ্যানুপাতে ন্যায্য হিস্যার বড়জোর ১৩%, আর বাদবাকি ৮৭% তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি, তা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

বিগত ৫০ বছরে সম্মিলিতভাবে এসব মানুষের জন্য বাজেট ‘অন্যায্যতার মাত্রা’ অথবা ‘বৈষম্য মাত্রা’ হবে ৬৬৯%। সুতরাং জাতীয় বাজেট বরাদ্দের নিরিখে এসব মানুষ একক বর্গের মানুষ হিসেবে এবং সম্মিলিতভাবে অ-জনগণ। তাহলে প্রশ্ন―‘জনগণই যদি প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক’ হন, সেক্ষেত্রে এই চারবর্গের মানুষ কী জনগণ?

বিগত ৫০ বছরের জাতীয় বাজেটে পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষের হিস্যার হিসেবপত্র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ যেসব প্রবণতা তিনি দেখিয়েছেন এককথায় তা হতাশাজনক। এসব থেকে উল্লেখিত চারবর্গের মানুষের (যারা দেশের ৯০% মানুষ) নিরন্তর অ-জনগণকরণের-এর এক ‘হতাশ চিত্র’ বা ‘ক্ষোভ-বিক্ষোভ চিত্র’ বা ‘আক্ষেপ চিত্র’ বিনির্মাণ সম্ভব। গবেষক ড. বারকাত উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা প্রশ্ন করেছি অ-জনগণকৃত এসব মানুষের জনগণে উত্তরণ-রূপান্তর সম্ভব কি না? রাষ্ট্রীয় বাজেটের নিরিখে তা সম্ভব কি না? আমাদের উত্তর―সম্ভব। কীভাবে?”

মানব দরদী গবেষক অধ্যাপক আবুল বারকাত তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, চারবর্গের মানুষের অ-জনগণকৃত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে জনগণকৃত অবস্থানে রূপান্তরে অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাজেট হতে পারে অন্যতম মাধ্যম। সেক্ষেত্রে প্রতিটি বর্গের মানুষের জন্য বাজেটে মাথাপিছু বরাদ্দ হতে হবে জাতীয়ভাবে মাথাপিছু বরাদ্দের তুলনায় বেশি। বিষয়টি শুধু জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট পরিবর্তনই নয়, তা বাজেটের আয় উৎসে পরিবর্তন সংশ্লিষ্টও (যেমন- বর্ধিত হারে সম্পদ করারোপ, বর্ধিত আয় কর, কালো টাকা উদ্ধার, অর্থপাচার রোধ ইত্যাদি)। মূল কথা হলো রাষ্ট্রীয় বাজেটের ব্যয়-বরাদ্দ ও আয়―উভয় কাঠামোকেই বৈষম্য নিরসনউদ্দিষ্ট হতে হবে। এর অন্যথা মানুষের অ-জনগণকরণের গভীরতা ও তীব্রতা বাড়াবে। ফলে অনিবার্য হবে সামাজিক সংঘাত-সংঘর্ষ। সমাধানউদ্দিষ্ট পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক।

ড. বারকাত আরও উল্লেখ করেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় বাজেটে পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করার বিষয়টি শেষ বিচারে বৈষম্য নিরসনউদ্দিষ্ট বাজেট বিনিমার্ণ ও তা বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট। আর এটাই সে প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অ-জনগণ থেকে জনগণে রূপান্তর সম্ভব, যে জনগণই হলেন ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক’।

তবে, একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার করলেই মানুষের অ-জনগণকরণ নিমিত্ত সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আসলে এ সংস্কার হলো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অ-জনগণ থেকে জনগণে রূপান্তরের প্রয়োজনীয় শর্ত, পর্যাপ্ত শর্ত নয়। পর্যাপ্ত শর্ত পূরণে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের পাশাপাশি আরও যেসব সংস্কার করতে হবে তার মধ্যে অন্যতম হলো―বস্তুগত উৎপাদন খাত (অর্থনীতির শিল্প ও সেবা খাত) এবং নৈতিক দ্রব্য উৎপাদন খাতে (সামাজিক―স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি খাত) জনকল্যাণমুখী সংস্কার। অর্থাৎ সংস্কারকাজটি হতে হবে আংশিক নয়―পূর্ণাঙ্গ-সামূহিক-সামষ্টিক। আর এ সংস্কারে রাষ্ট্রের বাজেট হবে অন্যতম ফলপ্রদ রাজনৈতিক-অর্থনীতিক নীতিকৌশলিক হাতিয়ার।

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের এই গবেষণা গ্রন্থটি জ্ঞানপিপাসু পাঠকদের জন্য নতুন জ্ঞান ও ধারণার দ্বার উম্মোচনকারী হিসেবে ইতিমধ্যে পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছে। সেই সাথে উন্নয়ন নীতিনির্ধারক ও শাসনব্যবস্থা পরিচালনাকারী মহলের জন্যও গ্রন্থটি দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এছাড়া দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থা যারা এনিয়ে কাজ করছেন, গবেষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার জন্য গবেষণা গ্রন্থটি সহায়ক হবে বলে মনে করি। সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি এমন একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন, যােএর আগে আর কেউ করেছেন বলে জানা নেই।

সব্যসাচী হাজরার প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও অলঙ্করণে দুই অংশে বিভক্ত ও ১৫টি অধ্যায়ে সুবিন্যস্ত এই গবেষণা গ্রন্থটির পৃষ্টা সংখ্যা ২৬৫। এছাড়াও ৩০টি সারণি, ১৫টি লেখচিত্র, ৭টি চিত্র, একটি ম্যাপ, ১০টি ছকসহ এই গ্রন্থে রয়েছে একটি তথ্যপঞ্জী ও নির্ঘণ্ট। ঢাকাস্থ মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনার পক্ষে এই গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন অরনি বারকাত এবং এর মূল্য রাখা হয়েছে ১০০০ টাকা।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/ফারুক/এমএস