টাকা-রুপিতে বাণিজ্য: কার লাভ কার ক্ষতি?
প্রতিবেশী দুই দেশ বাংলাদেশ ও ভারত শিগগির তাদের স্থানীয় মুদ্রা টাকা ও রুপিতে বাণিজ্য শুরু করতে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য শুরু হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, একটি পাইলট কর্মসূচি হিসেবে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক এবং ভারতের আইসিআইসিআই ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে এই লেনদেন চালু হবে। দুই দেশের আরও ব্যাংক ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়ায় যোগ দেবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই অন্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমছে। যুদ্ধের কারণে শুরু হওয়া উচ্চ আমদানি ব্যয়ের ফলে অর্থনীতি মুদ্রাস্ফীতিতে পড়ে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ে। ফলে কিছু সময়ের জন্য জ্বালানি ও খাদ্য সংকট তৈরি হয়। বিপরীতে বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে মার্কিন ডলার অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী হয়। তারপর থেকে সংকট মোকাবিলায় মার্কিন ডলারের ওপর চাপ কমিয়ে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের আলোচনাটি সামনে আসে।
বাংলাদেশ ও ভারতের নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনের এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল আরও এক দশক আগে। সেই সময়ে, সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় প্রস্তাবটি অন্ধকারেই থেকে যায়। দীর্ঘ বিরতির পর রিজার্ভ সংকটের মধ্যে বিষয়টি আবার সামনে আসে। গত বছরের ডিসেম্বরে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে রুপিতে বাণিজ্যিক লেনদেন করার প্রস্তাব করে ভারত। এরপর মার্চে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপিত হয়।
পরে ভারতের একটি প্রতিনিধি দল গত মাসে বাংলাদেশ সফর করে এবং দুই দেশের মধ্যে টাকা ও রুপিতে বাণিজ্যিক লেনদেনের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে। দ্বিপক্ষীয় লেনদেনের সুবিধার্থে উভয় দেশের ব্যাংকই অন্য দেশের ব্যাংক দুটিতে অ্যাকাউন্ট খুলবে, যা ভোস্ট্রো এবং নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট হিসাবে পরিচিত। টাকা থেকে রুপি এবং রুপি থেকে টাকায় বিনিময় হার হিসাব করা হবে। এতে মুদ্রাকে ডলারে রূপান্তর না করেই সরাসরি লেনদেন করা যাবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে ভ্রমণ বা ভারত থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অ্যাকাউন্টে ভারতীয় রুপি যোগ করা যাবে। একইভাবে, ভারতীয়রাও বাংলাদেশে লেনদেনের জন্য তাদের হিসাবে টাকা যোগ করতে পারবেন।
২০২২ সালে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পর থেকে ভারত বিশ্বের দ্রুততম বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিগুলোর একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পরেই তৃতীয় স্থানে উঠে আাসবে। কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন যুদ্ধের বিভীষিকায় বিশ্বব্যাপী সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা এবং আর্থিক ব্যবস্থা ঝুঁকিতে পড়ার পরও ভারতীয় অর্থনীতি শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল রয়েছে। ২০২১ সালে ভারতের বার্ষিক আমদানি ও রপ্তানি যথাক্রমে ৪০০ বিলিয়ন ও ৫৬০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। শক্তিশালী অর্থনৈতিক সাফল্য এবং ভূ-রাজনৈতিক অগ্রগতির সাথে, ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রভাবশালী আঞ্চলিক নেতৃত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ভারতের এই অর্থনৈতিক শক্তিমত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রুপিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করছে। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহারের প্রবণতা সারা বিশ্বেই বেড়েছে। তারই অংশ হিসেবে বৈদেশিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে রুপির ব্যবহার বাড়ছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, জার্মানি, রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ১৮টি দেশ ভারতীয় রুপিতে বাণিজ্য করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। ১৯তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন।
বাংলাদেশের এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে গত দেড় বছরের অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে, যা এখনো চলমান। সম্প্রতি জ্বালানির মূল্য পরিশোধে দেরি হওয়ায় বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশকে তেল সরবরাহ করছে না বলে জানিয়েছে বিপিসি। এর পরিপ্রেক্ষিতে রুপিতে এ মূল্য পরিশোধের কথা ভাবছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে টাকা-রুপিতে বাণিজ্য করার সিদ্ধান্তটি মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর একটি উদ্যোগ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ।
মুদ্রা বাজারে ভারসাম্যহীনতার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত দুই অর্থবছরে তার নেট রিজার্ভের ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করে করেছে। গত কয়েক বছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। বিশেষ করে, গত দেড় বছরে টাকার মান ধীরে ধীরে কয়েক দফা হ্রাস পেয়েছে এবং এখনও বাজার অস্থিতিশীল রয়েছে। তাই, অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও তার রিজার্ভে বৈচিত্র্য আনতে এবং স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করতে আগ্রহী হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার ও রুপির পাশাপাশি ইউয়ানের রিজার্ভও তৈরি করছে। কারণ চীনের মুদ্রা আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে বিশ্বব্যাপী দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করছে। গত মাসে বাংলাদেশ ও রাশিয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম কিস্তির প্রায় ৩২০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ইউয়ানে লেনদেন করতে সম্মত হয়েছে। রাশিয়াকে সুইফট গেটওয়ে থেকে বের করে দেওয়ার পর থেকে ভারত এবং চীনসহ রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য করা দেশগুলো ডলারের পরিবর্তে রুপি এবং ইউয়ানে বাণিজ্য করছে।
প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল বেশ কয়েকটি দেশ, বিশেষ করে ব্রিকস জোটের দেশগুলো যখন ডলারের ওপর তাদের নির্ভরতা কমাতে একটি বিকল্প মুদ্রা প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছে। রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ব্রিকসের প্রস্তাবিত মুদ্রাটিতে দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ আগ্রহী হয়েছে। সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশসহ ব্রিকস এর বাইরের ২৫টি দেশ এখন ব্রিকসের এই মুদ্রা পদ্ধতিতে যোগ দিতে আগ্রহী।
টাকা ও রুপির লেনদেনে কিছু ইতিবাচক দিকের সাথে কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। রিজার্ভের বহুমুখীকরণের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে একাধিক মুদ্রায় রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও কনভার্শনের অতিরিক্ত ঝামেলা পোহাতে হবে। ডলারের বিপরীতে যেকোনো একটি মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
বিপরীতে, ব্যবসায়ীরা এটিকে স্বাগত জানিয়েছেন কারণ এটি ডলারের মতো তৃতীয় কোনো মুদ্রা ব্যবহার না করেই ভারত থেকে আমদানি ও রপ্তানির জন্য টাকা বা রুপিতে এলসি খোলার সুযোগ দেবে। এছাড়া বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ভারত ভ্রমণকারী বাংলাদেশীরাও এটিকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন। তবে গত অর্থবছরে ভারত থেকে প্রায় ১৬.১৯ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয়ের বিপরীতে মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির কারণ মুদ্রার সরবরাহ ঘাটতি নিয়ে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। সেই বিবেচনায়, শুধু বাংলাদেশের রপ্তানির সমপরিমাণ অর্থাৎ প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের লেনদেনই রুপি এবং টাকায় নিষ্পত্তি করা হবে। তবে এটিকে ডলারের ওপর নির্ভরতা হ্রাসের প্রক্রিয়ার একটি অংশ হিসেবে দেখলে এর পরিণতি এখনই ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান না হলেও এর একটি দীর্ঘস্থায়ী সুফল অদূর ভবিষ্যতেই পাওয়া যাবে।
লেখক: গবেষক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম