ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নয়, দ্রব্যমূল্য কমান

ইয়াহিয়া নয়ন | প্রকাশিত: ০৯:৫৪ এএম, ২৫ মে ২০২৩

সরকার বলেছে, এখন থেকে প্রতি মাসেই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। এই ‘সমন্বয়’ শব্দটার ওপরে সাধারণ মানুষের এক ধরনের আতঙ্ক এসে গেছে। দেশে মূল্যস্ফীতি এখন ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বাজারে তার প্রভাব পড়েছে বেশ কিছুদিন ধরেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ গত এক বছরে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনলেও বাংলাদেশ তা পারেনি। বারবার কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিলেও তাতে অর্থনীতিবিদদের সায় মিলছে না। অনেকেই বলছেন, যেসব দেশ মূল্যস্ফীতি রোধে সক্ষম হয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো দরকার। দ্রুত এ ব্যাপারে কার্যকর কিছু করা সম্ভব না হলে জনজীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব বাড়বে।

অথচ এর মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসির) কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, তিতাস একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রমেই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। তথ্যমতে, গত মাসেও তিতাসের ক্ষতির পরিমাণ দুইশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হলে তার প্রভাব পড়বে অন্যান্য ক্ষেত্রে এবং ভোগান্তি বাড়বে নির্ধারিত আয়ের গৃহস্থদের।

মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকরা বেশি গ্যাস ব্যবহার করছেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এই বক্তব্যকে মনগড়া ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন ভোক্তারা। চুরি ঠেকাতে না পেরে সেই দায় আবাসিক গ্রাহকদের ওপর চাপাতে চাইছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বর্তমানে মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকদের এক চুলা ৫৫ ঘনমিটার (৯৯০ টাকা) এবং দুই চুলা ৬০ ঘনমিটার (১০৮০ টাকা) গ্যাসের বিল আদা করা হচ্ছে। আগে এক চুলার জন্য ৭৩.৪১ ঘনমিটার ও দুই চুলায় ৭৭.৪১ ঘনমিটারের বিল আদায় করা হতো। তিতাস দাবি করেছে, নির্ধারিত পরিমাণের (৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার) চেয়ে মিটারবিহীন গ্রাহকরা বেশি গ্যাস ব্যবহার করে। ফলে সিস্টেম লস বৃদ্ধি পেয়েছে। তিতাস তার আবেদনে এক চুলা ৭৬.৬৫ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৮৮.৪৪ ঘনমিটার করার আবদার করেছে বিইআরসির কাছে।

তিতাস গ্যাসের এই বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারছি না। আসলে, তিতাস গ্যাস অযৌক্তিকভাবে বিল বাড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের পরিসংখ্যান বের করলেই তিতাসের বক্তব্য অসার প্রমাণিত হবে। রূপনগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আমার এ আত্মীয় বলেছেন, আগে ১ হাজার টাকার গ্যাস রিচার্জ করলে প্রায় তিন মাসের মতো চলে যেত।

গত বছর দাম বাড়ানোর পর (১২.৬০ থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা) ১৫শ টাকা রিচার্জ করলে আড়াই থেকে তিন মাস চলে যায়। অর্থাৎ প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীর মাসে খরচ পড়ছে ৫ থেকে ৬শ টাকা। লালমাটিয়ার এক বাসিন্দা প্রায় একই রকম তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি বড় পরিবার হলেও ৮শ টাকার বেশি গ্যাস লাগবে না।

তিনি আরও বলেন, আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাতজন ১ হাজার টাকার গ্যাস রিচার্জ করলে দুই মাসের মতো চলে যায়। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার ১৮ টাকা হারে আদায় করা হচ্ছে। অর্থাৎ ১৫শ টাকা রিচার্জ করলে ৮৩ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করতে পারছেন একজন গ্রাহক। দুই চুলার গ্রাহকের কাছ থেকে মাসে ৬০ ঘনমিটারের বিল আদায় করা হচ্ছে।

খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, “প্রিপেইড মিটার স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট খুব ভালো। দুই চুলায় মাসে ৩৩ ঘন মিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে”। তার বক্তব্য অনুযায়ী প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীরা মাসে ৪৫ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করছেন।

সাধারণ মানুষ আর পেরে উঠছে না। তেল-চিনির দাম সরকার নির্ধারণ করে দিচ্ছে কিন্তু সেই দামে বাজারে মিলছে না। পেঁয়াজ রসুন আদা এসব কি ইউক্রেন থেকে আসে? দাম বাড়ছে, কিন্তু কেউ এসবের দায় নিচ্ছে না। সরকার বলছে, সব ব্যবসায়ীর কারসাজি। বাজারে গেলে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘দাম কেন বেশি সরকাররে জিগান?’ কোনো পক্ষই দায় নিচ্ছে না। সব দায় কি তবে সাধারণ মানুষের?

মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগেও ক্রেতা-ভোক্তার অধিকার রক্ষা ও সংকট মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণই রীতি। তাছাড়া একটি তেজি চলমান অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির ধারা এতদিন ধরে অব্যাহত থাকতে পারে না। বিইআরসির বৈঠকে অংশ নিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী যদিও বলেছেন, দ্রব্যমূল্য একবার বাড়লে তা নামতে সময় প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ মূল্য বাড়ে দ্রুত আর কমে ধীরে। কিন্তু যেটা জনগণ দেখতে চায় তা হলো মূল্য কমার জন্য সরকারের কার্যকর উদ্যোগ।

এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থা এজন্য দায় কার বা কী তা নিয়েই সময়ক্ষেপণ করছে। আমার মনে হয় দেরি না করে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর এখনই বসা দরকার। তারা সহায়তা নিতে পারেন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের। কথা হলো, যেভাবেই হোক বাজারে হস্তক্ষেপ জরুরি। এটা এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।

আর মাত্র ৬-৭ মাস পরই জাতীয় নির্বাচন। তার আগে দ্রব্যমূল্য কমানোর ক্ষেত্রে কিছু সাফল্য প্রয়োজন। এই বিবেচনা থেকে বলা যায়, গ্যাস-বিদ্যুতের মতো মৌলিক উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির এটা সময় নয়। আমরা জানি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের শর্ত রয়েছে এ দুই খাতে ভর্তুকি কমানো বা তুলে দেওয়ার ব্যাপারে। তা সত্ত্বেও নির্বাচন সামনে রেখে এ শর্ত পূরণের দায় কিছুটা পেছানো প্রয়োজন। এ নিয়ে তাদের মতামতও নেওয়া যেতে পারে। আর এর মধ্যে বাজার স্থিতিশীল করা ও মূল্য কমিয়ে আনার জন্য কাজ করতে হবে। সরকার বিলাসদ্রব্যের আমদানি কমিয়ে নিত্যপণ্যের আমদানি বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিশ্ববাজারে এখন নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল হয়েছে। আমরা আশা করব তিতাসসহ গ্যাসসংশ্লিষ্ট সব কোম্পানির দুর্নীতি-অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধকে সরকার গুরুত্ব দেবে। সেই সঙ্গে কমিশন থেকে তিতাসের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে তা পুনর্গঠন করা দরকার। সুচিন্তিত পদক্ষেপের মাধ্যমেই এমন সমস্যার সমাধানে সফল হওয়া সম্ভব।

লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

আরও পড়ুন